দাঙ্গার আঁচ নিজেদের মনে লাগতে দেননি বাবুনগরের মুসলমানেরা, লাঠি হাতে তারা পাহারা দিয়েছেন এলাকা। মাথায় ছিল একটাই কথা- "মসজিদ জ্বলে গিয়েছে জানি, কিন্তু মন্দিরে কোনও আঁচ লাগতে দেব না।"

মানুষ মরছে, মানুষই মারছে। পুড়ছে মসজিদ, মন্দির, সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর হচ্ছে নির্যাতন। জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়া হচ্ছে তাদের দোকান, বসত বাড়ি, প্রাণের ভয়ে দলে দলে লোকজন পাড়ি জমাচ্ছে দিল্লি থেকে দূরে। এখনও গুমোট একটা আবহাওয়া দিল্লিতে, কয়েক জায়গায় জারী করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। প্রায় পঁয়তাল্লিশ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে সাম্প্রদায়িক এই দাঙ্গায়, সেই সঙ্গে জন্ম হয়েছে এমন কিছু অনিন্দ্যসুন্দর গল্পের, যেগুলো শুনলে মানুষের ওপর নতুন করে বিশ্বাস জন্ম নেয়, মানবতা আর মনুষ্যত্ব শব্দগুলো পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যায়নি বলেই মনে হয়। 

পুরান দিল্লির মুস্তফাবাদ এলাকা, মুসলমানদের বসবাস এখানে অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি। ২৩/২৪ তারিখে যখন পুরো দিল্লি রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, তখন সেই আগুনের ঝাঁঝ এসে লেগেছিল মুস্তফাবাদেও। প্রায় হাজারখানেক দাঙ্গাবাজের একটা দল হামলা করেছিল মুস্তফাবাদের বাবুনগর এলাকায়, গোঁড়া হিন্দুত্ববাদের আগুনে পুড়েছিল মানবতা। আগুন লাগানো হয়েছিল মসজিদে, ভাংচুর আর তাণ্ডবে ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছিল পুরো এলাকাটা। 

গুমোট একটা আবহাওয়া বিরাজ করছিল মুস্তফাবাদে। দিল্লি তখন পরিণত হয়েছে রণক্ষেত্রে। বিজেপি আর আরএসএসের নেতৃত্বে হিন্দু দাঙ্গাবাজেরা বেছে বেছে হামলা চালাচ্ছে মুসলমানদের ঘরে, দোকানে। মুসলিম কট্টরপন্থিরাও সেসবের জবাব দিচ্ছে সাধ্যমতো। চারপাশে অবিশ্বাসের একটা সুর, এতকাল ধরে পাশাপাশি বাস করে আসা মানুষগুলো, একে অন্যকে নিজেদের ভাইয়ের মতো জেনে আসা মানুষগুলোর মাঝে কেমন যেন একটা বিভেদের দেয়াল গড়ে উঠলো। 

দাঙ্গা ভয়ানক রূপ নিয়েছে দিল্লিতে

দেয়ালটা ভেঙে ফেলেছে মুস্তফাবাদের বাবুনগর এলাকার বাসিন্দারা। বহিরাগত দাঙ্গাবাজেরা এসে তাদের মসজিদ ভেঙেছে তো কি হয়েছে, হিন্দুর মন্দির যেন কেউ না ভাঙতে পারে, সেই ব্যবস্থা নিয়েছে তারা। মুসলমানেরা সেই পাড়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠ, দিল্লির অন্য প্রান্ত থেকে মুসলিম দাঙ্গাবাজেরা এসে যাতে মন্দিরে হামলা চালাতে না পারে, সেজন্যে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা তারা পাহারার ব্যবস্থা করেছেন এলাকায়। 

শিফট করে মন্দির পাহারা দিয়েছে মুসলমান তরুণেরা। তারা জানতেন, মন্দির ভাঙতে কোন হিন্দু আসবে না, আসবে মুসলমান কেউই, মসজিদ ভাঙার প্রতিশোধ নিতে। ধর্মের ভাইদের হাতে যেন প্রতিবেশীর ধর্মীয় উপাসনালয় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্যেই ছিল তাদের উৎকণ্ঠা। দিল্লির খবরাখবর সবই তারা পাচ্ছিলেন, দেখেছেন, কীভাবে উন্মত্ত লোকজন হিন্দুত্বের নাম করে মসজিদ ভাঙছে, মুসলমানের প্রাণ নিচ্ছে। সেসবের আঁচ নিজেদের মনে লাগতে দেননি বাবুনগরের মুসলমানেরা, লাঠি হাতে তারা পাহারা দিয়েছেন এলাকা। মাথায় ছিল একটাই কথা- "মসজিদ জ্বলে গিয়েছে জানি, কিন্তু মন্দিরে কোনও আঁচ লাগতে দেব না।"

দিল্লি এখন ধ্বংসস্তুপ প্রায়

গত ৩০-৩৫ বছর ধরে ওই মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করছেন রীনা নামের একজন পুরোহিত। দৈনন্দিন পুজোর সব দায়িত্বই পালন করেন তিনি। মুসলমান অধুষ্যিত এলাকায় থাকেন বলে নিজেকে একটুও অনিরাপদ ভাবেন না রীনা। এই বিপদের সময়ে মুসলমানরা যখন এগিয়ে এসেছেন মন্দির রক্ষায়, তখন তিনিও ধর্ম বিচার না করে আস্থা রেখেছেন ভিন্ ধর্মের ভাইদের উপরেই। তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন মন্দিরের চাবি, বলেছেন- 

‘‘ওরা তো নিজেদেরই লোক। গত কয়েক দিন মন্দিরে যেতে পারিনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম, ওরা থাকতে মন্দিরের কোনও ক্ষতি হবে না। এত দিন একসঙ্গে রয়েছি। পরিস্থিতি খারাপ বলে কি সব বদলে যাবে? আমরা পৃথক ভাবে ধর্মাচরণ করলেও ঈশ্বর তো একই,’’

প্রেমকান্ত বাঘেল নামের একজন হিন্দু নিজের প্রাণের মায়া ভুলে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে বাঁচিয়ে এনেছেন ছয়জন মুসলমানকে, তাদের প্রাণ বাঁচিয়ে নিজেই মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন তিনি। দিল্লির শিখ ধর্মাবলম্বীরা আক্রান্ত মুসলমানের জন্যে খুলে দিয়েছে গুরদ্বার, খ্রিস্টানরাও খুলেছে চার্চের দরজা। দলিত হিন্দুরা পাহারা দিচ্ছে পাড়া, যাতে মুসলমানদের ওপর হামলা করতে না পারে কেউ। দিল্লির এই রক্তাক্ত সময়টার মাঝে এই তালিকায় নতুন করে যুক্ত হলো মুস্তফাবাদের মুসলমানদের ঘটনাটা। দাঙ্গা ভয়ানক, দাঙ্গা হিংসার ভয়াবহতা দেখায় আমাদের। সেই সঙ্গে দাঙ্গার এই সময়টাতেই জন্ম নেয় এমন কিছু গল্প, যেগুলো সব হিংসা, হানাহানি আর ভেদাভেদ ভুলে পাশাপাশি দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণাও যোগায়...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা