একপাশে হানাহানি আর ধ্বংসযজ্ঞের লীলাখেলা, অন্যপাশে সম্প্রীতি আর ভালোবাসার অদ্ভুত এক মেলবন্ধন- ভার‍তের আসল রূপ যে কোনটা, এটা বুঝতেই হিমশিম খেতে হয়।

ডান পাশে লক্ষ্মী সাবান স্টোর, বাঁয়ে যাদব'স সু স্টোর। মাঝখানের দোকানটা আলী মোহাম্মদের, মশলার দোকান ছিল সেটা। ছিল লিখতে হচ্ছে, কারণ দোকানের অস্তিত্ব এখন আর নেই। দুই পাশের দুটো দোকান নির্বিঘ্নে দাঁড়িয়ে আছে, আর আলীর দোকানের শাটার ভেঙে ভেতরের সব জিনিসপত্র লুট করে নেয়া হয়েছে। পাশের দুটো দোকানে কেউ হাতও দেয়নি, অথচ আলীর দোকানটাকে আস্ত রাখা হয়নি। কারণ আলী মুসলমান, বাকী দুজন হিন্দু। বেছে বেছে এভাবেই হামলা চালানো হচ্ছে সংখ্যালঘুদের ওপর, তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চালানো হচ্ছে লুটপাট। দিল্লি জ্বলছে, ভারতের হৃৎপিণ্ড পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার আগুনে। 

আগুনটা বাষ্পীভূত ছিল অনেকদিন ধরেই। নাগরিকত্ব আইন আর নাগরিক পঞ্জি নিয়ে ভারত উত্তাল সেই ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকেই। একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাস্তায় নেমেছে, সরকার তাদের দাবীতে কান দেয়নি, ক্ষমতাসীন দল নিজেদের জনপ্রিয়তার কারণে ধরাকে সরা জ্ঞান করেছে, পাত্তা দেয়নি মানুষের আবেগ আর অনুভূতিকে। একটা নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষের প্রতি নিজেদের ক্ষোভ জারী রেখেই বিভাজনের রাজনীতির পথে হেঁটেছে, সংখ্যাগুরু ভোটব্যাংকটাকে নিজেদের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করেছে রাজনৈতিক মেরুকরণের মাধ্যমে। সেটারই ফল এখন প্রাণ বিসর্জন দিয়ে হাতেনাতে পাচ্ছে দিল্লির মানুষ। 

বিজেপির নেতারা একের পর এক উস্কানীমূলক বক্তব্য দিয়ে গেছে, সরকারের মধ্যে থাকা কারোরই মনে হয়নি এসবে লাগাম টানা প্রয়োজন, নইলে বড়সড় ঝামেলা বাঁধতে পারে। কে জানে, সরকারেরই হয়তো ইচ্ছে ছিল সাম্প্রদায়িকতার আগুনে রুটি সেঁকে খাওয়ার। কপিল মিশ্র বা অনুরাগ ঠাকুরের মতো কট্টরপন্থী নেতারা তো শুধু সরকারের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করেছে। 

বেছে বেছে লুটপাট চালানো হচ্ছে মুসলমানদের দোকানে

দিল্লি এখন অগ্নিগর্ভ, থমথমে পরিস্থিতি সেখানে, প্রায় পঁচিশটা লাশ পড়ে গেছে ইতিমধ্যেই, কথা হচ্ছে সেনাবাহিনী নামানো হবে কিনা সেটা নিয়ে। পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, সেটা বারোশো মাইল দূরে বসে ভিডিও ফুটেজ দেখে উপলব্ধি করা সম্ভব নয় পুরোপুরি। যুগে যুগে মানুষকে বিভক্ত করার জন্যে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে ধর্ম, দিল্লিতেও আরও এইবার সেই মারণাস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে ধর্মান্ধের দল। মসজিদ ভাঙচুর হয়েছে, মিনারে চড়ানো হয়েছে হিন্দুত্বের প্রতীক গেরুয়া পতাকা, পোড়ানো হয়েছে কোরআন শরীফ। 

বাচ্চাদের জন্যে খাবার কিনে ঘরে ফিরতে পারেননি বাবা, ফিরেছে তার লাশ। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ কনস্টেবল মরেছেন গুলি খেয়ে, কোথাও আবার পুলিশকেই দেখা গেছে দাঙ্গাবাজদের সঙ্গে একজোট হয়ে সংখ্যালঘু মুসলমানের ওপর হামলা চালাতে, তাদের দোকানে লুটপাট করতে। দিল্লি পুলিশ মোটামুটি ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই নিস্কর্মার পরিচয় দিয়েছে, বজায় রেখেছে মোদি সরকারের পা চাটার ধারাবাহিকতা। 

গুজরাট দাঙ্গার মডেল অনুসরণ করেই এগিয়েছে দিল্লির ঘটনা, লক্ষণ আর ফলাফলগুলো প্রায় ক্ষেত্রেই মিলে যায়। নিয়ন্ত্রণের বদলে ক্ষমতাসীনরা বরং ছড়িয়ে দিতে চাইছে জিনিসটাকে। উত্তরপ্রদেশ, যোগীর রামরাজ্য যেখানে বর্তমান, সেখান থেকে হাজার হাজার লোক ঢুকেছে দিল্লিতে, এদের অনেকেই সশস্ত্র। মুসলমানদের বাড়িঘরে হামলা চালাচ্ছে তারাও, অভিযোগ এসেছে লোকজনকে আটকে রেখে প্যান্ট খুলে ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত হবারও।

এটাই দিল্লির বর্তমান পরিস্থিতি

দিল্লি এখন অরাজক এক নগরী, ভারতের রাজধানী শহরের ছাপটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না রাজপথে। চারপাশে ধ্বংসস্তুপের মেলা, ভাংচুর আর ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন ছড়িয়ে আছে সর্বত্র। একটা আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে প্রতিটা সেকেন্ড পার করছেন মুসলমানেরা, কোথাও আবার মুসলিমদের কেউ কেউ হানাহানির রাস্তা বেছে নিয়েছে, হাতে তুলেছে অস্ত্র, পাল্টা হামলা চালাচ্ছে তারাও। রোম যখন পুড়ছিল, নিরো নাকি তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলো। দিল্লি যখন পুড়ছিল তখন নরেন্দ্র মোদি ট্রাম্প আর তার স্ত্রীর সেবায় মগ্ন থেকেছেন। তিনদিন পরে এসে একটা টুইট করে দায়িত্ব সেরেছেন! এই না হলে ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ছাপ্পান ইঞ্চি সিনাওয়ালা প্রধানমন্ত্রী! 

এরই মাঝেও মন ভালো করে দেয়া অজস্র গল্পের জন্ম হয়েছে। আক্রান্ত মুসলমানদের রক্ষার জন্যে গুরুদ্বারের দরজা খুলে দিয়েছে শিখ সম্প্রদায়, দলিতেরা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে পাড়া, যাতে বহিরাগত কেউ তাদের মুসলমান ভাই-বোনদের ওপর হামলা করতে না পারে! একদিকে আরএসএস ক্যাডারেরা হামলা চালাচ্ছে, ভাংচুর করছে সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়ি, পিটিয়ে মেরে ফেলছে মানুষ, আবার বিজেপিরই স্থানীয় নেতা ছুটে এসে বাঁচাচ্ছে আক্রান্ত মুসলমানের প্রাণ, বুক চিতিয়ে দাঁড়াচ্ছে আগুয়ান ভীড়ের সামনে- হিংসার সামনে জিতে যাচ্ছে মনুষ্যত্ব, জিতে যাচ্ছে ভালোবাসা- এই ছবিগুলোও দিল্লির আনাচে কানাচে ঘটছে এখন। পঁচিশটা প্রাণ ঝরে গেছে সত্যি, পাঁচশোটা প্রাণ বেঁচে যাওয়ার গল্পও কিন্ত জমে গেছে এরই মধ্যে। 

একপাশে হানাহানি আর ধ্বংসযজ্ঞের লীলাখেলা, অন্যপাশে সম্প্রীতি আর ভালোবাসার অদ্ভুত এক মেলবন্ধন- ভার‍তের আসল রূপ যে কোনটা, এটা বুঝতেই হিমশিম খেতে হয়। বিবেকানন্দের ভারত, মহাত্মা গান্ধীর ভারত আজ নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহ' মতো দাঙ্গাবাজ মানুষদের নিয়ন্ত্রণে, যারা বিভাজনের পথে হেঁটে মানুষকে শুধু ভাগই করতে চায়। কারণ তারা জানে, জনগণ এক হয়ে গেলে মানুষের চেয়ে শক্তিশালী কিছু আর থাকবে না, তাদের ওপর রাজত্ব করাও যাবে না। ভেদাভেদের এই কূটিল রাজনীতি আর কতদূর গড়ায়, কত প্রাণের বিসর্জন আর কতটা পোড়ানোর পর সাম্প্রদায়িকতার এই আগুন থামে- সেটাই এখন দেখার বিষয়...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা