করোনার এই ক্রান্তিকালটাই 'চীন' হয়ে ওঠার উপযুক্ত সময়!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

২০০০ সালের পর চীনের মোট বানিজ্যিক মবিলাইজেশানের পরিমাণ ছিল ৫০০ বিলিয়ন ডলার, মাত্র উনিশ বছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার বিলিয়ন ডলারে। কী মনে হয়? বেইজিং কেন্দ্রিক অর্থনিতি এর মূলে? একদমই নয়।
অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে কীভাবে এসেটে পরিণত করতে হয় তার চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে জনবহুল দেশ চীন। দুই-একটা উদাহরণ দেয়া যাক- নব্বইয়ের দশকে জেলখানার কয়েদিদের দিয়ে ক্যালকুলেটর বানিয়ে চীন বুঝতে পারে, যে যেখানে আছে, তাকে সেখানেই কাজে লাগাতে হবে। পুরো দেশকে তৈরী করতে হবে অর্থনিতির মুক্তাঞ্চল হিসেবে।
বিভিন্ন এয়ারপোর্টে লেওভারের টাইমে আমরা ৩-৭ ডলারে যে হোম ডেকরের জিনিসপত্রগুলি কিনি, তা কোথায় তৈরি হয় ধারণা আছে? তার অধিকাংশই নৌকায় তৈরী হয়। শুধু তাই নয়, হাজার হাজার হস্তশিল্পের ক্ষুদ্র ফ্যাক্টরি আছে নৌকায়, বাসার ছাদে, বাড়ির গ্যারেজে, নিজেদের লিভিং রুমে- অর্থাৎ পুরো চীন জুড়ে! মিনিমাম ওভারহেড কস্ট, কোয়ালিটি শ্রম, বাড়তি বিল আর ভাড়ার বোঝা না থাকার কারণে এই পন্য চীন স্বল্পমূল্যে আপনার ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে, তৈরী করেছে 'চাইনিজ মনোপোলি'।
করোনার প্রকোপে প্রবল অর্থনৈতিক সংকট তৈরী হয়েছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাণিজ্য হারাচ্ছে, চাকুরি হারাচ্ছে সাধারন শ্রমজীবী। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঢাকা শহর ছেড়ে দিচ্ছে, যারা ছাড়ছে, তারা ভাবছে এত বছরেও এই শহরে একটু ঠিকানা হলো না, সব দেওয়ার পরেও এই শহর পরই থেকে গেল। আমরা যারা এখনো ছাড়িনি, টিকে আছি, প্রচন্ড ভয়ের মধ্যে দিন পার করছি; নিজেকে কল্পনা করছি ফিউচার ভিক্টিম হিসেবে।
এই সময়টায় সবার মনে ঘাপটি মেরে থাকা ভাবনা হচ্ছে- 'বাড়ি ওয়ালা ভাড়া কমাচ্ছে না কেন', 'সরকার কেন বলছে না আগামি ৬ মাস সব বিল মওকুফ', 'যে মানুষগুলো শহর ছেড়ে দিচ্ছে, তাদের পাশে কেউ দাঁড়াচ্ছে না কেন', 'কোম্পানিগুলো এত বছর ব্যবসা করার পর এখন দুর্দিনে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে না কেন'।
আমাদের এই ভাবনাগুলোই ভিন্নভাবে ভাবার সময় এসেছে। আসুন অন্যভাবে ভাবি- ঢাকায় বাড়ি ভাড়া এত বেশী কেন, আমার ট্যাক্স সরকার কতটুকু ইফেক্টিভ মেথডে খরচ করছে, ১৬ কোটি মানুষের চার ভাগের এক ভাগই রাজধানীতে কেন, কোম্পানিগুলোর কাছে আমাদের শ্রম এত মুল্যহীন কেন- ইত্যাদি।
যেখানে চাহিদা অনুযায়ী সাপ্লাই অপ্রতুল, সেখানে পণ্যের দাম এক তরফা হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী, একটা বাড়ির টু-লেট ঝুললে প্রতিদিন এভারেজে ১০ টা কল পাওয়া যায়, এ শহরে বাড়ি ভাড়া বাড়াটাই স্বাভাবিক।
এবার নিজের প্রতি নিজেই কয়েকটা প্রশ্ন করি আসুন- সরকারকে আমি পুরোপুরি ট্যাক্স দিচ্ছি কি? দেশের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো কতটুকু ট্রান্সপারেন্ট ট্যাক্সের ক্ষেত্রে? সরকারের কর বিভাগ কতটুকু নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী এই ব্যাপারে? যতটুকু ট্যাক্স আদায় হচ্ছে তার কতটুকু জনকল্যানে খরচ হচ্ছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর মিলানো কঠিন আমাদের জন্য, তাই এড়িয়ে যাই কমবেশি সবাই। সবমিলিয়ে, শুধুমাত্র ইনফাস্ট্রাকচারাল ডেভেলপমেন্ট আর ঋণপুষ্ট জিডিপি গ্রোথে যখন আমাদের মন ভরে যায়, তখন এই ছাইপাস বিল মওকুফের দাবী ছাড়া অন্য কিছু আমাদের মাথায় না আসাই স্বাভাবিক।
প্রান্তিক অঞ্চল থেকে শুরু করে মফস্বল, এমনকি বিভাগীয় শহরাঞ্চলের মানুষ, আমরা সবাই বিভিন্ন কারণে ঢাকামুখী, ঢাকাকে আমরা একমাত্র সমাধান হিসেবে দেখছি। প্রতিটি মন্ত্রনালয়, সরকারি এজেন্সি ঢাকায়, রুট লেভেলের যেইসব মুখপাত্র/অঙ্গ প্রতিষ্ঠান আছে, তারাও স্বয়ংসম্পুর্ন নয়। ফলে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় আসতেই হবে, আর এটাই সত্য।
প্রতিটি কোম্পানির হেড অফিস, বাচ্চা হেড অফিস, ছাপোনা অফিস- সব ঢাকায়। এমনকি ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরিগুলোও ঢাকার চারপাশে। এইসব ইস্যু আমাকে আপনাকে নির্ভরশীল করে তুলছে ঢাকার উপর। ব্যবসায়িরা ব্যবসার জন্যে ঢাকাকে ভাল ভাবছে, আমার চাকুরির সুবিধা বেশী(!) বলে আমি ঢাকায় থাকতে চাচ্ছি, ঢাকায় আমরা সবাই থাকছি বলে থাকার জায়গার চাহিদা বাড়ছে, বাড়িভাড়া বাড়ছে, বাড়ছে নিত্যপণ্য আর কোনরকম চলার খরচও।
যেহেতু ঢাকায় আমাকে থাকতেই হচ্ছে তথাকথিত উন্নত জীবনযাপনের জন্য, তাই কর্মসংস্থানও প্রয়োজন। হয় চাকরী করো, নয়তো ব্যবসা করো। দ্বিতীয় উপায়ের দিকে কেউ ঝুঁকতে চাইলে তাকে অগত্যা পিছু ফিরতে হয়। শুধুমাত্র প্রতিযোগিতামূলক এ শহরে ব্যবসা দিয়ে টিকে থাকতে চাইলে অধিক মূলধন প্রয়োজন, ব্যক্তিগত যোগাযোগ ভাল থাকা প্রয়োজন। এসব কোনটার যার নেই, তার জন্য অসম্ভব ব্যবসা করা- তা বলছি না, কিন্তু খুব সহজও না।
ফলে তার কাছে একমাত্র অপশন হচ্ছে প্রথম উপায়টি বেছে নেয়া, অর্থাৎ চাকরি করে টিকে থাকা। প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে এ কথা বলাই বাহুল্য। ১০ হাজার টাকার মাসিক বেতনে চাকরির নোটিশ দেয়া হলেও সেখানে জমা হয় কয়েক হাজার সিভি। যেখানে একটা ভ্যাকেন্সির পেছনে গড়ে ২৫ জন আগ্রহী, সেখানে পচিশ হাজার টাকার শ্রমকে বার হাজার টাকায় মূল্যায়ন করার সুযোগ তৈরী হয় নিয়োগকর্তাদের হাতে। যেখানে শুরুতেই শ্রমের দাম অর্ধেক কমিয়ে ফেলা সম্ভব হয়, সেখানে দুর্দিনে যে নামেমাত্র মূল্য থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক।
উপরের পয়েন্টগুলো খেয়াল করে দেখুন, আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়া নয়, ঢাকার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া। আমাদের অর্থনীতি, নিজেদের আত্নকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা আর পলিসি লেভেলের অদূরদর্শীতা আমাদেরকে দিনে দিনে আরো বেশী ঢাকা-কেন্দ্রিক করে ফেলেছে।
যারা ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছে, তাদেরকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা কিংবা এমন দূর্যোগের দিনে ৪০ কেজি চাল, ১০ কেজি আলুর ত্রান তার সমস্যাকে কমাবে না, বরং বাড়াবে।
বর্তমান আর্থিক টানাপোড়েন থেকে আমাদের শেখা উচিত কীভাবে দেশের পুরো অর্থনৈতিক অবস্থাকে, গ্রামমুখী অর্থনীতিকে উন্নিত করা যায়। যে লোকটি ঢাকা ছেড়ে গেছে, তার উচিত চিন্তা করা কীভাবে নিজের গ্রামের ভিটেকে আয়ের উৎস বানানো যায়। অন্যদিকে সরকারের উচিত এদের জন্যে স্পেশাল স্কিম চালু করা। গ্রামমুখী ফ্যাক্টরি, খামার, কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিশেষ প্রণোদনা, প্রথম পাঁচ বছরে ট্যাক্স মওকুফ, ফিনান্সিয়াল এবং টেকনিকাল এসিস্টেন্স দেওয়া, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগে গ্রাম আর শহরের পরিমান ৫০/৫০ আবশ্যক করা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে প্রতি বছর বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সিএসআর ফান্ডের যে পরিমান টাকা খরচ করে, তা দিয়ে কয়েক লক্ষ মানুষের বাড়িতে ৪টি গরুর খামার করে দেওয়া সম্ভব, সরকারের উচিত এই ফান্ডের পুরোটুকু আগামী কয়েকবছর এই গ্রামমুখী অর্থনীতির উন্নয়নে খরচ হওয়াটা নিশ্চিত করা। অধিকাংশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তাদের সিএসআর ফান্ড 'সামাজিক কর্ম' এর আড়ালে নিজেদের ব্র্যান্ড অ্যাওয়ারনেসের কাজে খরচ করে। এই সময়টাতে তাই তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে।
এই করোনায় কেউ বাড়ি ভাড়া না দিতে পেরে শহর ছেড়ে দিতে চাইলে তাকে দশ হাজার টাকা দান করে শহরে থাকার জন্যে উৎসাহিত করবেন না, তাকে দশ হাজার টাকায় সবজীর খামার করার বুদ্ধিটি দিন, তাকে বোঝান সাময়িক সমাধান কোনো সমাধান নয়। সমাধান টানতে হবে নিজেকে। নিজের মনকে বোঝাতে হবে, চীনের মানুষ প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসে আইফোনের প্রতিটি মডেল প্রিবুক করতে পারলে আপনিও পারবেন। কিছুদিন পরিশ্রম হবে হয়ত, তবে এতেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। সবাইকে বিশ্বাস করতেই হবে- “এই দিন দিন নয়, আরো দিন আছে, এই দিনেরে নিব আমরা, সেই দিনেরই কাছে'।
আরও পড়ুন- ভুল এই শহরের মধ্যবিত্তদেরও ছিল!
*
প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে 'এগিয়ে চলো'তে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
যোগ দিন এগিয়ে চলো বাংলাদেশ ফেসবুক গ্রুপে