দেবাশীষের বাবা আর সন্তান, দুজনই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্ত তিনি কাজ থেকে বিরতি নেননি। দুই মাস ধরে পরিবার থেকে আলাদা থাকছেন, ৭১৪টি নমুনা পরীক্ষা করার পরে নিজেই আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়...

পেশায় তিনি ল্যাব টেকনোলজিস্ট। এই মুহূর্তে তার কাজ করোনার উপসর্গ থাকা রোগীদের দেহ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা। দেবাশীষ বড়ুয়া নামের মানুষটা নাওয়া-খাওয়া ভুলে সেই কাজে মত্ত হয়েছেন, পরিবার-পরিজন সব ফেলে পড়ে আছেন রোগীর সেবায়। এ পর্যন্ত প্রায় ৭১৪টি নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি। দেবাশীষের বাবা আর সন্তান করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এই সময়ে, তিনি তাদের পাশেও থাকতে পারেননি দায়িত্ব পালন করবেন বলে। নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে এবার দেবাশীষ নিজেও আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়, ঘাতক ভাইরাসের সঙ্গে লড়ছেন এখন তিনি।

যুদ্ধটা শুরু হলো যেভাবে

দেবাশীষের বাড়ি পটিয়ার জঙ্গলখাইন ইউনিয়নের নাইখাইন গ্রামে। ২০০৪ সালে তিনি মেডিকেল টেকনোলজিস্ট হিসেবে টেকনাফ উপজেলায় যোগ দেন। এরপর বিভিন্ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করে ২০১৩ সাসে আসেন নিজের এলাকা পটিয়ায়। ল্যাবে দীর্ঘদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল। তবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষার ব্যাপারটি তিনি শিখেছেন ভিডিও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে  তাও মাত্র একদিনে! ইন্টারনেট থেকে নিজের উদ্যোগেই নমুনা সংগ্রহের ব্যপারে খুঁটিনাটি তথ্য জেনে নিয়েছেন দেবাশীষ। এপ্রিল মাসের দুই তারিখে দুজনের নমুনা সংগ্রহের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কাজ। একাই পটিয়া আর কর্ণফুলী- দুই উপজেলার মানুষের নমুনা পরীক্ষা করছেন তিনি! 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

নোঙ্গর তোলো তোলো

নমুনা সংগ্রহের কাজ শুরু করার পর পরিবারের কাছ থেকে আলাদা থাকতে শুরু করেন দেবাশীষ। মা-বাবা, স্ত্রী ও দুই শিশুপুত্র সবাইকে ছেড়ে চলে এলেন হাসপাতালের কোয়ার্টারে। শুরুর দিকে হাসপাতালে অনেক সহকর্মী দেবাশীষকে দেখলে দূরে চলে যেতেন। কেউ দরজা বন্ধ করে দিতেন। কখনও টাকা দিয়ে মানুষ ঠিক করে সাপ্তাহিক বাজার করতে হয়েছে। কিন্ত দেবাশীষ তাতে দমে যাননি, হতাশ হননি। রোগীর চাপ বেড়েছে, কখনো দেবাশীষ বিরক্ত বোধ করেননি। কাজে কোনো অবহেলা ছিল না তার।

আক্রান্ত প্রিয়জন! 

গত দেড় মাসে তিনি বাসায় যাননি, থেকেছেন হাসপাতালের পাশে কোয়ার্টারে। এ কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ইপিআই টেকনোলজিস্ট রবিউল হোসেন। গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত পটিয়ায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ২১০ জন। এদের মধ্যে দেবাশীষের নিজের বাবা আর একমাত্র সন্তানও আছে, তাদের নমুনাও দেবাশীষই পরীক্ষা করেছেন। মনে ভয় জন্ম নিয়েছে, আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে প্রিয়জনের দুশ্চিন্তায়, তবে সেসবকে একপাশে সরিয়ে রেখে দেবাশীষ নিজের কাজটা করে গেছেন, দায়িত্বে অবহেলা করেননি একচুলও। 

দেবাশীষের কথা

করোনাকালে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেবাশীষ বলছিলেন- "গত ২ এপ্রিল থেকে গত ১০ জুন পর্যন্ত পটিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে সন্দেহভাজন ৭১৪ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছি। মনের মধ্যে কোন দ্বিধা, ভয়-ভীতি ছিল না। গত আড়াই মাসে এক দিনের জন্যও ছুটি নিতে পারিনি। নিয়ম অনুযায়ী ১৪ দিন দায়িত্ব পালনের পর ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা। কাজের চাপে সে সুযোগও পাইনি। কারণ আমি কোয়ারেন্টাইনে থেকে কাজ বন্ধ করে দিলে পুরো এলাকায় নমুনা পরীক্ষা প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে।" 

দেবাশীষ বড়ুয়া

নিজেই যখন আক্রান্ত

গত দুইদিন ধরে জ্বর ও সর্দি-কাশিতে ভুগছিলেন দেবাশীষ। করোনায় আক্রান্ত রোগীদের নিয়ে তার কাজ, সুতরাং করোনার লক্ষণ হিসেবে ধরে নিয়েই নিজের নমুনা পরীক্ষা নিজেই করেছেন দেবাশীষ, তারপর সেই নমুনা পাঠিয়েছেন ফৌজদারহাট বিআইটিআইডির ল্যাবে। বৃহস্পতিবার বিআইটিআইডি'তে নমুনা পরীক্ষায় দেবাশীষের দেহে করোনা জীবানু পাওয়া গেছে। দীর্ঘ দুই মাস ধরে দেবাশীষ যে অসম্ভব এক যুদ্ধে লড়ছেন, প্রায় একা- সেখানে খানিকটা বিরতি পড়লো এবার। 

আমাদের কথা: 

করোনাকালে ডাক্তার-নার্স বা পুলিশের অবদান নিয়ে যতটা আলোচনা হচ্ছে, তার এক পার্সেন্ট আলোচনাও কোথাও ল্যাব টেকনোলজিস্টদের নিয়ে হতে দেখেছেন? কেউ তাদের করোনাযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেনি, আবেগি গল্প লেখা হয়নি এই মানুষগুলোকে নিয়ে। অথচ ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র কিন্ত তারাও! করোনা রোগীর সংস্পর্শে সবার আগে তারাই আসেন, তারা ঝুঁকি নিয়ে নমুনা সংগ্রহ না করলে করোনা হয়েছে কি হয়নি, সেটাই তো জানা যাবে না। 

দেবাশীষ বড়ুয়ার মতো আরও অজস্র মানুষ হয়তো আছেন, পরিবার পরিজন ছেড়ে যারা এই দুঃসময়ে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন একমনে। তাদের আপনজন আক্রান্ত হচ্ছেন, তবু তাদের বিকার নেই, নিজেরা করোনার কোপানলে পড়ছেন, তবুও তারা ভাবছেন কিভাবে সুস্থ হয়ে আবার কাজে নামবেন সেটা নিয়ে। এই মানুষগুলো স্বীকৃতি চান না, পুরস্কার চান না, চান শুধু খানিকটা সম্মান, সেটা নিয়েই প্রচারের আলোর বাইরে থেকে কাজ করে যেতে আপত্তি নেই তাদের। এমন যোদ্ধারা আছেন বলেই তো আমরা এখনও করোনার বিরুদ্ধে জয়ের স্বপ্ন দেখি...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা