এত টাকার শ্রাদ্ধ, শ্রমের শ্রাদ্ধ, আমাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা- সবকিছুর ফলাফল যদি হয় এমন বিতর্কিত নির্বাচন, তাহলে এই প্রশ্নটা তো আমি করতেই পারি- সত্তরের চেয়েও সুষ্ঠু 'নির্বাচন' নামের এই কৌতুকের কী দরকার ছিল মাননীয় স্পিকার?

সত্তরের নির্বাচনকে ধরা হয় এদেশের ইতিহাসের গতিপথ পাল্টে দেয়া একটা নির্বাচন। স্বাধিকারের সংগ্রামে লিপ্ত বাঙালি ব্যালটের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে নিজেদের রায় জানিয়েছিল সেবছর, দলে দলে সবাই ভোট দিয়েছিল শেখ মুজিবের নৌকায়। পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ একাই জিতেছিল ১৬২টি আসন। এই ভূমিধ্বস বিজয় মেনে নিতে পারেনি পশ্চিম পাকিস্তান, ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি ইয়াহিয়া। 

তবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের কথা শুনলে মনে হবে, আজকে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন বুঝি সত্তরের নির্বাচনের চেয়েও বেশি সুষ্ঠু আর উৎসবমুখর হয়েছে! হানিফ বলেছেন- ‘বাংলাদেশে ১০০ বছরের নির্বাচনের ইতিহাসে এমন অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন আর কখনও দেখা যায়নি।’ এই কথা শুনে আগামী দেড় দিন কেউ পাগল থাকার সিদ্ধান্ত নিলে দায় অবশ্যই কারো ঘাড়ে বর্তাবে না। 

সকাল পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। অনেককেই দেখেছি, ভোট দিয়ে এসে ফেসবুকে ছবি বা পোস্টের মাধ্যমে জানাচ্ছেন। ব্যাপারটা আসলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। এখানে ভোটের দিন গণ্ডগোল হবে, কেন্দ্র দখল হবে, ভোটারদের বলা হবে আপনাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে, কিন্ত সেসবের নজির কোথায়? প্রচারণার সময়টায় যে পরিমাণ নির্বাচনী হাউকাউ সহ্য করেছি, ভোটের দিন তার কিছুই কি দেখা যাবে না? বাংলাদেশ কি উত্তর কোরিয়া হয়ে গেছে নাকি, যে ভোটের দিনে একটু হইচই হবে না! 

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিরাচরিত ধারায় প্রবেশ করা শুরু করলো ভোটের আবহাওয়া। ইভিএমের ভোট দিতে দেয়া হয়নি অনেককেই, পর্দাঘেরা জায়গা, যেখানে ভোটার ছাড়া অন্য কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ, সেখানটা দখল করে রেখেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা। ভোটারদের তারা কষ্ট করতে দেয়নি, নিজেরাই বাটন টিপে ভোট দিয়ে দিয়েছে। ভোটারের কর্তব্য শুধু আঙুলের ছাপ দেয়া, বাকী কষ্ট ওই কর্মীরাই করে দিয়েছে। এই না হলে সোনার বাংলা! তাতে কী? মাহবুব উল আলম হানিফ তো বলেছেন, গত একশো বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে আজকে! 

প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভোট দিতে গিয়েছেন, আধঘন্টা চেষ্টার পরেও তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট মেলানো গেল না! এই হচ্ছে আমাদের প্রযুক্তি! শেষমেশ বেচারা বাধ্য হলেন ন্যাশনাল আইডি কার্ডের মাধ্যমে ভোট দিতে। আরও মজার ঘটনা ঘটলো অ্যাডভোকেট কামাল হোসেনের বেলায়। তিনি কয়েকবার মেশিনে আঙুল চাপলেন, কাজ হলো না। তারপর এক সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার আঙুল ছোঁয়ালেন মেশিনে, সঙ্গে সঙ্গে কামাল হোসেনের ছবি ভেসে উঠলো পর্দায়! ড. কামালের সঙ্গে ওই নারী প্রিজাইডিং অফিসারের আঙুলের ছাপ কি করে মিলে গেল, এই সায়েন্স শাকিব খানও ব্যাখ্যা করতে পারবেন না নিশ্চিত!

ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে এবং লাইভে এসে কয়েকজন অভিযোগ করেছেন, ভোটকেন্দ্রে ঢুকলেও নিজেদের ভোটাধিকার তারা প্রয়োগ করতে পারেননি, জোর করে ইভিএমের বাটন প্রেস করে দিয়েছে অন্য কেউ। এসব ঠুনকো অভিযোগকে গোনায় ধরার কিছু নেই, কারণ নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন, 'ইভিএম ব্যবহার করায় আগের রাতে ব্যালট বাক্স ভর্তি করার কোন সুযোগ ছিল না। রাতে ব্যালট পেপারে বাক্স ভর্তি ও কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার অপবাদ থেজে আমরা মুক্ত!' 

অর্থাৎ তিনি মেনে নিচ্ছেন যে, আগের নির্বাচনগুলোতে 'ভোররাতে ব্যালট বাক্স পূরণ করার' যে অভিযোগ এসেছিল, সেগুলো আসলে ভিত্তিহীন ছিল না। আর রাতে ডাকাতি করার সুযোগ না থাকলেও, দিনে যে প্রকাশ্যে চুরি-চামারি হয়েছে অনেক কেন্দ্রে, ভোটারদের সঙ্গে জোর-জবরদস্তি করা হয়েছে, সেটা তারা দেখেও না দেখার ভান করে থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

ভোটারের উপস্থিতি কম ছিল, কে যাবে ছুটির দিনে এত হাঙ্গামা করতে? পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, সবাই বাসায় বসে আরামে পোলাও-বিরিয়ানী খাচ্ছে বলেই ভোটারের উপস্থিতি কম। একজন বলেছেন ইয়াং জেনারেশন বেলা করে ঘুমায় বলেই নাকি ভোটার উপস্থিতি কম! ইয়াং জেনারেশনের যে প্রতিনিধি জিগাতলা কেন্দ্রে গিয়ে নিজের ভোটটা নিজে দিতে না পেরে ফিরে এলো, তার কথা কিন্ত নির্বাচন কমিশন মনে রাখেনি! সবচেয়ে সরেস মন্তব্য করেছেন উত্তরের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম, তিনি বলেছেন- উন্নত দেশগুলোতে মানুষের ভোট দেওয়ার হার কম থাকে। বাংলাদেশও উন্নতির দিকে যাচ্ছে তার প্রমাণ হলো ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া। একের পর এক ফর্মূলার ঠেলায় আসলেই দাঁড়ানো যাচ্ছে না!

এক কেন্দ্র থেকে বিএনপির এজেন্টদের বের করে দেয়া হয়েছে, নারী এজেন্টদের 'ধর্ষণের' হুমকি দেয়া হয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে। সংবাদমাধ্যমে এই খবর এসেছে, মাহবুব তালুকদারের কানে সম্ভবত সেটা যায়নি। তাই তিনি উল্টো সরকার দলের নেতাদের ভাষায় বলেছেন- 'ভোটের মাঠে এক পক্ষ ব্যতীত অন্য পক্ষগুলোকে দেখা যায়নি। অন্য পক্ষগুলোর অনুপস্থিতির কারণ আমার অজ্ঞাত।' চোখে টিনের চশমা পরে থাকলে কারণ সারাজীবনই অজ্ঞাত থেকে যাবে স্যার, যে দেশে নারী এজেন্টকে ধর্ষনের হুমকি দেখিয়ে ভোট কেন্দ্র থেকে বের করা হয়, সেখানে 'অন্য পক্ষ' আর টিকে থাকে কি করে?

অস্ত্র নিয়ে শো-ডাউনের ছবি তুলতে গিয়ে এক সাংবাদিক আহত হয়েছেন, তার রক্তাক্ত দেহের ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। হানিফ দোষ চাপিয়েছেন বিএনপির ঘাড়ে, আর ইলেকশন কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন- বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচনে কোন মারামারি বা রক্তক্ষয় হয়নি। আমার শুধু জিজ্ঞাসা, আহত ওই সাংবাদিকের রক্তকে কি ইলেকশন কমিশনার রক্ত মবে করেন না? সেটা কি টমেটো ক্যাচাপ ছিল?

নির্বাচনী প্রচারণার পুরো সময়টায় আমার বাসার নিচে একটা মাইক লাগানো ছিল। সকাল নয়টা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত সেখানে এক প্রার্থীর গুণগান গাওয়া হতো, ভোট চাওয়া হতো। বিরক্তি সীমা ছাড়িয়ে গেলেও দিন গুনছিলাম শুধু ভোটের দিনটার জন্যে। শহরের আকাশ ঢেকে গিয়েছিল ব্যানার-ফেস্টুনে, রাস্তাঘাটে মিছিল বের করে যানজট বাঁধিয়েছে প্রার্থীরা। এত টাকার শ্রাদ্ধ, শ্রমের শ্রাদ্ধ, আমাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা- সবকিছুর ফলাফল যদি হয় এমন প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, তাহলে এই প্রশ্নটা তো আমি করতেই পারি- সত্তরের চেয়েও সুষ্ঠু 'নির্বাচন' নামের এই কৌতুকের কী দরকার ছিল মাননীয় স্পিকার? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা