শতবর্ষের ইতিহাসে, দৌলতদিয়ার পতিতাপল্লীতে এই প্রথম কোনো যৌনকর্মীর জানাজা হয়েছে। শুধু যৌনকর্মী নয়, যেকোনো মানুষেরই রয়েছে যথাযথ সৎকার পাবার অধিকার।
পৃথিবীর অন্যতম আদিম ব্যবসা বলা হয় এটিকে। সাধারণত কেউ শখে এই পেশায় আসে না। অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়, কিংবা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শিকার হয়ে এ পথে পা বাড়ায়। এদের অনেকের জন্মই হয় যৌনপল্লীতে। এ দেশের সর্ববৃহৎ পতিতাপল্লী রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়ার ৫নং ওয়ার্ডে, যেটি দৌলতদিয়া পতিতাপল্লী বা যৌনপল্লী নামে অত্যধিক পরিচিত।
পতিতাপল্লীর বাসিন্দারা মনে করেন, যৌনকর্ম একটি পেশা এবং এখানকার নারীরা এই পেশা ছেড়ে অন্য কিছু করতে চান না। এখানকার নারীরা তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছেন। কারণ যৌনকর্মী হলেও তারা মানুষ। পতিতা কিংবা যৌনকর্মী হিসেবে এই পল্লীর বাসিন্দারা পরিচয় দিতে নারাজ।
গত ২ ফেব্রুয়ারি, দৌলতদিয়ার পতিতাপল্লীতে হামিদা বেগম নামের এক যৌনকর্মী মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর ইসলামি বিধান মোতাবেক জানাজা সম্পন্ন হয়। জানাজা শেষে তার লাশ ইসলামি বিধান মোতাবেক দাফনও করা হয়েছে। দৌলতদিয়ার শতবর্ষের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো যৌনকর্মীর জানাজা সম্পন্ন হলো। শুধু তা-ই নয়, ৬ ফেব্রুয়ারি হামিদা বেগমের কুলখানির আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেয় স্থানীয় আমজনতা। এবং এ বিষয়টি নিয়ে পতিতাপল্লীর যৌনকর্মীদের আবেগে আপ্লুত হতে দেখা যায়। ভবিষ্যতে তারা নিজেরাও এমন শেষকৃত্যের আশা করছেন।
সম্পূর্ণ এ ব্যাপারটি যার সহায়তায় হয়েছে তিনি হচ্ছেন গোয়ালন্দ পুলিশ স্টেশনের প্রধান আশিকুর রহমান। তিনি স্থানীয় ইমামকে অনুরোধ করেন হামিদা বেগমের জানাজার পড়ানোর জন্য। ইমাম সাহেবকে যখন জিজ্ঞাসা করা, ইসলামে একজন যৌনকর্মীর জানাজার অনুমতি আছে কিনা তখন শ্রদ্ধেয় ইমামের কাছেও এর উত্তর ছিলো না। এবং এই জানাজার উদ্যোগে ঢাকা বিভাগের পুলিশের ডিআইজি সাহেবের সহযোগিতা ছিলো।
এই অসাধারণ উদ্যোগের কারণেই যৌনকর্মীদের লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলা কিংবা পানিতে ভাসিয়ে দেবার মতো শতবর্ষী বর্বর প্রথা ভেঙ্গে জানাজার ব্যবস্থা করা গিয়েছে। স্থানীয় ইমামের পরিচালনায় এবং সাধারণ জনতার উপস্থিতিতে এ জানাজা সম্পন্ন হয়ে। দুইশো মানুষের বেশি উপস্থিত হয়েছে এ জানাজায়, কুলখানিতে উপস্থিত ছিলো তারও দ্বিগুণ মানুষ। সম্পূর্ণ ব্যাপারটিই প্রচন্ড প্রশংসার দাবিদার। সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ না জানালেই নয়।
বাংলাদেশে অনুমোদিত কয়েকটি পতিতালয়ের মধ্যে দৌলতদিয়া পতিতালয় একটি। ১৯৮৮ সালের দিকে এটি প্রতিষ্ঠিত বলা হলেও উক্ত স্থানে বহুকাল আগে থেকেই পতিতাবৃত্তির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা বসবাস করতেন এবং অনুমোদিত ও অবৈধ পতিতালয় হিসেবে বেআইনি ভাবে কার্যক্রম চালিয়ে আসছিলো। বর্তমানে এখানে দাপ্তরিক হিসেবে প্রায় দেড় হাজার যৌনকর্মী বসবাস করেন এবং প্রতিদিন প্রায় ২০০০ থেকে ৩০০০ জন ব্যক্তি এখানে যৌনসেবা নিতে আসেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ হচ্ছে খুব কম সংখ্যক মুসলিম দেশের একটি যেখানে ১৮ বছর বয়স থেকে পতিতাবৃত্তি আইনগতভাবে বৈধ।
এই যৌনকর্মীদের কাছে যারা যায় তারা যদি জানাজা এবং দাফন পায় তবে যৌনকর্মীরা কেন পাবে না? তারাও তো মানুষ, সেসব অধিকার তাদেরও প্রাপ্য যা বাকিরা পাচ্ছে। শুধুমাত্র পেশাগত দিকের কথা বিবেচনা করে তাদের সাথে অমানবিক আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। তাদের প্রতি যে বাজে মনোভাব আমরা পোষণ করি সেটা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। একজন মানুষের যে সম্মান প্রাপ্য সেটাই যৌনকর্মীদের পাওয়া উচিত। তাদেরও রয়েছে সাধারণ জীবনযাপনের অধিকার।
সম্পূর্ণ ঘটনাটি গোয়ালন্দ পুলিশ প্রধান আশকুর রহমান খুব চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ইমাম সাহেব যখন পতিতাপল্লীর ভিতরে আসতে চাচ্ছিলেন না তখন তাকে বললাম জানাজার আবার ভিতর বাহির কী আছে? জানাজা তো জানাজাই। যিনি চলে গেছেন তার পাপ-পূণ্যের বিচার তো আমরা করতে পারি না। সেই বিচার করবেন বিধাতা।’