সবাই তাকে ভয় পায়, তার নামে বাঘে-মহিষে এক ঘাটে জলও খায়। এফবিআই আর ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল লিস্টে তার নামটা সবসময় একদম ওপরের দিকেই থাকে। যুগের পর যুগ ধরে ভারতের গুপ্তচর সংস্থা ‘র’ হন্যে হয়ে খুঁজেছে তাকে, হাজারো নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া এই ঘৃণ্য খুনীকে আইনের আওতায় আনতে বেছে নিতে হয়েছে কত বেআইনী রাস্তা! শোনা যায় সে অমুক জায়গায় আছে, তমুক জায়গায় আছে, অথচ তার খোঁজে সেখানে হানা দিলে লোকটার চুলের নাগালও পাওয়া যায় না।

নাম তার দাউদ ইব্রাহিম, ভারত থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের আন্ডারগ্রাউন্ডের অবিসংবাদিত ঈশ্বর; ‘ডন’ শব্দটা যার নামের পাশে সবচেয়ে মানানসই!  ১৯৫৫ সালে মুম্বাইয়ের ডংরি এলাকায় জন্ম, বাবা ইব্রাহিম কসকর ছিলেন অত্যন্ত সৎ ও নিষ্ঠাবান একজন পুলিশ কনস্টেবল। ভীষণ ধর্মভীরুও ছিলেন তিনি, নবী দাউদ (আ) এর নামে ছেলের নাম রেখেছিলেন তিনি, ভেবেছিলেন ছেলে বিখ্যাত কেউ হবে। সেটা দাউদ হয়েছে, নিজের অপরাধমূলক কাণ্ডকীর্তিতে জগদ্বিখ্যাত নয়, কুখ্যাতই হয়েছে সে। পুলিশ বাবার ঘরে জন্ম নিয়ে অপরাধ জগতের হোতা বনে যাওয়া- সিনেমাকে হার মানিয়ে দেয়া চিত্রনাট্য দাউদের জীবনের! 

অপরাধের সঙ্গে বসবাসের শুরুটা একদম কৈশোর থেকেই, মুম্বাই রেলস্টেশনে এক লোকের টাকা ছিনতাইয়ের মধ্যে দিয়ে এই পথে হাঁটা। বাবা শুনে ভীষণ মারলেন, কিন্ত বাবার কঠিন মার বা শাসন কোনকিছুই তাকে ফেরাতে পারেনি অন্ধকার জগতের হাতছানি থেকে। বড় ভাই শাবির ইব্রাহিমের হাত ধরে এই জগতে প্রবেশ; মুম্বাইয়ের প্রথম মাফিয়া সুপারস্টার হাজী মাস্তানের দলের হয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে দাউদের হাতেখড়ি, নিজের প্রতিভাতেই মাস্তানের কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন অল্প ক’বছরে। আবার অনেকে বলেন সেই সময়ের মুম্বাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরেক হোতা করিম লালার হয়েও কাজ করেছিল দাউদ।

আফগানিস্তান থেকে আসা পাঠান গ্যাঙের সঙ্গে তখন দাউদের দলের লোকেদের প্রায়ই ঝামেলা হয়। পাঠানদের ভাড়া করা গ্যাংস্টার মানিয়া সুরভের হাতে খুন হলো দাউদের ভাই সাবির ইব্রাহিম কাসকার। দাউদ নামলো সেই খুনের বদলা নিতে, মুম্বাই সাক্ষী হলো ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী গ্যাংস্টার ফাইটের। পাঠান আর সুরভে গ্যাঙের প্রায় সব সদস্যকে দাউদ মুম্বাইছাড়া করেছিল, প্রাণ বাঁচাতে তাদের কেউ কেউ যোগ দিয়েছিল দাউদের দলে। পুলিশকে প্রচুর টাকা খাইয়ে মানিয়ে সুরভেকে এনকাউন্টারে হত্যা করায় দাউদ।

দাউদ ইব্রাহিমের গুরু হাজী মাস্তান

আশির দশকে তার গুরু হাজী মাস্তান রাজনীতিতে যোগ দিলে ফাঁকা ময়দানটা দখল করলো সে। আন্ডারওয়ার্ল্ডে আগে থেকেই দাউদের ভালো প্রভাব ছিল, পাঠান গ্যাঙের সাথে টক্করের পর তো তাকে দারুণ সমীহ করতো সবাই। এবার শুরু হলো ত্রাসের খেলা। মুম্বাইতে দুই নম্বরী কিছু করলে সেটা দাউদের অনুমতি নিয়েই করতে হবে, নইলে কখন যে বুকে বুলেট এসে বিঁধবে, কিংবা ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে যাবে সেটা দাউদ ছাড়া কেউ জানবেও না!

আশির দশকের শেষদিকে মুম্বাইতে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হলো, আঁতিপাঁতি গুণ্ডা থেকে রাঘব বোয়াল সবাই ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়তে লাগলো পুলিশের জালে। অবস্থা বুঝে ভারত ছাড়লো দাউদ, পাড়ি দিলো মাফিয়াদের অভয়ারণ্য দুবাইতে। সেখান থেকেই ভারতের অপরাধজগত নিয়ন্ত্রন করতে থাকলো সে। সেই সঙ্গে ব্যবসাও শুরু করলো, মুম্বাইয়ের আন্ডারওয়ার্ল্ড থেকে টাকাপয়সা প্রচুর হাতিয়েছে সে। শিপিং, এয়ারলাইন্স কিংবা রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, প্রতিটা জায়গাতে টাকা খাটিয়েছে সে, তুলে নিয়েছে মুনাফা। ফুলেফেঁপে উঠেছে তার ব্যাংক ব্যালেন্স।

এরপর তার নজর পড়েছে ক্রিকেটে, ভারত-পাকিস্তান আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের অনেক খেলোয়াড়ের সঙ্গেই সুসম্পর্ক ছিল তার, দাউদের হয়ে ম্যাচে ফিক্সিং করেছেন অনেক ক্রিকেটারই। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউবা বাধ্য হয়ে। বলিউডেও ভালোই প্রভাব ছিল তার। দুবাইতে থেকেও মুম্বাই কিংবা ভারতের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ হারায়নি সে, এর মূল কৃতিত্ব তার ডানহাত ছোটা শাকিল এবং দাউদের আপন ছোট বোন হাসিনা পারকারের।

কথিত আছে, ২০০৩ পর্যন্ত দাউদের অবর্তমানে মুম্বাইয়ের অপরাধজগত সামলেছিলেন হাসিনা! দাউদের গড়া দল ‘ডি-কোম্পানী’র প্রায় পাঁচ হাজার সক্রিয় সদস্য ছিল সেই সময়ে। ভারতে হত্যা, গুম, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, হুন্ডি ব্যবসাসহ সব কিছুরই নিয়ন্ত্রণ ছিল এদের হাতে, দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে ডি কোম্পানী।

দাউদ ইব্রাহিম ও বোন হাসিনা পারকার

১৯৯৩ সালে মুম্বাই স্টক এক্সচেন্সে সিরিজ বোমা হামলায় নিহত হয় তিনশোরও বেশী মানুষ, আদালতে প্রমাণ হয় এর পেছনে প্রত্যক্ষভাবে দাউদের হাত ছিল। দাউদ তখন ভারতে সবচেয়ে বড় অবৈধ আর্মস ডিলার, হেরোইন/মারিজুয়ানার মতো ড্রাগের সাপ্লাইয়ারও সে। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে সবাইকে জানানোর জন্যেই এতগুলো নিরপরাধ মানুষের রক্তে মুম্বাই শহরটাকে রঞ্জিত করেছিল এই বিকৃতমনস্ক খুনী।

২০০৮ এর মুম্বাই অ্যাটাকেও দাউদের হাত ছিল বলে অনেক নিরাপত্তা বিশ্লেষকের ধারণা। ইন্টারপোলের মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্টে ২০১১ সালে তার নাম ছিল তিন নম্বরে। শাহরুখ খান অভিনীত ‘ডন’ সিনেমায় একটা ডায়লগ ছিল- “ডন কো পাকাড়না মুশকিল হি নেহি, না মুমকিন হ্যায়”... দাউদের বেলায় এই কথাটা একদম সার্থকভাবে মিলে যায়। সবাই জানে দাউদ আছে, এফবিআই-ইন্টারপোল কিংবা ভারতের ‘র’ জানে দাউদের অবস্থান, কিন্ত তাকে ধরা যায় না, ছোঁয়াও যায় না। এত অপরাধ করেও দাউদ থেকে যায় সবার নাগালের বাইরে!

পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা ‘আইএসআই’য়ের প্রত্যক্ষ্য মদদে চলে দাউদ, পাকিস্তানে এই খুনীর রয়েছে সেফ হোম। দাউদ অসুস্থ হলে পাকিস্তানের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে তার চিকিৎসা করানো হয়, অথচ নির্লজ্জ এই রাষ্ট্রটি এসব কথা অস্বীকার করে বরাবরই। দাউদের মেয়ে মাহরুখ ইব্রাহিমের বিয়ে হয়েছিল পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার জাভেদ মিয়াদাদের ছেলে জুনাইদ মিয়াদাদের সঙ্গে, এই বিয়েতে ইন্টারপোল আর এফবিআইয়ের তীক্ষ্ণ নজরদারী ছিল। সবাই জানতো দাউদ অবশ্যই আসবেন এখানে। সক্রিয় ছিল তাদের দুইশোর বেশী এজেন্টও। কিন্ত সবার অগোচরে দাউদ এসে মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে আংটি পরিয়ে চলে গিয়েছিল, তার নাগালে ঘেঁষা তো দূরের কথা, দাউদ এসেছে এমন খবরটাও সঙ্গে সঙ্গে পায়নি এদের কেউ!

বলিউডের অনেক সিনেমায় দাউদ নামে বেনামে অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন বলে শোনা যায়। সালমান খানের শুরুর দিককার বলে একটি সিনেমা ‘চোরি চোরি চুপকে চুপকে’ দাউদের প্রযোজনায় নির্মিত হয়েছিল বলে গুজব আছে। বলিউডের অনেক নায়িকার সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতার গুজবও শোনা গেছে নানা সময়ে। 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে'(২০০৪), 'ডি'(২০০৫), 'শুটআওট অ্যাট লোখান্ডওয়ালা'(২০০৭), 'ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন মুম্বাই'(২০১০), 'শুটআউট অ্যাট ওয়াদালা'(২০১৩) ইত্যাদি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে দাউদের ঘটনাবলী নিয়ে। ভারত-পাকিস্তানে অনেক ভক্তও আছে তার। তবে সবকিছু ছাপিয়ে দাউদ ইব্রাহিম এক ঘৃণ্য খুনীর নাম, যার হাতে লেগে আছে শত শত নিরপরাধ মানুষের রক্ত!

তথ্যাসূত্র-

  1. How Dawood Ibrahim became India's most wanted man
  2. Dawood Ibrahim Biography and Life Story

আরও পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা