কর্মীদের জন্যে বরাবরই ড্যান প্রাইস ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ এক বস। কিন্তু সেই কর্মীদেরই একজন যখন 'কম বেতন দেয়া'র অভিযোগ আনলেন প্রাইসের বিরুদ্ধে, প্রাইস ধাক্কা খেলেন। এরপর তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিলেন, যা পালটে দিলো আমেরিকার আইডিয়াল বিজনেস মডেলকেই!

কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি নিয়ে পড়াশোনা করছিলাম বেশ কিছুদিন ধরে। এই বিষয়টি নিয়ে আগে অতটা কথাবার্তা না হলেও ইদানীং বেশ জোরেসোরেই কথাবার্তা হচ্ছে। যদি সোজা বাংলায় বিশ্লেষণ করা হয়, কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসেবলিটি বলতে যা বোঝায় তা হচ্ছে, ধরুন আপনি একটি কোম্পানির মালিক। কোম্পানির একটাই উদ্দেশ্য- লাভ করা। অবশ্য এটা আলাদা করে বলারও কিছু নেই। সবাই কোম্পানি/ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে লাভ করার জন্যেই।

কিন্তু লাভ করার পাশাপাশি আপনাকে এই জিনিসটিও মাথায় রাখতে হবে- আপনার প্রতিষ্ঠানের যে সব শ্রমিকেরা এভাবে মেহনত করে আপনাকে লাভ পাইয়ে দিচ্ছে, তাদেরকে যেকোনো একটা বেতন দিলেই আপনার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। আপনার শ্রমিকদের পর্যাপ্ত বেতন, সামাজিক বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা: মেডিকেল হেল্প, এডুকেশনাল হেল্প রিক্রিয়েশনাল হেল্প... এগুলো নিশ্চিত করাও আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এছাড়াও আপনার কোম্পানির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব আছে, তা হচ্ছে- পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে, এমন কাজ করা যাবে না। কোম্পানির কর্তা হিসেবে এসব সামাজিক, পরিবেশগত দায়িত্ব পালনকেই একসাথে বলা হচ্ছে- কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসেবলিটি।

এবার অনেকেরই মনে হতে পারে, যদি কর্মীদের এত সুযোগ সুবিধা, বেতন দেয়া হয়, তাহলে কোম্পানির বেশি লাভ তো হবেই না, অনেক ক্ষেত্রে লাভই হবে না। এই ধারনাটাও ভুল। যদি পৃথিবীর বড় বড় সাকসেসফুল কোম্পানির দিকে তাকাই, দেখতে পাবো- তাদের প্রফিট গেইনের পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে- তাদের শ্রমিকদের আন্তরিক শ্রম। এবং শ্রমিকদের আন্তরিক শ্রম এমনি এমনি নিশ্চিত হয় না। এইসব কোম্পানি তাদের কর্মীদের কথা ভাবে, তাদের কল্যাণের জন্যে নানাবিধ উদ্যোগ নেয়। যারই ফলশ্রুতিতে দেখতে পাই, সাকসেস স্টোরি।

ঠিক এই সংক্রান্ত খুব সুন্দর একটি গল্প ভেসে বেড়াছে অনলাইনেও। ২০১১ সালের ঘটনা। ড্যান প্রাইস নামের এক ব্যক্তি 'গ্রাভিটি পেমেন্টস' নামের একটি কোম্পানির কো-ফাউন্ডার। ঘটনা যখনকার, তখন তিনি এই কোম্পানির সিইও হিসেবেও কাজ করছিলেন। ড্যান প্রাইস একদিন অফিসে গিয়ে দেখতে পেলেন, তার একজন কর্মী জেসন হ্যালি,  টিফিন আওয়ারে মন খারাপ করে বসে আছেন। প্রাইস আগ্রহী  হয়ে গেলেন হ্যালির কাছে। মন খারাপের কারণ কী জিজ্ঞেস করলেন। বিনিময়ে যে উত্তর তিনি পেলেন, তা তিনি একদম আশা করেননি৷ হ্যালি বলছিলেন-

তোমার অফিসে কাজ করে জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে। এই কোম্পানিতে কাজ করে যে বেতন পাই, তা একটা স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্যে মোটেও যথেষ্ট নয়।

প্রাইস একটু ধাক্কামত খেলেন। কারন তিনি সবসময়েই চেষ্টা করে এসেছেন, কর্মীদের কল্যানের জন্যে কাজ করার৷ ব্যবসা করবেন তিনি ঠিক আছে। কিন্তু তা অবশ্যই কর্মীদের উপর জুলুম করে নয়৷ কিন্তু এখন হ্যালি যা বলছেন, তা যদি সত্যি হয়, তাহলে কোম্পানির পলিসি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবার জায়গা অবশ্যই আছে।

পরবর্তী বেশ কিছুদিন প্রাইসের জঘন্য কাটলো। হ্যালির কথাগুলো ভেতরে সুঁচের মত  যন্ত্রণা দিচ্ছিলো। তিনি গর্বভরেই সবসময় বলতেন, তার কোম্পানি, কর্মীদের জন্যে ভাবে৷ কর্মীদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যে কাজ করে। ঠিক সে জায়গাতেই ধাক্কা দিয়েছে হ্যালি। প্রাইস অনেক চিন্তাভাবনা করে বুঝতে পারলেন, হ্যালির কথাই ঠিক। নিজের কোম্পানির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে ভাবতে তিনি কর্মীদের দিকে সেভাবে তাকাননি, যেভাবে তাকানো দরকার ছিলো। এরপর তিনি এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিলেন, যে সিদ্ধান্তের অভিনবত্ব নিয়ে এখনও কথা হয়। এটা এরকমই এক সিদ্ধান্ত ছিলো, আমেরিকার বিজনেস মডেলে এরকম সিদ্ধান্ত কেউ এর আগে নেয়নি। তিনি ঘোষণা দিলেন- এখন থেকে তার অফিসের সর্বনিম্ন বেতন হবে ৭০০০০ ডলার। তিনি তার অফিসের ১২০ জন কর্মীর বেতন ৭০০০০ ডলার করলেন। এবং সে সাথে তিনি তার নিজের বেতনও ১.১ মিলিয়ন ডলার থেকে কমিয়ে ৭০০০০ ডলারে নিয়ে এলেন, যাতে করে সবার বেতন ঠিকমত দেয়া নিশ্চিত করা যায়।

এই ঘোষণার ফলাফল হলো মারাত্মক। গোটা আমেরিকাতে এই ঘটনা এক বিস্ময় তৈরী করলো। আমেরিকার বিজনেস মডেলে এরকম 'ইকুয়াল ডিস্ট্রিবিউশন' আগে ছিলো না। সবাই চমকে গেলো প্রাইসের এই সিদ্ধান্তে৷ অনেকে তো এটাও বলে বসলো- গ্রাভিটির লালবাতি জ্বলতে আর বেশি দেরি নেই। তবে যে যাই বলুক, প্রাইসের এই সিদ্ধান্তে চমকিত হয়ে অনেকেই গ্রাভিটিতে কাজ করার ইচ্ছে পোষণ করতে লাগলো। ঘোষণার প্রথম সপ্তাহে প্রায় সাড়ে চার হাজার আবেদনপত্র জমা হলো গ্রাভিটির ওয়েবসাইটে!

তবে সুনামের পাশাপাশি বদনামও কম কুড়ালেন না প্রাইস। তিনি তার বেতন কমিয়ে কর্মীদের বেতন বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ঝামেলায় পড়েন অন্য ব্যবসায়ীরা। তাদের কোম্পানিতেও প্রেশার আসা শুরু করলো কর্মীদের। কোম্পানির মালিকেরা তখন একাট্টা হয়ে প্রাইসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথা শুরু করলেন। এই বিজনেস মডেল বেশিদিন টিকবে না, এটা একরকম ভণ্ডামি, বিজনেস স্টান্ট... নানা কথা বলা হলো। কিন্তু প্রাইস রইলেন তার সিদ্ধান্তে অবিচল। 'বোবার কোনো শত্রু নেই' সূত্র মেনে তিনি রইলেন একদম চুপ। নীরবে কাজ করে যেতে লাগলেন।

ড্যান প্রাইস বরাবরই ভেবেছেন কর্মীদের কথা! 

কর্মীদের বেতনের সুষম বন্টন করতে গিয়ে নিজের সেভিংস এর টাকা তুলতে হলো। বাড়ি মর্টগেজে দিতে হলো। তাও প্রাইস কাজ করতে লাগলেন৷ তার এই সিদ্ধান্ত ও নিরলস ত্যাগে যা হলো, তার কোম্পানির কর্মীদের মধ্যে ১০ শতাংশ নিজেদের জন্যে বাড়ি কিনতে পারলো সিয়াটলে। ৭০ শতাংশ কর্মী তাদের বিভিন্ন ধার পরিশোধ করতে পারলো। অনেকেই পারিবারিক জীবনে সুখী হলো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- গ্রাভিটি'র প্রতি দায়িত্ব তাদের বহুগুণে বেড়ে গেলো। এবং অসাধারণ প্রোডাক্ট বানাতে লাগলেন তারা। ফলে গ্রাভিটির কাস্টমারও বেড়ে গেলো কয়েক গুন।

তবে সবচেয়ে চমৎকার ঘটনাটি ঘটলো মহামারীর এ সময়ে এসে। করোনার প্রকোপে কোম্পানির ফান্ডিং প্রায় শূন্য হয়ে যাওয়ার মতন অবস্থা হয়। অনেকটা 'লালবাতি' জ্বলারই অবস্থায় পৌঁছে যায় প্রাইসের গ্রাভিটি!  চিন্তায় মাথায় চুল ছেঁড়ার অবস্থা প্রাইসের। কোম্পানির যে অবস্থা, খুব অল্পদিনের মধ্যেই কর্মী ছাঁটাইয়ের কাজ শুরু করতে হবে। কিন্তু যাদের এতদিন আগলে রেখেছেন, তাদের কীভাবে ছাঁটাই করবেন তিনি!

কোম্পানির এই অবস্থাটা প্রত্যেক কর্মীই আঁচ করতে পারে। তাদের মধ্য থেকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একজন কর্মী আসেন একটি প্রস্তাব নিয়ে। তার প্রস্তাব অনুযায়ী- প্রত্যেক কর্মী বেনামে একেকটা কাগজে লিখে দেবে, কী পরিমান বেতন ছাঁটাইয়ে তারা কাজ করতে ইচ্ছুক অথবা ইচ্ছুক না। প্রাইসের এই প্রস্তাব খুব একটা ভালো না লাগলেও ভাবলেন, একটা শেষ চেষ্টা করাই যাক।

এরপরে যে ফলাফল তিনি পেলেন, তা আশাতীত। ৯৮ শতাংশ কর্মী বললেন, বেতন ছাঁটাই হলেও তারা কাজ করতে ইচ্ছুক। দশজন কর্মী বললেন, তারা বিনা পয়সাতেও কাজ করতে রাজি৷ অনেকেই জানালেন, বেতন অর্ধেক করে দিলেও তারা কাজ করতে রাজি। মানুষের এই ভালোবাসায় আপ্লুত হলেন প্রাইস। বুঝতে পারলেন, যাদের জন্যে এত ত্যাগ তিনি স্বীকার করেছেন, তারা তার অবদান মোটেও ভোলেনি৷ প্রাইস বেতন কমালেন কর্মীদের৷ তবে খুব অল্প মানুষকেই অর্ধেক বেতন দেয়া হলো। বাকিদের বেতন থেকে দশ শতাংশ, বিশ শতাংশ এভাবে কাটা হলো।

এবং আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, জুলাই মাস নাগাদ 'গ্রাভিটি' আবার দাঁড়িয়ে গেলো। কর্মীদের যে বেতন কাটা হয়েছিলো, তা আবার তাদের ফেরত দেয়া হলো। প্রাইস বুঝিয়ে দিলেন- মানুষকে ভালোবেসে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেখানে কেউ কখনো ঠকেনা।

কর্পোরেট দুনিয়ার যান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যখানেও ড্যান প্রাইসের এই অসাধারণ মুগ্ধতার গল্প এখন ভেসে বেড়াচ্ছে নেট দুনিয়ায় এবং নিন্দুকদের মুখে ছাই দিয়ে 'গ্রাভিটি' এবং ড্যান প্রাইস কাজ করে যাচ্ছেন দোর্দণ্ড প্রতাপে। দোর্দণ্ড প্রতাপ হবে নাই বা কেন, যে কোম্পানির মূলধন 'মানুষের ভালোবাসা', তাদের কে আটকাবে? কীভাবে আটকাবে?

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন



 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা