“প্রয়োজন ও সুবিধার দিকে সঙ্গতি থাকলে বিদেশী পুঁজিকে স্বাগত জানানো হবে, তবে বিনিয়োগের সম্ভাব্যতা ও পরিকল্পনা তৈরি করবে এ দেশের লোকেরা। পুঁজি বিনিয়োগের বদলে আমরা কোন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চাই না।”

মনে হচ্ছে না কোন এক উন্নত দেশের ঝানু এক অর্থনীতিবিদের বাণী! দু লাইনেই বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সরকার ও সাধারণ জনগণের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগকারী গোষ্ঠীকেও সতর্ক করে দেয়া যে, এই দেশের উন্নয়ন করতে আসলে তাদেরও উন্নতি হবে কিন্তু ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য থাকলে বরদাশত করা হবে না। এরকম বক্তব্য তো সচ্ছল কোন দেশের পোড় খাওয়া কোন অর্থনীতিবিদই বলতে পারেন! তাই না? 

না, আপনার ধারণা ভুল। এই ড্যামকেয়ার বক্তব্য দেয়া ড্যামকেয়ার লোকটি তখন সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি ড্যামকেয়ার দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছেন। বিশ্বব্যাংককে তুচ্ছ জ্ঞান করা তাজউদ্দীন আহমদের ভিশন খুব ক্লিয়ার ছিল। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের পায়ে দাঁড় করাতে চান। নয় মাসের একটি যুদ্ধ কেবল ৩০ লাখ শহীদের রক্তই নেয়নি, একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেও ভঙ্গুর করে দিয়েছিল। কিন্তু নয় মাসে যা ভাঙ্গে, সেটি জোড়া তো আর নয় মাসে লাগে না। তিনি খুব দ্রুতই বুঝতে পারলেন যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা তার নিতেই হবে। 

এই ড্যামকেয়ার লোকটি বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন সভাপতি রবার্ট ম্যাকনম্যারার কাছ থেকে যতটুকু সুবিধা নেয়া সম্ভব নিয়ে রাখলেন। রবার্টও তাঁর বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে ক্লিয়ার ভিশন আর ড্যামকেয়ার ভাব দেখে বলেই ফেললেন- “Tajuddin Ahmed is the best finance minister I have ever seen”

বঙ্গবন্ধু এবং তাজউদ্দীন আহমদ   

আরেকটু পিছিয়ে যাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হবার পর তাজউদ্দীন আহমদ ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেন দুরুদুরু বুকে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে সংগঠিত হবার জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহের সাহায্য চাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে তাজউদ্দীন যান ভারতে। কিন্তু সেখানে প্রাথমিকভাবে আশ্বাস আর সমবেদনা ছাড়া কিছু না পাওয়ায় স্বাধীন দেশের সরকার ঘোষণার প্রয়োজন অনুভব করেন তিনি।

ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বৈঠকে তিনি নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রবীণ নেতাকর্মীদের মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি চান ভারতের কাছে। আশ্বাস পেয়ে দেশে এসেই তাজউদ্দীন আহমদ আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার ঘোষণা করেন এবং পরবর্তীতে আবার আমীরুল ইসলামকে নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যান। ড্যামকেয়ার তাজউদ্দীন এবার বিনা প্রোটোকলে ভারতে প্রবেশ করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। একটি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রতিবেশী দেশের আমন্ত্রণ ও প্রোটোকল ছাড়া সে দেশে প্রবেশ করা তাঁর দেশের জন্য অসম্মানজনক হবে বলে তিনি জানিয়ে দেন। এরপর ভারতীয় বাহিনী তাকে ‘গার্ড অফ অনার’ দিয়ে ভারতে নিয়ে যায়।

তাজউদ্দীন আহমদ  

এবার অনেকখানি এগিয়ে যাই... রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন তার দলকে নিয়ে কারাগার থেকে বের হচ্ছিলেন। মাত্রই চার নেতাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়েছে। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন ভেতর থেকে কে যেন মৃদু স্বরে পানি চাচ্ছে। তিনি ভেতরে ঢুকে দেখলেন তাজউদ্দীন আহমদ তখনো জীবিত, ব্রাশফায়ারের গুলি তাকে কাবু করতে পারেনি বরং তৃষ্ণা বাড়িয়ে দিয়েছে। ড্যামকেয়ার তাজউদ্দীন শত্রুর কাছে পানি চাচ্ছেন, জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর তৃষ্ণার কথা, পানি অথবা স্বাধীন-সুন্দর বাংলাদেশ দেখার। বেয়নেটের খোঁচায় যখন তাঁর মৃত্যু হয়, তখন থেকে প্রতিটি বাঙালি কেন তৃষিত হলো না সেটাই আফসোস। প্রতিটি বাঙালি কেন ড্যামকেয়ার হলো না সেটাই আফসোস! 

শুভ জন্মদিন ড্যামকেয়ার তাজউদ্দিন!

-

* প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

* সমাজের নানান অসঙ্গতি নিয়ে আওয়াজ তুলুন। অংশ নিন আমাদের মিছিলে। যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা