লকডাউনের মধ্যে পরিবারের কাছে আসা যখন কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না, তিনবার বিমানের টিকেট কেটেও আসতে পারছেন না দেশে। তখনই তিনি নিয়ে ফেললেন সিদ্ধান্ত। হাতের সাইকেল নিয়ে নেমে এলেন রাস্তায়। যেতে হবে বাড়িতে, বাবা-মা'র কাছে। দূরত্ব কতটুকু? মাত্র ২১৭৫ মাইল!

আমরা বেশ ক'মাস ধরেই গৃহবন্দী। একটানা ঘরে থাকতে থাকতে হাঁপিয়েও উঠেছি বোধহয় সবাই। সারা পৃথিবী জুড়েই একই অবস্থা। যদিও লকডাউন এখন আর নেই এদেশে। তাও সচেতন মানুষ পারতপক্ষে ঘরের বাইরে নামেন না। অনেকটা স্বেচ্ছায় ঘরের মধ্যে বন্দী জীবন কাটছে আমাদের। আমরা ঘরে বসে এ বন্দীদশাকে নানাভাবে সংজ্ঞায়ন করতে পার্রি। কিন্তু তাও এক হিসেবে আমরা বেশ সুখীই। না, এ কথা শুনে প্রথমেই তেড়ে আসবেন না। সুখী এই অর্থে যে অন্তত প্রিয় মানুষগুলোর সাথে এক ছাদের নীচে থাকতে পারছি। ভাবুনতো, লকডাউন শুরুর পর যারা আটকে পড়েছিলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে, তাদের কী অবস্থা হয়েছিলো? কী অনিশ্চতায় কেটেছে তাদের দিন?

এরকমই একজন আটকে পড়া মানুষ ক্লেওন পাপাদিমিত্রি। অ্যাথেন্স এর বাসিন্দা, যিনি আটকে পড়েছিলেন স্কটল্যান্ডে। স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব আবেরডিন এর শিক্ষার্থী তিনি। স্কটল্যাণ্ডে লকডাউন শুরুর পরেই বন্ধ করে দেয়া সব যোগাযোগ। বিমান বন্ধ হয়ে যায়। তিনবার বিমানের টিকেট কেটেও তাই আর পাপাদিমিত্রির বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়া হয়না। ব্যর্থ মনোরথে কাটিয়ে দেন কিছুদিন। এরপরেই ঝোঁকের বশে নিয়ে ফেলেন সিদ্ধান্ত। বাড়ি ফিরবেন। কীভাবে? সাইকেলে চেপে। কিন্তু দূরত্ব? মাত্র ২১৭৫ মাইল !

যাত্রাশুরুর আগে পাপাদিমিত্রি, লটবহর নিয়ে

চে গুয়েভারার কাহিনী নিয়ে নির্মিত 'দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিস' আমরা সবাই দেখেছি। পাপাদিমিত্রি দেখেছে কী না, জানা নেই। তবে সাইকেল, তাবু ও আনুষঙ্গিক কিছু জিনিসপত্র কিনে ঠিকই তিনি এক সকালে দিয়ে দিলেন রওয়ানা। বাবাকে এ্যাপের মাধ্যমে লোকেশন শেয়ার করে দিলেন। দুই চাকায় ভর করে পৃথিবী দেখা শুরু হলো। সাইকেলের প্যাডেলে পা, চোখ শান্ত হয়ে সুদূরে বিস্তৃত। যাত্রা চলছে। পাপাদিমিত্রি নিজেও ভাবেননি তিনি কতদূর যাবেন। গায়ের রক্ত গরম দেখেই কী না, নেমে পড়েছিলেন এই অনিশ্চিত যাত্রায়। কিন্তু শুরু যেহেতু করেছেন, শেষটাও তো করতেই হবে। তাই প্রতিদিনই ৩৫ থেকে ৭৫ কিলোমিটার জার্নি করতে শুরু করলেন। রাত কাটাতেন রাস্তার পাশে তাবু খাটিয়ে। খাবার বলতে সার্ডিন মাছ, পিনাট বাটার, কফি এসব। বড় কোনো শহরে এলে দেখতেন সে শহরে পরিচিত কে আছে। পরিচিত কেউ থাকলে তার বাসায় কিছুক্ষণ থাকতেন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে নিতেন। এভাবেই তিনি ৪৮ দিন ধরে ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ইতালি হয়ে শেষে গ্রিসে এসে পৌঁছান।

যাত্রাবিরতি চলছে

যখন তিনি নিজের বাড়ির পথে চলে এসেছেন, দেখেন- পরিচিত, অপরিচিত অনেক মানুষ রাস্তার দুইপাশে তাকে শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে। কিছুটা কী আপ্লুতও হলেন পাপাদিমিত্রি? জানা নেই। তবে সন্তানের এই অসাধ্যসাধনে বাবা-মা বেশ খুশি। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?

পাপাদিমিত্রি সাত সপ্তাহের এই ট্যুর থেকে শিখেছেন অনেককিছুই। আত্মবিশ্বাস, অটুট মনোবলে ঋদ্ধ হয়েছেন নিশ্চিতভাবেই। এরকম জীবনঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতাই তো মানুষকে পরিপক্ক করে, তাই না? পাপাদিমিত্রির কথা ছাড়ুন। যারা এই লেখাটি নিজের ঘরে থেকেই এখন পড়লেন, নিজেকে একটু সৌভাগ্যবান ভাবতেই পারেন। কারণ আর যাকিছুই হোক না, অন্তত আপনাকে তো ২১৭৫ মাইল পাড়ি দিয়ে ঘরে ফিরতে হয়নি কোনোদিন, তাই না?

তাই নিজের বর্তমান পরিস্থিতিতে নিজে নিজে একটু খুশি হতেই পারেন আপনিও।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা