সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষ যখন কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়, সে একটা সমাধানের পথ বের করে। কখনো কখনো অনেক সমস্যাকেই সুযোগে পরিণত করে এবং সুযোগকে কাজে লাগায়। আবার কখনো এক সমস্যার সমাধানের মাধ্যমে নতুন আরেক সমস্যার জন্ম দেয়। এভাবেই নতুন পরিস্থিতি, নতুন সমস্যা এবং নতুন নতুন সমাধানের চক্রের মাধ্যমে মানুষ সমাজ ও সভ্যতাকে সামনে এগিয়ে নেয়। 

প্রথম শিল্প বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময় লক্ষ্য করলে মানব ইতিহাসে প্রধান যে সমস্যা দেখা যায় তা হল; মানুষের জীবনযাত্রা একটা নির্দিষ্ট এলাকায়, একটা নির্দিষ্ট গোত্রের ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকায় যখনি জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়, খাদ্য উৎপাদন সীমিত হওয়ায় তখনি এক প্রকার খাদ্যসংকট বা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে বিপুল পরিমান জনগোষ্ঠীর প্রাণহানি ঘটে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রিত থাকে। ১৯ শতকের একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাসের নাম অনুসারে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ম্যালথাসিয়ান ট্রাপ। বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিসংখ্যান লক্ষ্য করলে এই বিষয়ের সত্যতা পাওয়া যায়। যেমন, শূন্য খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের জনসংখ্যা ছিল ০.৩০ বিলিয়ন এবং ১০০০ খ্রিষ্টাব্দে এই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ০.৩১ বিলিয়নে । এই ১০০০ বছরে বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় মাত্র ১০ মিলিয়ন। পরবর্তী ৫০০ বছরে, অর্থাৎ ১০০০ থেকে ১৫০০ খ্রিষ্টাব্দে জনসংখ্যা  আরও ১৯০ মিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়ে  দাঁড়ায় ০.৫০ বিলিয়ন । এর পরবর্তী ২৫০ বছরে, ১৫০০ থেকে ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে, পৃথিবীতে জনসংখ্যা আরও ২৯০  মিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়ে  দাঁড়ায় ০.৭৯ বিলিয়ন। 

কিন্তু ১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হওয়ার মাধ্যমে বিশ্বের জনসংখ্যা আশ্চর্যজনকভাবে অতি দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৮০০ থেকে ১৮৫০ খ্রিষ্টাব্দ। শুধু এই ৫০ বছরে পৃথিবীর জনসংখ্যা ২৮৪ মিলিয়ন বৃদ্ধি পায় যা প্রায় অতীতের আড়াইশ বছরের জনসংখ্যার মোট বৃদ্ধির সমান। এভাবে চলতে চলতে বর্তমানে বিশ্বের মোট জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত বিলিয়ন। মূলত ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে  শিল্প বিপ্লবের সূচনা হওয়ার ফলে কৃষি ও শিল্পে প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে উৎপাদিত পণ্য খুব সহজে দূর দূরান্তে স্থানান্তর সম্ভব হয়। ফলস্বরূপ  ইতিহাসে প্রথমবারের মত মানুষ এই ম্যালথাসিয়ান ট্রাপ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়।

প্রথম শিল্প বিপ্লবের সূচনা হয় পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষ করে ব্রিটেনে। এখন এই ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের সূচনা হওয়ার পেছনেও কিন্তু রয়েছে বেশ কিছু সমস্যা এবং তা সমাধানের প্রচেষ্টা। যেমন, আঠারো শতকের শেষের দিকে বা উনিশ শতকের প্রথমদিকে, পশ্চিম ইউরোপের দেশ গুলোর মধ্যে ব্রিটেনের বাণিজ্যিক নেটওয়ার্ক সবচেয়ে শক্তিশালি ছিল সারা পৃথিবীতে। ফলে অন্যদের থেকে তাদের দ্রুত যোগাযোগের প্রয়োজনীয়তা ছিল অনেক বেশি। তৎকালীন ব্রিটেনে আবার তুলার কাপড়ের চাহিদা ছিল। যেহেতু হাত দিয়ে তুলা ছাড়ানো কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ, তাই যান্ত্রিক কোন পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল তারা। আবার যেহেতু গাছ পালা কেটে ফেলার ফলে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছিল, তাই বিকল্প জ্বালানির সন্ধানে তারা খনি থেকে কয়লা উত্তোলনে মনোযোগ দিচ্ছিল। দ্রুত সময়ে কয়লা উত্তোলনের জন্য আবার দ্রুত সময়ে খনি থেকে পানি অপসরণের প্রয়োজন হচ্ছিল। এই সকল প্রয়োজনীয়তার, অন্য কথায় এই সকল সমস্যা সমাধানের ক্রমাগত চেষ্টার ফলস্বরূপই বাষ্পীয় ইঞ্জিন এর আবিষ্কার হয়। আর এই বাষ্পীয় ইঞ্জিনের আবিস্কারের মাধ্যমেই শিল্প বিপ্লবের প্রথম ধাপের সূচনা হয় এবং বাষ্পীয় জাহাজ, ট্রেন ও ইলেক্ট্রিসিটির মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ কাঠামোয় এক অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে স্থানীয় কৃষি ও শিল্প পণ্য দূর দূরান্তে আরও সহজে এবং দ্রুততার সাথে স্থানান্তর সম্ভব হয় এবং বিশ্ব বাণিজ্য আরো বিস্তৃত হতে শুরু করে। বাজারে নতুন নতুন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি হয়। মানুষের মধ্যে এক ধরণের বিজ্ঞান নির্ভর আত্মবিশ্বাস তৈরি হওয়ার ফলে যে কোন সমস্যার সমাধানে মানুষ ক্রমাগত যন্ত্রের ব্যাবহার শুরু করে। ফলে খুব দ্রুত সময়ের ভেতরে উনিশ শতকের শেষের দিকেই শিল্প বিপ্লবের দ্বিতীয় ধাপ শুরু হয়। 

শিল্প বিপ্লবের এই দ্বিতীয় ধাপকে ত্বরান্বিত করে মূলত জার্মানি, জাপান ও আমেরিকার মত দেশগুলো। পেট্রাল ইঞ্জিনের আবিষ্কার, যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো দ্রুততর করে। জ্বালানি কয়লার বদলে জ্বালানি তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। ডায়নামো, এক্স রে, ডিনামাইট, রেডিও, টেলিগ্রাফ, আ্যসপিরিনের মত যুগান্তকারী আবিস্কার সমূহ আরো নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। পশ্চিমা দেশে উৎপাদিত ইলেক্ট্রনিক্স, ঔষধ ও গৃহস্থলী পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্প কারখানার উন্নয়ন ঘটে। ফলে পশ্চিমা দেশ সমূহে মানুষ ব্যাপকভাবে শহরমুখী হয়। হঠাৎ করেই শহরে জনসংখ্যার অতিরিক্ত বৃদ্ধির ফলে নতুন আরেক সমস্যা দেখা দেয়। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জাতি, গোত্র, বর্ণের বিপুল সংখ্যক মানুষ শহরে এসে জড়ো হওয়ায় বিভিন্ন প্রকাররে বৈষম্য ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি শহর গুলোতে বিভিন্ন ধরনের রোগ ব্যাধির প্রাদুর্ভাবও দেখা দেয়। উদাহরনস্বরূপ উনিশ শতকের শেষের দিকে পর্যায়ক্রমিক ভাবে শিকাগোতে কলেরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ফলস্বরূপ শিকাগোতে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করণের পাশাপাশি ড্রেইনেজ ব্যাবস্থার উন্নয়ন ঘটানো হয়। ইউরোপ আমেরিকার অন্যান্য বড় শহর গুলোতেও একইভাবে বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সুবিধার উন্নয়ন ঘটানো হয়। অপরদিকে এই দুটি শিল্প বিপ্লবের সূচনা যে দেশগুলোর হাত ধরে হয় সেসব দেশের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের একটা প্রতিযোগিতা খুব প্রকট ভাবে শুরু হয়। যেহেতু টিন, রাবার, জ্বালানি তেলের মত কাঁচামালের উপর ভিত্তি করে পশ্চিমা শিল্প কারখানা গুলো অধিকাংশ রপ্তানিযোগ্য পণ্য ও সামরিক সরঞ্জামাদি তৈরি করে, তাই ওই সকল কাঁচামাল সমৃদ্ধ দেশ সমূহে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার একটা  প্রতিযোগিতাও শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইতিহাসের বিভৎসতম দুটি বিশ্ব যুদ্ধের সম্মুখীন হয় বিশ্ববাসী।  

ইতিহাসের ভয়াবহতম দুটি বিশ্ব যুদ্ধও কিন্তু শুধু মৃত্যু আর ধ্বংস সঙ্গে নিয়ে আসে নি, বরং মানব ইতিহাসের অন্যতম দুটো উল্লেখযোগ্য আবিস্কারের পেছনে অনেক বড় ভুমিকা রেখেছে এই দুই বিশ্ব যুদ্ধ। আবিস্কার দুটির একটি হল পেনিসিলিন এবং অপরটি হল কম্পিউটার। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে ফ্রান্সের পশ্চিম ফ্রন্টের যুদ্ধক্ষেত্রের হাসপাতালগুলিতে কাজ করার সময়  অ্যালেক্সান্ডার ফ্লেমিং লক্ষ্য করেন, অধিকাংশ আহত সৈনিকের মৃত্যুর কারণ হল ক্ষতস্থানে ব্যাকটেরিয়া জনিত পচন। এই অভিজ্ঞতা থেকেই ফ্লেমিং যুদ্ধ শেষে  সেন্ট মেরি হসপিটালে ফিরে যান এবং ব্যাকটেরিয়া কিভাবে ধ্বংস করা যায় সে বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং অবশেষে ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী পেনিসিলিন আবিস্কারে সক্ষম হন। কিন্তু পেনিসিলিন মানবদেহে ব্যাবহারের জন্য যে গবেষণা এবং আর্থিক প্রণোদনা প্রয়োজন ছিল সেটা পেতেও অপেক্ষা করতে হয় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ পর্যন্ত। কারণ ওই যুদ্ধের সময়েই অ্যালাইড ফোর্স তাদের সৈন্যদের জন্য পেনিসিলিনের মত ওষুধের বাণিজ্যিক উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। অন্যদিকে এই দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়েই আলেন টিউরিং নামের একজন গনিতবিদ নাৎসি বাহিনীর যুদ্ধ কৌশল পর্যবেক্ষণের সময় একটি গোপন কোড ল্যাঙ্গুয়েজ ‘আনিগমা’ ডিকোড করার জন্য যে যন্ত্রটি আবিস্কার করেন, সেটির উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয় বর্তমানের আধুনিক কম্পিউটার। আর এই কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমেই বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শুরু হয় শিল্প বিপ্লবের তৃতীয় ধাপ। 

শিল্প বিপ্লবের তৃতীয় ধাপে এসে যখন সর্বক্ষেত্রে ইন্টারনেটের ব্যাবহার বৃদ্ধি পায়, নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার শুরু হয়, শক্তিধর রাষ্ট্র গুলোর মধ্যে পারমাণবিক শক্তি সামর্থ্য বৃদ্ধির প্রতিযোগিতা শুরু হয়, বিশ্ব বাণিজ্য বিশ্বায়ন অতীতের যে কোন সময়ের থেকে দ্রুততার সাথে শুরু হয় এবং তথ্য প্রযুক্তি মহলে যখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কিছু মূল উপাদান যেমন, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স, থ্রিডি প্রিন্টিং ও রোবটিক্স নিয়ে আলোচনা শুরু হয়; ঠিক তখনই করোনা ভাইরাসের মত এক মহামারির আক্রমণে হঠাৎ করেই পুরো পৃথিবী স্তব্ধ হয়ে যায়।

উপরের আলোচনা থেকে এটা স্পষ্ট যে, মানব সভ্যতা যখনই কোন গভীর সংকটের সামনে পড়েছে, তখনই সংকট থেকে উত্তরণের এমন কিছু উপায় বের করেছে যার সুফল পরবর্তী কয়েক যুগ ধরে ভোগ করা সম্ভব হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনেই যেভাবে ব্যাকটেরিয়া দমনে শতভাগ কার্যকর পেনিসিলিন আবিস্কার হয়েছে, ঠিক একইভাবেই বর্তমান মহামারির সময়েও সারা পৃথিবীতে ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিস্কার নিয়ে গবেষণা চলছে। আশা করা যায়, খুব শীঘ্রই একটা কার্যকারী ভ্যাকসিনের সন্ধান পাওয়া যাবে। একই সাথে আমাদের জীবন যাত্রার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক কিছুই স্থায়ীভাবে বদলে যাবে। ইতিমধ্যে যেভাবে হোম অফিস, হোম মিটিং, অনলাইন ক্লাসের ধারণা গুলো বাস্তবে পরিণত হয়েছে, মানুষের ভেতরে সাস্থ্য সচেতনতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি স্পর্শ এড়িয়ে চলার যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছে, তাতে ধরে নেয়া যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবোটিকস ও  তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর চতুর্থ শিল্প বিপ্লবও খুব দ্রুতই সামনে চলে আসবে। তাই বাংলাদেশের মত ঘনবসতি পূর্ণ দেশে কিভাবে এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুবিধা গ্রহন করে, হোম অফিস, অনলাইন ক্লাসের মত প্রযুক্তি নির্ভর ধারনাকে কাজে লাগিয়ে শহরের উপর চাপ কমানো যায় এবং কিভাবে  নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি জীবন যাত্রার সার্বিক মানের উন্নয়ন ঘটানো যায়, সে বিষয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরির এখনই উপযুক্ত সময় ।  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা