বদির বাবা ৭৫ পরবর্তী সরকারের কাছে চেয়েছিলেন গফরগাঁও এর ভাঙা প্রাইমারী স্কুলটার নাম বদির নামে হোক। কিন্তু সরকার আইনি জটিলতা দেখিয়ে অনুমতি দেয়নি। উল্টো তাদের ঢাকায় এক টুকরো জমি ছিল, সেটা এরশাদ সরকার দখল করে নেয়। বিনিময়ে দেয়নি কিছুই!
ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের সপ্তম ব্যাচের ছাত্র ছিলো বদিউল আলম। ক্যাডেট নাম্বার ১৬৪। ঢাকার মনিপুরী পাড়ার আব্দুল বারী ও রওশন আরা বেগমের ছয় ছেলের মধ্যে বড় ছিল সে। ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব মেধাবী ছেলেটা ছিল গল্পের বইয়ের পোকা। কিন্তু গল্পের বই রেজাল্টে কখনোই বাধা হয় নি। তাই তো মেট্রিকে স্টার এবং ইন্টারমিডিয়েটে কলা বিভাগে চতুর্থ হয়ে করে স্ট্যান্ড! পরে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক ও করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করেন।
ছাত্র অবস্থা থেকেই রাজনীতির প্রতি আগ্রহ ছিল। ছিলেন তৎকালীন ক্ষমতাসীন কনভেনশন মুসলিম লীগের ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশনের কট্টর সমর্থক। যাকে এক কথায় আইয়ুব খানের গুন্ডা বাহিনী বলা যায়। তখন থেকেই বদিউল আলম বদি নামে পরিচিত। গ্রামের বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ এর ডাকাতের গ্রাম খ্যাত গফরগাঁও।
১৯৭১ এর মার্চ মাসের শুরুতেই করাচি ছেড়ে বাংলাদেশ আসে বদি। কথা ছিল পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর অফিসার পদে যোগ দেয়ার। কিন্তু দেশের টানে চাকুরীতে যোগ না দিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধতে। ২৫ শে মার্চ এ ক্রেকডাউনের পর পরই বাম রাজনীতি করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর আরেক ছাত্র ইংরেজি দৈনিক নিউ এজের সম্পাদক শহিদুল্লাহ খান বাদলের সাথে দেখা করেন। বাদল তাকে দেখেই ভয় পেয়ে যায়। অনেকটা ধমকের সুরেই বদি তাকে বলে উঠে, "listen commies"। বলে রাখা ভাল, সে সময় কমিউনিস্টদের বদিরা বুলি করতো কমিস বলে। "সশস্ত্র বিপ্লবের কথা বলো, এখন কই তোমাদের বিপ্লব?"
বাদল বদির এ কথা শুনে আরো ভয় পায় কারন আইয়ুব খানের গুন্ডা বাহিনী করা বদির বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কত ধাওয়া পাল্টা হয়েছে একে অপরের সাথে তার হিসাব নেই। বাদলকে আশ্বস্ত করার জন্য বদি নিজের পকেটের ব্লেড বের করে নিজের আর বাদলের কবজিতে হালকা আঁচর দিয়ে বলে "from today we're blood brothers, let's go and fight" বাদল আর একজন বন্ধুকে নিয়ে বদি রওনা হয় গফরগাঁও এর দিকে। উদ্দেশ্য একটাই, সেখানকার ডাকাতদের সাথে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করা। শুরু করে দেন স্থানীয় রাজাকারদের সাথে যুদ্ধ।
বদির মা প্রথমে একটু মানা করেছিলেন যুদ্ধে যেতে, কিন্তু বাবা আব্দুল বারী মাকে বুঝান এই বলে যে, "তোমার তো ছয় ছেলে, একজনকে না হয় দেশের জন্য দিলে।" তখন মা বলেন, "তোরা এভাবে যুদ্ধ করলে কোথায় কবে মরে পরে থাকবি খবর ও জানবো না, এরচেয়ে বরং ঢাকা গিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধ কর। আর এভাবে আমার ছেলে মরে গেলেও আমি মা হিসেবে গর্ববোধ করবো।"
মায়ের কথা শুনে বদি কিশোরগঞ্জ এর স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধাদের সাথে যুদ্ধ শুরু করে চারটি ৩০৩ ও কিছু হেন্ড গ্রেনেড নিয়ে এপ্রিলের শুরুতে টিকাটুলির এক ফ্রেন্ড আসফাকুস সামাদের বাড়িতে রাখেন। কিছুদিন পরই এইসব অস্ত্র গুলো ছালায় ভড়ে ধানমন্ডি ৪ এর আরেক বাসায় নিয়ে আসেন। তখন পুরো ঢাকা পাকিস্তানের আন্ডারে থাকা এই অস্ত্র নিয়ে আসাও যুদ্ধ থেকে কোন অংশে কম না।
ঢাকায় আসার পরই বদির নতুন পুরাতন সব বন্ধুরা যুদ্ধ প্রশিক্ষন এর জন্য তাকে ইন্ডিয়া যাবার কথা বলে। কিন্তু বদি কিছুতেই ইন্ডিয়া যাবে না। তার এক কথা সে ঢাকা থেকেই যুদ্ধ করবে। কারন তার মনে ভয় ইন্ডিয়া গেলেই এই কমিস আর আওয়ামীলীগারদের রোষানলে পরবে সে। অনেক জোরাজুরির পর বদি ইন্ডিয়াতে যায় এপ্রিলের শেষ বা মে মাসের শুরুর দিকে। আর ইন্ডিয়া থেকে ফিরে আসে জুলাইয়ে। আর এই বদি ফিরে এসেই কাঁপিয়ে দেয় পাকিস্তানের ভিত।
আচ্ছা, আপনারা খালেদ মোশারফের কথা শুনেছেন কখনো? ঐযে কে ফোর্সের প্রধান ছিলেন। বদিও এই কে ফোর্সের আন্ডারেই প্রশিক্ষণ নেয়।তো ঢাকায় অগাস্ট মাসে কিছু সাংবাদিক আর কিছু বিদেশী ডেলিগেট আসাতে খালেদ মোশারফের অর্ডার আসে এমন কিছু করতে যাতে মনে হয় ঢাকায় যুদ্ধ চলে।
১১ আগস্ট এই বদি করলো কি হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টাল এর ভিতরেই বোম্ব ব্লাস্ট করে চলে এল। এ ঘটনা শুনেই খালেদ মোশারফ এদের বলেছিলেন, বললাম হোটেলের সামনে বোম্ব ব্লাস্ট করতে এরা হোটেলের ভিতরেই করলো! দিজ আর অল ক্রেক পিপল।আর ক্রেকপ্লাটুন নামটা এখান থেকেই। ৮ আগস্ট ঢাকাকে একটু নাড়িয়ে দেয়ার প্লান থেকে বদি, সামাদ, পুলু, জুয়েলরা। সন্ধার পরে ফার্মগেট এলাকার চেকপোস্টের ৫ জন খানসেনা আর ৬ জন রাজাকারকে মাত্র পৌনে তিন মিনিটে ক্ষতম করে দেয়। ১৪ আগস্ট গ্যাস বেলুনে করে পুরো ঢাকাকে বাংলাদেশের পতাকায় রাঙিয়ে দেয় বদি, জুয়েল ক্র্যাকরা।
এরপর বদি, জুয়েল, রুমীদের দলটা ঢাকা আসে সিদ্দ্বিরগঞ্জ পাওয়ার হাউজ উড়িয়ে দেয়ার জন্য। ১৯শে আগস্ট সন্ধায় তারা পাওয়ার হাউজটাকে রেকি করতে যায়। সামনের নৌকায় কাজি কামাল, বদি, জুয়েল আর পিছনেরটায় আজাদ, রুমি আর জিয়া। সবাই তাদের অস্ত্র নৌকার পাটাতনে লুকিয়ে রাখে। কিন্তু বদি তার মেশিনগানটা স্বভাব মত কোলে নিয়ে রাখে। এই অপারেশনের কমান্ডার কাজী বারবার বদিকে তার মেশিনগানটা লুকিয়ে রাখতে বলে। বদি তার স্বভাব মত ত্যাড়া উত্তর "আপনাগো মন চাইছে আপনারা আপনাগো মেশিন লুকাই রাখেন, আমারে কন ক্যান? এখন মিলিটারি আসলে কি আঙুল টাইনা ইনডেক্সে গুলি করমু?"
পথে কেউ একজন বাংলায় ডাক, দেয় কে যায়? বদিও একটু ঘুরিয়ে জবাব দেয় এইতো সামনে। কিন্তু সেটা কাছে আসতেই দেখে পাইক্যা সেনা সহ বেটা রাজাকার। পাকিস্তানি গুলা কিছু বুঝে উঠার আগেই বদি তার মেকজিনের সব গুলি খালি করে দেয় মুহূর্তের মধ্যেই সবগুলা পানিতে মরে পরে যায়। বদির জন্য বেচে যায় সেদিন সবাই। শুধুমাত্র জুয়েলের আঙুল তিনটিতে গুলি লেগে থেতলে যায়। তারপরই রুমী বদিকে তার বাসায় নিয়ে আম্মা জাহানারা ইমাম কে বলেন "আম্মা এই ছেলেটাকে একটু বেশি করে খাইয়ে দাও তো। এর জন্য আজকে আমরা সবাই বেঁচে ফিরতে পারছি"। বদি কিছুটা লজ্জা পায়।
বদি ছিল ধানমন্ডি ১৮ ও ২০ নাম্বারে ২৫শে আগস্টের গেরিলা অপারেশনেও। যে অপারেশনের পর রুমীর আজকের রুমী হয়ে উঠা। ১৫-১৬ জন পাকসেনা মেরে রুমী বদিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলে আজ বদি আম্মাকে রুমীকে দেখিয়ে বলে "খালাম্মা এই ছেলেটাকে একটু বেশি করে খাইয়ে দেনতো, এই সাহসী ছেলেটার জন্য আজ বেঁচে ফিরতে পারছি!"
২৮শে আগস্ট ধানমন্ডির হাইড আউটের মিটিং শেষ করে বদি ফিরে আসে তার নিজের হাইড আউটে। যেটা ছিল তার হাই স্কুলের বন্ধু ও তার হাই স্কুল প্রধান শিক্ষকের বাসা। সেই বন্ধুই ছিল পাকিস্তানিদের সাথে মিলে যাওয়া এদেশীয় দোসর। ধরা পরে যায় সেদিনই।
টর্চারসেলে নিয়ে প্রচন্ড প্রহার করা হয় তাকে। এতটা মার কখনোই কেউ তাকে দেয় নি। মারের যন্ত্রনায় মরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। একবার কারেন্টের সকেটে হাত দিয়েছিল মরে যাওয়ার ইচ্ছায়। আরেকবার ভেবেছিল যদি পালানোর চেষ্টা করে তবে হয়তো গুলি করে মেরে ফেলবে। কিন্তু পাকিস্তানিরা বুঝে গিয়েছিল। তাই শুধু মেরে হাতের কবজিটা ভেঙে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। তারপরেও ইটারোগেশন রুমে ভাঙা হাতটা নিয়ে টলতে টলতে বলেছিল "ইউ ক্যান ডু এনিথিং, আমি তোমাকে কিছুই বলছিনা আর।" বদি বলেননি কিছু, প্রকাশ করেননি সহযোদ্ধাদের ঠিকানা, আর তাই কখনও মুক্ত বাতাসে শ্বাস নেয়ার সুযোগও হয়নি তার, দেখা হয়নি স্বাধীন বাংলাদেশ, বীর এই যোদ্ধার লাশটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
বদির বাবা ৭৫ পরবর্তী সরকারের কাছে চেয়েছিলেন গফরগাঁও এর ভাঙা প্রাইমারী স্কুলটার নাম বদির নামে হউক। প্রয়োজনে নিজের টাকায় স্কুলটা ঠিক করে দিবেন। কিন্তু সরকার আইনি জটিলতা দেখিয়ে অনুমতি দেয় নাই। পরে তাদের ঢাকায় এক জমি ছিল সেটা এরশাদ সরকার দখল করে নেয়। বিনিময়ে দেয়নি কিছুই। এরপর ডিআইটি মার্কেটে শহীদ জননী হিসেবে তার মাকে এক দোকান বরাদ্দ দিলে তিনি এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, "দেশের জন্য ছেলেকে দিছি, বিনিময়ে চাইনি কিছু। সরকার জমি নিসে জমির বদলে জমি দিলে ছেলের নামে কিছু একটা করবো।"
দেয় তো নি কিছুই, শহীদ বদিকে মনেও রাখেনি কেউ! আর আজ তো রওশন আরা বেগম মারা গেছে প্রায় ১৮ বছর হতে চললো। আরেকটা আগস্ট মাস শেষ হতে চলছে। আর ১৯৭১ সালের এই মাসের ২৮-২৯ তারিখে আমাদের ছেড়ে বহুদূরে চলে গেছে ভালবাসার ক্র্যাক প্লাটুনের এক ঝাঁক নক্ষত্র। যেখানে একটা নাম ছিল বদিউল আলম বদি (বীরবিক্রম)...
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন