ডিউটিতে এক ফোঁটা পানি খাই না। কারণ মাস্ক খুলতে হবে। পুরোটা সময় আঁটসাট করে মাস্ক পরে থাকি, বারো ঘন্টা ডিউটির পরে এক ঘন্টায় সব ডিজইনফেক্টের কাজ শেষ করে যখন পানি নিয়ে বসি, মনে হয় গ্যালন গ্যালন পানি এখুনি শেষ করে ফেলতে পারব...
ডিউটি থেকে এসে অন্তত ঘন্টাখানেক সময় লাগে ধাতস্থ হতে। এই সময়টাতে কন্টিনিউয়াস নিজেকে বলতে থাকি, 'আজকের জন্য নরক যন্ত্রণা এখানেই শেষ। এখন মাথা খুব ঠান্ডা করে এন-৯৫ কে তার নির্দিষ্ট বক্সে রাখতে হবে, ওটি ড্রেস নির্দিষ্ট জায়গায় রাখতে হবে বা সাবান পানিতে ভেজাতে হবে, তারপর শাওয়ার রুমে গিয়ে সময় নিয়ে সব কিছু ডিজইনফেক্ট করার সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে। এবং এরপর আমি পানি খেতে পারবো।'
ডিউটিতে আমি একফোঁটা পানি খাই না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে কথা বলতে কষ্ট হয়ে গেলেও খাই না। কারণ মাস্ক খুলতে হবে। পুরোটা সময় আঁটসাট করে মাস্ক পরে থাকি, মাস্ক ছাড়া আমি এক মিনিট কম্প্রোমাইজ করতে রাজী না। ছয় ঘন্টা বা বারো ঘন্টা ডিউটির পরের এক ঘন্টার সব ভাইটাল কাজ মনোযোগ দিয়ে শেষ করে যখন পানি নিয়ে বসি, মনে হয় গ্যালন গ্যালন পানি এখুনি শেষ করে ফেলতে পারবো।
আমার কখনো পেপটিক আলসার ছিলোনা, কিন্তু এবার স্ট্রেস থেকে যে কী কী হচ্ছে... আমার মতো ঘুমপ্রিয় মানুষের রাতের ঘুম শেষ, সকালে একটু চোখ লেগে আসে প্রতিদিন। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে এই দশদিনের কোভিড ডিউটি চলছে আমার। কবে শুরু হয়েছে মনে নাই, কবে শেষ হবে জানিনা- এরকম আমার স্ট্রেসে পড়লেই মনে হয়। হঠাৎ হঠাৎ প্যানিকড হয়ে খুব হাইপার অথবা খুব হাইপো হয়ে যাচ্ছি হরহামেশা।
আজকে ট্রায়াজে একজন পজিটিভ রোগী আসলেন। তাকে বললাম- আপনি চলে এসেছেন, ভর্তি থাকেন। সে বললো- তার অসুবিধা নাই, ভর্তি থাকবে না। আমি বললাম, অসুবিধা না হলে আসলেন কেন? সে বললো, পজিটিভ হয়ে এখন কী করবে জানতে এসেছে। বললাম, সেটা আপনি ফোন করে জেনে নিতেন, এখন আসার সময় কত মানুষের মধ্যে দিয়ে এসেছেন, যাবেন আবার একইভাবে, আপনাকে ভর্তি হতে হবে। সে মাস্ক খুলে, নাক চুলকে নিতে নিতে বললো, আমার ছেলেরা আমাকে ভর্তি থাকতে দিবে না। আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম। কী বলবো না বলবো কিছু ভাবতে পারলাম না।
তারপর ছোটোখাটো অসুবিধা, কোমরবিডিটিজ জেনে ওষুধ পত্র দিয়ে যে সেই তখন থেকে আমি সবার সাথে চিৎকার করে কথা বলছি, সব কিছুতে অনেক বেশি রিঅ্যাক্ট করছি..আমার আজকে মেজাজ ঠিক নাই। মনে হচ্ছে রাস্তাভর্তি হাজার হাজার মানুষ, সব পজিটিভ।
ওই ক্যালাস পেশেন্ট থাকতে থাকতে আরেকজন রোগী আসলো, অ্যাম্বুলেন্সে করে। কনসালটেন্ট স্যার দেখে বললেন আইসিইউ লাগবে। আমার জানামতে এখন কোথাও আইসিইউ খালি নাই। এই রোগীর লোক অসহায় হয়ে এদিক সেদিক ছুটছিলো। ঠিক তাদের পাশেই আমার ক্যালাস রোগী আবারও মাস্ক খুলে নাক চুলকে নিলো, খেয়াল করলাম তার দুইপাশে দুই ছেলে, বোধহয় এই ছেলেদের কথাই বলছিলো। ওনার কি কোনো ধারণা আছে ওনার সাথে কী হতে পারে? অ্যাম্বুলেন্সে ওনার মতোই একজন পজিটিভ রোগীর অবস্থা দেখেও এই ধারণাটুকু করতে কি খুব বুদ্ধিমান হতে হয়?
আজকের ডিউটি শেষে ফিরে শুধু ভাবছি, 'প্যানিকড হয় না তামান্না, একটু ঠান্ডা হও, তুমি এখন আর ডিউটিতে নাই।' কোন অবস্থার সাথে একাস্টমড হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব, আমি জানি। এখন যে অবস্থা, এর সাথে কোনোভাবেই মানিয়ে চলা সম্ভব না। আমাকে কেউ একটা আশার কথা শুনিয়ে যান। এসব আর নেয়া সম্ভব না।
এই দেশের মানুষের হবে ডায়রিয়া, আলসার আর বাতের ব্যাথা। আর কোনো রোগ এই দেশে আসবে কেন? এরা তো কিছুই বোঝেনা, বুঝতে চায় না। এই কি বিপদে পড়লাম আমরা!
লেখিকা- তামান্না বিনতে আহমেদ, চিকিৎসক, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল
আমাদের কথা: প্রিয় তামান্না বিনতে আহমেদ, করোনার বিরুদ্ধে অসম এক লড়াইয়ে ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র হয়ে লড়ছেন আপনারা, তাও এমন কিছু মানুষের জন্যে, অসচেতনতা যাদের রক্তে মিশে আছে। চিকিৎসা পেশায় আসার আগে শপথ নিয়েছেন, শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে যাবেন, সেই লড়াইয়ে সাহায্য কতটুকু করতে পারছি জানিনা, তবে আমাদের ভালোবাসা আর শুভকামনা আপনার, আপনাদের সঙ্গে থাকবে সবসময়।