পুরো পৃথিবীর প্রায় সবগুলো উন্নত দেশই সময় মত রিয়েক্ট করতে পারেনি। বিষয়টা এমন ভবেই ঘটে গেছে। সেখানে আমাদের দেশের বহুমাত্রিক দীর্ঘমেয়াদি সীমাদ্ধতা থাকার কারণে আমাদেরও বুঝে উঠতে আরো বেশি দেরি হয়েছে...

কমিউনিটি ট্রান্সমিশন স্টার্ট কি আজকালের মধ্যে হলো নাকি তা আরো সপ্তাহ দেড় দুয়েক আগেই হয়েছে তা কেবল সনাক্ত হবার সংখ্যা আর মৃত্যুর সংখ্যার উপরই নির্ভর করে না কিন্তু, আমি যতটুকু বুঝি, প্রধানত দুইটি বিষয়ের উপর এটা নির্ভর করেঃ

১) কী পরিমাণ স্যাম্পল টেস্ট করা হচ্ছে এবং এর বিপরীতে কী পরিমাণ পজিটিভ কেইস আসছে।

২) টেস্টের স্যাম্পলগুলো কালেকশনের ক্ষেত্রে কতটা জিওগ্রাফিক্যাল এরিয়া কাভার করা হয়েছে এবং কতগুলো জায়গাতে পজিটিভ কেইস সনাক্ত হয়েছে।

অল্প কিছুদিন আগেও আমাদের স্যাম্পল টেস্টই তো হয়েছে মাত্র এক জায়গায়। তাও আবার সংখ্যায় এতটাই নগন্য যে উল্লেখযোগ্যই না। আমাদের প্রথম মৃত্যুর ঘটনা যদি ঘটে থাকে মার্চের ১৮ তারিখে, তাহলে এর ১০ দিন আগে যদি তার লক্ষণ প্রকাশ পায়, তবে তারও অন্তত ১০ দিন আগে এই মৃত ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে ধরে নেয়া যায়।

অর্থাৎ, যদি তিনি আক্রান্ত হয়ে থাকেন ফেব্রুয়ারির ২৭ অথবা ২৮ তারিখ, তার লক্ষণ প্রকাশ পায় ১০ দিনের মাঝে অর্থাৎ মার্চের ০৮ তারিখ এবং তার ১০ দিন পরে তিনি মারা যান অর্থাৎ ১৮ তারিখে, তবে ধরেই নেয়া যায়, দ্যা বেস্ট কেইস সিনারিও হলো, ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহের কোন একদিন বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস তার গোড়াপত্তন করে।

এর প্রায় এক মাস ১০ দিন পর এসে আমরা আজ মাত্র ভাবছি কমিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে। আমার কিন্তু এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ কাজ করছে। এর কারণ মূলত ২টা।

১) ঢাকা হলো পৃথিবীর সর্বোচ্চ ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর তালিকায় ১ নাম্বারে যার প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪৭,৪০০ জন বাস করে। যেহেতু ছোঁয়াচে রোগের ক্ষেত্রে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হবার গতির হারের তারতম্য জনসংখ্যার ঘনত্বের তারতম্যের সাথে সম্পৃক্ত, স্বভাবতই আমাদের এখানে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন অন্যদেশের তুলনায় দ্রুততর হবার কথা।

২) কোভিড-১৯ ডিটেকশন কিট কম থাকার কারণে, স্যাম্পল কালেকশন নেটওয়ার্ক দূর্বল হবার কারণে এবং ডিটেকশন সেন্টার একটা হবার কারণে আমাদের রোগী সনাক্ত অধ্যাধিক কম হয়েছে। আর রোগীই যেহেতু সনাক্ত কম হয়েছে তাই কেউ শ্বাসযন্ত্র সম্পর্কিত জটিলতায় মারা গেলে তা করোনায় মারা গিয়েছে বলে ঘোষণা করাও সম্ভব হয় নি। সুতরাং, কম সনাক্ত এবং কম মৃত্যু হয়েছে বলেই যে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন আগে শুরু হয় নি তা বলা যাচ্ছে না।

একটা বিষয় বুঝতে হবে। পুরো পৃথিবীর প্রায় সবগুলো উন্নত দেশই সময়মত রিয়েক্ট করতে পারেনি। বিষয়টা এমনভাবেই ঘটে গেছে। সেখানে আমাদের দেশের বহুমাত্রিক দীর্ঘমেয়াদি সীমাদ্ধতা থাকার কারণে এই বুঝে উঠতে পারার বিষয়টাতে দেরি হওয়া ছাড়াও আমাদের বাস্তবতাই আমাদের যথাযথ ব্যবস্থা নিতে দেরি হবার প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। দূর থেকে মন্তব্য করা সহজ, কিন্তু যারা সামনে থেকে কাজ করছেন তারা জানেন সত্যিকারের বাস্তবতা।

যতটা সম্ভব দ্রুত ডিটেকশন কিট এবং ডিটেকশন সেন্টার বাড়ানোর মত কাজ মোটামুটি দ্রুততার সাথেই করেছে সরকার। তবে, হাসপাতালে আইসিইউ বেড, আর্টিফিসিয়াল ভেন্টিলেশনের সংখ্যা ওভারনাইট বাড়ানো যে সম্ভব না তা আমাদের বুঝতেই হবে। অন্তত ১৮ কোটির উন্নয়নশীল একটা দেশে এটা কোনভাবেই সম্ভব না এই বাস্তবতাটা বুঝতে হবে। এই পরিস্থিতিতে সবকিছু সরকার মন থেকে উদ্যোগ নিলেই যে সম্ভব না এটা আমাদের বুঝতে হবে।

আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, পৃথিবীর এই ক্রান্তিকালে আমার দেশের সরকারের ইচ্ছা আগ্রহের কোন অভাব নাই। যা করছে এর চেয়ে খুব ভালো কিছু আশা করাটা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নির্বুদ্ধিতা। তবে, কিছু দায়িত্বশীল মানু্ষের মুখের কিছু বেফাঁস অর্থহীন কথাবার্তা, সমাবেশ ডেকে হাত ধোয়া কর্মসূচির উদ্বোধন মার্কা কিছু নিরেট চুলহীন কর্মকান্ড এবং সর্বপরি গার্মেন্টস কর্মীদের সাথে করা কাজ এই তিনটা কারনে সরকার তার উদ্যোগের কৃতকার্যতাকে ম্লান করেছে। এবং ভয়াবহ সংশয়ের সৃষ্টিও করেছে। তাই, নতুন করে বেশি সংক্রমণ দেখে অস্থির না হয়ে যা করার তাই করুন।

প্রথমত, নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সর্বাত্তক চেষ্টা করুন। সরকারের আদেশ মেনে চলুন।

দ্বিতীয়ত, আবেগপ্রবণ কিংবা ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে বাস্তবতা ফেইস করার মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করুন।

তৃতীয়ত, কায়মনোবাক্যে আল্লাহ তায়ালার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়ে তার কাছে দয়া ভিক্ষা করুন। একমাত্র তিনিই এই অত্যন্ত কঠিন ও কুৎসিত সমীকরণ সহজ ও সুন্দর করে দিতে পারেন।

দ্বিধাহীন চিত্তে তার কাছে সমাধানের দরখাস্ত করুন। তিনি চান আমাদের সাহায্য করতে। শুধু তার কাছে মনখুলে চাইতে হবে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তার দয়ার চাদরে মুড়ে দিন আর সকল বিপদ থেকে মুক্ত করুন। আমীন।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা