মালবাহী ট্রাক উল্টে গতকাল মারা গেছে ১৩ জন। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন তারা। আর তার পরদিন এসে বলা হচ্ছে, ব্যক্তিগত গাড়ি থাকলে তুমি বাড়ি যেতে পারবে, নইলে বন্দী থাকো ঢাকায়- নাগরিকদের সাথে রাষ্ট্রের এই দ্বিচারিতা কেন?

সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশনা এসেছে, ঈদে যারা ব্যক্তিগত গাড়িতে যেমন প্রাইভেট কার বা মাইক্রোতে করে বাড়ি ফিরত চান, তাদের বাধা দেয়া হবে না। এই নির্দেশনা পাবার পরে ঢাকার গাবতলী থেকে পুলিশ চেকপোস্ট তুলে নেয়া হয়েছে, অন্য দুই প্রবেশ পথেও শিথিল করা হয়েছে কড়াকড়ি। তবে গণপরিবহন বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত বহাল থাকবে। পুরো খবরটা পড়ার পর বুঝতে পারলাম, সরকারের তথাকথিত সেই 'উচ্চপর্যায়ের' নেয়া এই সিদ্ধান্ত আরেকটা কৌতুকে পরিণত হতে যাচ্ছে, করোনার প্রকোপের শুরু থেকে নেয়া অজস্র হাস্যকর সিদ্ধান্তের মালায় যুক্ত হতে যাচ্ছে আরেকটি দৃষ্টিকটু ভুল।

স্বাস্থ্যগত ঝুঁকির ব্যাপারে পরে কথা বলি। একটা রাষ্ট্রের মূলনীতি হচ্ছে, সব নাগরিক সমান অধিকার পাবেন, সংবিধানেও এমনটা লেখা আছে, রাষ্ট্রের সব সন্তানকে রাষ্ট্র সমান চোখে দেখবে। তাহলে এখানে কেন বৈষম্য? রাষ্ট্রযন্ত্র কেন আঙুল তুলে বলে দেবে, তোমার গাড়ি আছে, অতএব তোমাকে বিশেষ ছাড় দেয়া হবে, তুমি বাড়ি যেতে পারবে। তোমার ব্যক্তিগত গাড়ি নেই? তাহলে তুমি ঢাকায় বন্দী থাকো, বাড়ি ফেরার অধিলার তোমার নেই!

হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মল্লিক ফখরুল ইসলাম জানালেন, “বাড়িতে গিয়ে যারা ঈদ করতে চেয়েছেন, সরকার তাতে সম্মতি দিয়েছেন। কিন্তু গণপরিবহন বন্ধ থাকবে। পুলিশ সড়কে নিরাপত্তা দেবে, তবে সবাইকে নিজস্ব পরিবহনে যেতে হবে।” আমার প্রশ্ন হচ্ছে, বাড়িতে গিয়ে তো রহিম-করিম সবাই ঈদ করতে চেয়েছেন। চাকুরীজীবি থেকে শুরু করে দিনঠিকা শ্রমিক- সবাই এই সময়টা পরিবারের সঙ্গে কাটাতে চান, তাহলে তাদেরকে কেন সুযোগ দেয়া হচ্ছে না? সরকার কেন কেবল তার 'বড়লোক' নাগরিকদের ব্যাপারটাই খেয়াল রাখবে? কেন দরিদ্র‍্য জনগোষ্ঠী বঞ্চিত থাকবে?

নিয়ম তো এটা হওয়া উচিত ছিল যে গেলে সবাই যাবে, না গেলে কেউ যাবে না। রাষ্ট্র যদি সমতা বিধান করতে চাইতোই, তাহলে লকডাউন ভেঙে গণপরিবহন চালু করে দিতো, সবাই বাড়ি যাওয়ার সুযোগ পেতো। সেটাই আদর্শ নিয়ম হতো সবার জন্যে। যার গাড়ি আছে সে গাড়িতে যাক, যার নেই সে ঝুঁকি নিয়ে বাসে-ট্রাকে যাক। রাষ্ট্র কারো জন্যে কড়াকড়ি শিথিল করছে, কারো বেলায় জারী রাখছে। আর তার প্রায়শ্চিত্ত সাধারণ মানুষকে করতে হচ্ছে প্রাণ দিয়ে। গতকাল গাইবান্ধায় মালবাহী ট্রাক উল্টে মারা গেছে ১৩ জন। রড বোঝাই ট্রাকের ত্রিপলের নিচে ছিলেন সবাই, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলেন তারা। ট্রাকটি দুর্ঘটনায় উল্টে গেলে ত্রিপলের নিচে থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি তারা, সলীল সমাধি হয়েছে সেখানেই।

ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ঢাকার বাইরে যাওয়া যাবে

এতগুলো মানুষের মৃত্যুর ঠিক পরদিনই সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি আছে, তারা বাড়ি যেতে পারবেন, ঈদ করতে পারবেন পরিবারের সঙ্গে। তাহলে যাদের গাড়ি নেই, তাদেএ অপরাধ এই গাড়ি না থাকাটাই? সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্যে লকডাউন ডাকা হয়েছে, মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে, সরকার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে বারবার বলা হচ্ছে- এবারের ঈদটা পরিবারের সঙ্গে করার দরকার নেই, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তখন সবাই মিলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া যাবে। তাহলে এক শ্রেনীর মানুষের জন্যে কেন আইন শিথিল করা হবে?

সরকারের এই 'উচ্চপর্যায়ের' কি ধারণা, করোনাভাইরাস ধনী-গরিব চেনে? নাকি যার ব্যক্তিগত গাড়ি আছে তাকে ভাইরাস আক্রমণ করবে না, শুধু গণপরিবহনে গেলে সেখানেই ভাইরাসের আক্রমণ হবে? এটা সত্যি যে গণপরিবহনে সংক্রমণের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেশি, কিন্ত এমন তো নয় যে ব্যক্তিগত গাড়িতে কেউ বাড়ি গেলে সে গ্যারান্টি দিতে পারবে যে সঙ্গে করে ভাইরাস নিয়ে সে এলাকায় যাচ্ছে না।

তাছাড়া নতুন কেউ ঢাকা বা অন্য এলাকা থেকে আরেক এলাকায় এলে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নিয়ম- সেই হোম কোয়ারেন্টাইন কিভাবে পালন করা হয় আমাদের দেশে- সেসবের নজির তো আমরা অজস্র দেখেছি। এমন অজস্র উদাহরণ আছে, যেখানে হয়তো ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া কারো মাধ্যমে পুরো উপজেলা বা জেলায় করোনা ছড়িয়েছে। সেই নজির দ্বিতীয়বার স্থাপন করতে আমাদের এত আগ্রহ কেন?

এই কৌতুকগুলোর মানে কি আসলে, আমাদের জানা নেই। একবার বলা হচ্ছে কেউ বাড়ি যেতে পারবে না, ফেরী বন্ধ করা হচ্ছে, আবার সেটা শিথিল করা হচ্ছে কারো কারো জন্যে। শপিং মল একবার খোলা হচ্ছে, আবার মানুষের ভীড় দেখে সেটা বন্ধও করে দিচ্ছে স্থানীয় প্রশাসন। একদিকে ঘরে থাকার অনুরোধ জানানো হচ্ছে, বাড়িতে ঈদ করার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, পরে আবার এক শ্রেনীর মানুষের জন্যে সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে- সিদ্ধান্ত নিয়ে কি মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা চলছে নাকি?

আমরা কোনভাবেই গণপরিবহন খুলে দেয়ার পক্ষপাতী নই, অন্তত এখন তো মোটেও না, প্রতিদিন যেখানে ১৬০০-১৭০০ করে নতুন আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে ঈদ করার জন্যে মানুষকে বাড়ি যেতে দেয়াটা আত্মহত্যার শামিল। সরকার সেই আত্মহত্যার পথেই হাঁটছে। আমরা চাই সরকার তার প্রতিটি নাগরিককে সমান অধিকার দেবে। একজন গার্মেন্টস কর্মী যদি ঈদে বাড়ি যেতে না পারে লকডাউনের কারণে, তাহলে গার্মেন্টস মালিকেরও যাওয়ার অধিকার নেই, তার জন্যে আইন আলাদা হবার কোন সুযোগ নেই। নইলে বাংলা সিনেমার 'আইন সবার জন্যে সমান' ডায়লগটা কৌতুক হয়েই কাজীর কেতাবে টিকে থাকবে, বাস্তবে সেটার কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা