অথচ ভিয়েতনামের খাতা দেখে লিখলেও করোনায় পাশ করা যেত...
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
আমাদের সরকার বিশ্বের বাকি দেশগুলোর সরকারের মতই করোনা সংক্ৰমণ ঠেকাতে পারেনি, এটাই ফ্যাক্ট। চোখের সামনে নানান দেশে লাশের স্তুপ দেখার পরেও আমরা কিন্তু শুধরাইনি। সমান তালে সরকারি ত্রাণের চাল চুরি করে যাচ্ছি।
আচ্ছা, চলেন, বছরের প্রথম দিনে একটু আকাশ কুসুম কল্পনা করি। ধরেন আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, এবং এই চরম সংকটকালে আমাদের সরকার ঠিক কি কি করলে মহামারী রোধ করতে পারতো সেটা নিয়েই আলোচনা করা যাক।
আমি যখন নতুন কোন সংকটে পড়ি, যে ব্যাপারে আমার কোনই অভিজ্ঞতা নাই, আমি স্রেফ দেখি ইতিহাসে কে কে এর আগে এমন সংকটে পড়েছেন, এবং তারা কোন পথ অনুসরণ করেছিলেন বলে তারা সফল হয়েছেন। আমাকে ইতিহাস ঘাটাঘাটি করতে হতো না। যেহেতু এটি বিশ্বমহামারী, তাই নিবিড় পর্যবেক্ষন করলেই উপায় পেয়ে যেতাম।
"বড়লোকে যা করে, তাই সঠিক, গরিবের সব ভুল" - এই ফিলোসফিতে আমার বিশ্বাস নেই। এবং এর তাৎক্ষণিক প্রমান পেতাম এই দেখে যে এই মহামারীতে ইউরোপ আমেরিকা বিদ্ধস্থ হয়ে গেলেও, তুলনামূলক ফকির দেশ ভিয়েতনামের কিছুই হয়নি। তাই ভিয়েতনামের খাতা থেকে নকল করে পরীক্ষা পাশ করে ফেলতাম।
নকল করতেও আকল লাগে, তাই নিজের পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে বুঝে তারপরে পদক্ষেপ নিতাম। সবার আগে মাথায় রাখতাম যে আমরা অতি গরিব একটি দেশ। আমাদের সামর্থ্য নেই কোটি কোটি ডলার খরচ করে দেশের প্রতিটা নাগরিকের জন্য ইউরোপ আমেরিকার মতন চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা। আমাদের হাতে একটাই অস্ত্র ছিল, সেটি হচ্ছে রোগ প্রতিহত করা। না কেউ অসুস্থ হবেন, না তাঁকে চিকিৎসা দিতে হবে।
তাই এই ভয়াবহ রোগ প্রতিহত করতে একদম প্রথম মাস থেকেই এয়ারপোর্ট লক ডাউন করে দিতাম। চীন থেকেতো অবশ্যই, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও যেন কেউ এই রোগ নিয়ে দেশে ঢুকতে না পারে, সেটা নিশ্চিত করতাম। কারন কোন ভিভিআইপির ঘরে জন্মাইনি, বরং অতি সাধারণ জনতা হিসেবে বেড়ে উঠেছি বলেই জানি, এয়ারপোর্টে আমাদের থার্মাল মিটার, যাত্রীদের ডিক্লেয়ারেশন, বা এয়ারপোর্ট কর্মকর্তাদের মোরাল ক্যারেক্টার, কোনটাই কাজ করেনা।
বাস্তবেও তাই দেখা গেল। তাপ যন্ত্র নষ্ট ছিল, যাত্রীরা মিথ্যা কথা বলেছেন, এবং এয়ারপোর্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে টাকার বিনিময়ে করোনামুক্ত সার্টিফিকেট প্রদানের। যেসব যাত্রীকে জোর করে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হলো, তারা পুলিশকে, সরকারকে, দেশকে গালাগালি করে প্রতিবাদ করলেন। ফেসবুকে একদল আল্লাদি মানুষ "রেমিটেন্স যোদ্ধা" উপাধি দিয়ে চেতনা বেঁচলেন।
কাজেই, যদি এয়ারপোর্ট শুরু থেকেই বন্ধ থাকতো, তাহলে এই রোগের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যেত। এতে দেশে সংক্রমণ ঘটতো না। শুধু আকাশবন্দরই না, স্থল ও জল সব পথই বন্ধ করে দিতে হতো। কারন, প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়া থেকেও কেউ না কেউ ঠিকই এই রোগ নিয়ে আমাদের দেশে ঢুকে যেতে পারতেন।
ফলে, আমাদের চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়তে হতো। যেহেতু ইম্পোর্ট এক্সপোর্টও বন্ধ করতে হতো। আমরা চীন ও ভারতের উপর প্রচন্ডভাবে নির্ভরশীল। দারুন একটা মার খেতাম অর্থিনীতিতে। তারপরেও দুই একটা রোগী ঠিকই এখানে ওখানে পাওয়া যেত। এরা এয়ারপোর্ট বন্ধের আগেই বাংলাদেশে ঢুকেছিলেন হয়তো।
তাদের চিকিৎসা শুরুর পাশাপাশি অফিস আদালত বন্ধ হতে শুরু হতো। লকডাউন করা হতো শহরগুলো। কারন এইটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এইটাই লজিক্যাল। যেহেতু করোনা রোগী জানেন না কবে থেকে তিনি করোনায় আক্রান্ত, তাই সুযোগ আছে, তিনি আরও অনেকের মধ্যেই এই রোগ ছড়িয়েছে। ঠিক না?
যেহেতু সংক্রমণ রোধে দেশব্যাপী গণজমায়েত বন্ধ করতে হতো, সেহেতু দিন মজুররা বেকার হয়ে যেতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠান পেছানোর সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারতেন না দলের নেতানেত্রীরা। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ওদের ভালবাসা উনার নিজের কন্যার চেয়ে বেশি কিনা। আমার নামে এরা ফতোয়া জারি করতেন, "ল্যাঞ্জা ইজ ডিফিকাল্ট টু হাইড।"
আমি "স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী, একাত্তুরের পরাজিত শক্তির এজেন্ট" ইত্যাদি ইত্যাদি। তুচ্ছ একটি রোগের কারনে কয়েকশো কোটি টাকার আতশবাজি পোড়ানোর দৃশ্য দেখা থেকে দেশের মানুষকে বঞ্চিত করার কোন যুক্তিযুক্ত কারন খুঁজে পাওয়া যেত না।
মসজিদে জামাতে নামাজ আদায়, শবে বরাত ইত্যাদি নিষিদ্ধ করলে মুসলিমরা, পুণ্যস্নান নিষিদ্ধ করলে হিন্দুরা, গীর্জার প্রার্থনা বন্ধ করলে খ্রিষ্টানরা, বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অহেতুক আড্ডাবাজি নিষেধ করলে ছাত্ররা, স্কুল কলেজ বন্ধ ঘোষণা করলে অভিভাবকরা, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান বাতিল করলে গোটা বাংলাদেশের লোকজন আমার উপর খেপে উঠতেন।
কারন, যেই রোগে দেশের খুব কম সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, যেই রোগ সর্দি জ্বরের মতই সাধারণ রোগ, যেই রোগ আমাদের দেশে বিস্তার হবার কোনই সম্ভাবনা নাই, সেই রোগ নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি কেন? আমার বিরুদ্ধে স্বৈরাচার পতন আন্দোলন শুরু হয়ে যেত।
টিভিতে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবিরা, যারা এখন বলছেন সরকারের আরও আগেই ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ ছিল, তারাই বক্তব্য দিতে আসতেন, অর্বাচীন সরকারের এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়া দেশের জন্য কতটা ক্ষতির কারন হয়েছে তা নিয়ে স্ট্যাটিস্টিক্যাল আলোচনা করতে।
কিছু ডাক্তার এসে নিজের আবিষ্কৃত স্ট্যাটিস্টিক্যাল ডাটা দিয়ে প্রমান করে দিতেন সরকারের এমন হুজুগে সিদ্ধান্ত নেয়া মোটেও ঠিক হয়নি। কারন বাংলাদেশের গরমে এমনিতেও এই রোগ বিস্তারের কোন কারন ছিল না। ওটা শীত প্রধান দেশেই ছড়ায়।
হুজুররা জোশের সাথে বয়ান ফতোয়া দিতেন নাস্তিক সরকারের এমন ঈমান বিধ্বংসী পদক্ষেপ দেশের জন্য অভিশাপ বয়ে আনবে। ইহুদি নাসারাদের প্রতি নাজেল হওয়া গজব এমনিতেও এইদেশে আসতো না। মাঝে দিয়ে শুধু শুধু দাজ্জালের চ্যালের মতন কাজ করা হয়েছে। ঈমাম মাহ্দী আসার সময় হয়ে গেছে। আমরা দল বেঁধে তার কাছে বাইয়াত দিতে প্রস্তুত হই। এবং সবার আগে এই দাজ্জাল সরকারের মুণ্ডুপাত করি।
তারপরেও ধরে নিলাম, আমার সরকার চোয়াল শক্ত করে তাঁদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা দেশের এইসব মহাপন্ডিতদের কথা না শুনে আন্তর্জাতিক গবেষকদের পরামর্শ গ্রহণ করতাম। বিশ্বের প্রতিটা দেশে এই মহামারীর মরনকামড়ের ফল দেখে নিজের দেশকে আগলে রাখতে যা করার তাই করতাম।
আমরা শুধু প্রতিহত করেই শান্তি পেতাম না, ব্যাপক প্রস্তুতিও নিতাম। পিপিই কিনতে শুরু করতাম। অতি সতর্কতার সাথে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি চালু রেখে পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদির ব্যাপক উৎপাদন বাড়াতাম। সরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা ইউনিট তৈরী করতে নির্দেশ দিতাম। প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকেও একই নির্দেশ দিয়ে বলতাম প্রস্তুত থাকতে।
সমস্যা কি হতো শুনেন, পিপিই কেনার প্রজেক্টে কয়েক হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি হতো। হসপিটালের সামান্য পর্দার দামই যেখানে কয়েককোটি টাকা, সেখানে পিপিইর দাম কত হতো কল্পনা করেন। প্লাস্টিকের কিছু রেইনকোট বিলিয়ে কয়েকশো কোটি টাকার বিল ধরিয়ে দিলে অবাক হতাম না।
সরকারি হসপিটালে আলাদা করোনা ইউনিট করতে বলার নির্দেশে ডাক্তার ও রোগী সমাজ খেপে যেতেন। কারন এমনিতেই দেশে রোগীদের স্থান দেয়ার জায়গা নেই, বারান্দায় ফেলে চিকিৎসা করতে হয়, এর মাঝে আস্ত একটা আইসোলেটেড ইউনিট হতো স্রেফ বিলাসিতা। এমন সরকারের বিরুদ্ধে ডাক্তার ও রোগী যৌথ আন্দোলন শুরু হলে অবাক হতাম না।
পথে পুলিশ, মিলিটারি নামিয়ে জনজীবন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় আমাকে কিম জং উনের সাথে তুলনা করা হতো। ইতিহাসে ঠাঁই পেতাম বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় স্বৈরাচারী সরকার হিসেবে। আমি কিন্তু মোটেও বানিয়ে বলছি না। এইটাই হতো।
কয়েক বছর আগে একটা ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস শুনে বিপদগ্রস্ত এলাকা থেকে লোকজনকে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। এদিকে ঘূর্ণিঝড়ও দুর্বল হয়ে যায়। ফলে, প্রতিবছর যেখানে হাজারে হাজারে লাশ পড়তো, সেবছর একজনও মরেনি। এতেই লোকজন মহাবিরক্ত, কেন তাঁদের ডিস্টার্ব করা হয়েছে। তেমনই, আমার সরকারের এই অহেতুক প্যানিকের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে প্রচুর লেখালেখি হতো।
শুধু বাংলাদেশেই না। পৃথিবীর মোটামুটি সব দেশই এই ব্যাপারটা ঘটতো। সবাই যার যার সরকারকে দোষারোপ করতো, কেন শুধু শুধু এতটা প্যানিক করছে সরকার। আমাদের, মানুষদের স্বভাবটাই এমন। লাভ ক্ষতির হিসেবে কখনই "অপরচুনিটি কস্ট" ধরি না। লাখে লাখে মানুষের প্রাণ বেঁচে যেত কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার আর্থিক ক্ষতির মাধ্যমে - এই বোধ শক্তি আমাদের আসতই না যদি না নিজের চোখের সামনে লাশের স্তুপ দেখি। আবার লাশ পড়তে দেখলে গালাগালি, কেন আমরা সময় মতন স্টেপ্স নিলাম না।
আমাদের সরকার বিশ্বের আরও অন্যান্য শ খানেক দেশের সরকারের মতই করোনা সংক্ৰমণ ঠ্যাকাতে পারেনি, এইটা ফ্যাক্ট। চোখের সামনে নানান দেশে লাশের স্তুপ দেখার পরেও আমরা কিন্তু শুধরাইনি। সমান তালে সরকারি চাল ত্রাণ চুরি করে যাচ্ছি। আমরা নকল মাস্কের উপর এন-৯৫ লিখে ডাক্তারদের সরবরাহ করছি।
আমরা নকল হ্যান্ড স্যানিটাইজার কারখানা গড়ে তুলেছি। ব্যবহৃত গ্লাভস, মাস্ক পানি দিয়ে ধুয়ে আবার প্যাকেটে করে বিক্রি করছি। আমরা ধর্ষণকর্ম চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা নিজের মাকে শিয়াল কুকুরের খাবার হতে বনে জঙ্গলে ফেলে আসছি। আমাদের মৃত্যু ভয় নেই। কুরআনে আল্লাহ তাঁর নবীকে(সঃ) বলেছেন, ওদের সামনে স্বয়ং আল্লাহ এসে দাঁড়ালেও ওরা শুধরাবে না। আমাদের অবস্থা আবু জাহেল, আবু লাহাবদের চেয়েও খারাপ। আবু জাহেল নিজের মাকে এইভাবে জঙ্গলে ফেলে আসেনি। উল্টো দালিলিক প্রমান আছে সে নিজের মাকে কতটা ভালবাসতো।
কথা হচ্ছে, আমি আপনি সরকার হলে কি মহামারী ঠ্যাকাতে পারতাম? না। পারতাম না। কেন? কারন এই আমার আপনার মতন জনতাই সেটা করতে দিতাম না। যে জাতি যেমন হয়ে থাকে, সে তেমনই নেতা পায়। সেটা ধর্মীয় নেতা হোক, পলিটিক্যাল নেতা হোক বা যেমনই নেতা হোক।
আসেন, ব্রিটিশদের দিকে একটু নজর বুলাই। সেখানে এখন মুসলিমদের গণ কবর দেয়া হচ্ছে। ইহুদিদেরও হয়তো তাই। এত বিপুল সংখ্যক মানুষের কবর খোদাই করার সময় নেই। প্রতিদিন লাশের স্তুপ জমা হচ্ছে। দশজনের জন্য এক জানাজার নামাজ, কোন আত্মীয়, পরিবার, বন্ধু বান্ধব, কেউ নেই। এ এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন। কবে ভোর হবে, কবে কেউ ঘুম ভাঙাবে, সব অনিশ্চিত।
আমরা আছি ফুর্তিতে। পুলিশ, আর্মির সাথে চোর পুলিশ খেলে দিন কাটাচ্ছি। এবং এর ওর ঘাড়ে দোষ চাপানোর চেষ্টা করছি। কেন সরকার এইটা করলো না। কেন ওটা করলো না। কেন ডাক্তাররা চিকিৎসা করলো না। কেন নিজেরা পিপিই কিনলো না। কেন জনতা কথা শুনলো না। কেন লোক জমায়েত বন্ধ করলো না। কেন এইটা, কেন সেইটা।
আরও পড়ুন-