
সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন- আমরা করোনা মোকাবেলায় সফল হয়েছি। কীভাবে সফল হয়েছি, তা নিয়েই গল্প।
করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করতে আমরা সক্ষম হয়েছি...
এ লাইনটা পড়ে আমার উপরে তেড়েফুঁড়ে আসবেন না প্রথমেই। কথাটি আমার না। এই কথাটি যিনি বলেছেন, তিনি আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী। তিনি দাবী করেছেন- এ দেশে এখন আর করোনাভাইরাস নেই। তিনি এও দাবী করেছেন আমাদের দেশে আর ভ্যাকসিনও লাগবেনা। এই মানুষটার কথাগুলোর সাথে আমিও একমত। শুধু শুধু টাকার অপচয় করে লাভ নেই। যে টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন কিনতাম, সে টাকা দিয়ে আমরা কক্সবাজার বা সাজেক ঘুরে আসতে পারবো। কক্সবাজারও খুলে দিয়েছে, এই তো কয়দিন আগে। নিশ্চিন্তে সমুদ্রের নীল জলে অবগাহন করা যাবে এ টাকাতেই। কক্সবাজার ছাড়াও খোলা হয়েছে অনেক পর্যটন স্পটই, কিন্তু বন্ধ হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং আর বুলেটিন। এভাবেই আমরা বিভিন্ন জিনিস খুলে আর বন্ধ করে সক্ষম হয়েছি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে। অনেকদিন ধরেই আমরা হাপিত্যেশ করেছি, কবে করোনা দেশ থেকে চলে যাবে। অবশেষে, সে দিনটি এসেছে। এই উপলক্ষ্যে স্মরণ করছি বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে, যেগুলো আমাদের করোনা বিজয়কে প্রভাবিত করেছে।
প্রথমেই ধন্যবাদ দিতে হবে রিজেন্ট এর শাহেদ এবং জেকেজি'র সাবরিনাকে। এই দুইজন মানুষ এমন কাজ করেছেন, যার নজির সারা পৃথিবীতেই নেই। সারা পৃথিবীতে করোনা টেস্ট করার জন্যে ডাক্তারদের গলদঘর্ম হতে হয়েছে। কত পরীক্ষানিরীক্ষা, কত গবেষণা করে মানুষ পেয়েছে একেকটা রেজাল্ট। অথচ এই শাহেদ ও সাবরিনা, খালি চোখেই বলে দিতে পারতেন কার করোনা হয়েছে ও কার হয়নি। এরপর লিখে দিতেন সার্টিফিকেট। অবশ্য নিন্দুকেরা বলবে, টাকা নিয়ে টেস্ট না করেই ভুয়া সার্টিফিকেট দিতেন তারা। অবশ্য নিন্দুকেরা অনেক কথাই বলে। হোমড়াচোমরা মানুষেরা এসব গায়ে মাখেন না।
সারা দেশের পঞ্চাশ লাখ দরিদ্র পরিবারের একজন করে সদস্যের মুঠোফোন-ব্যাংক নম্বরে আড়াই হাজার টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সরকার। এখন পর্যন্ত টাকাপয়সা পেয়েছে ষোলো লাখের কিছু বেশি মানুষজন। বাকি টাকা বেমালুম হাওয়া হয়ে গিয়েছে। যেহেতু দেশে এখন আর করোনাভাইরাস নেই, তাই টাকাগুলো এখন আর দরিদ্র মানুষদের না দিলেও হবে। আমরা চাইলে বিদেশে এ টাকা দান করে দিতে পারি। দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে চাল, টাকা ও শিশুখাদ্য দেয়ার উদ্যোগও শুরু হয়েছিলো। সে টাকা, সে চাল ও সে শিশুখাদ্য কোন কোন গুদামে, কার কার খাটের নীচে থরেবিথরে সাজানো আছে, মিডিয়ার কল্যাণে তা সবারই জানা। স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিরা দুর্নীতি করেছেন স্বাভাবিক সময়ের মতন। দেশে যে মহামারী চলছে, মানুষের যে এখন কিছু ন্যূনতম সাহায্য দরকার, তা তারা মাথায় নেননি একবিন্দুও। অর্থাৎ করোনাকে তারা পাত্তাই দেন নি বলতে গেলে। এরকম একটি অতিথি-বিমুখ দেশে করোনা যে থাকবেনা, আমরা যে করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়ে যাবো, তা তো বলতে গেলে একরকম নিশ্চিতই ছিলো।
করোনার শুরুতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এরপরেও মন্ত্রণালয়ের সংকট কাটছিলো না। সেই সংকট মোকাবেলায় বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ১১৭ কোটি টাকা এবং এডিবির প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। এই দুই প্রকল্পের টাকা ব্যয় হয়েছিলো প্রয়োজনীয় সুরক্ষাসামগ্রী কিনতে। মজার বিষয় হলো, যে সুরক্ষাসামগ্রী কেনা হয়েছে তাতেও রয়েছে বিস্তর দুর্নীতির অভিযোগ। কেনা হয়েছে নিম্নমানের পিপিই, মাস্ক। কিন্তু দাম দেখানো হয়েছে সবচেয়ে উচ্চমানের পিপিই, মাস্ক এর থেকেও বেশি৷
যে টাকা দিয়ে এসব সরঞ্জাম কেনার কথা ছিলো, সে টাকা দিয়ে ভ্রমণ, অডিও-ভিডিও শর্ট ফিল্ম নির্মান, সফটওয়্যার কেনা হয়েছে। টাকার শ্রাদ্ধ করা হয়েছে পুরোদমেই। তবে এজন্যে দায়িত্বশীল মহলকে দোষ দিচ্ছিনা মোটেও। তারা বিচক্ষণ ও সুদুরপ্রসারি চিন্তাভাবনা করতে পারেন। তারা নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন, এ দেশে করোনাভাইরাস বেশিদিন টিকতে পারবেনা। তাই বেশি দামের সরঞ্জাম কিনে লাভ নেই। এ টাকায় একটু আইফেল টাওয়ার আর দার্জিলিং দেখে এলে ক্ষতি কী? যত যাই হোক, করোনা কে তো আমরা দমন করেই ফেলেছি। আর তো কোনো চিন্তাই নেই।
যদিও এতসব কথা যে বলছি, সেখানেও একটু কথা থেকে যায়। পৃথিবীর অনেক দেশেই এই করোনাকালীন সময়ে দুর্নীতি হয়েছে। তাও শুধু ঢালাওভাবে বাংলাদেশ নিয়েই বলছি কেন? সেটারও উত্তর আছে। সব ধরণের দুর্নীতির কথা তো বাদই দিলাম। ভুয়া পরীক্ষা আর ভুয়া সার্টিফিকেটের যে নজির এ দেশ স্থাপন করেছে, সেটা নেই পৃথিবীর আর কোনো দেশেই। নতুন ধরনের এই দুর্নীতির কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে- ‘বিগ বিজনেস ইন বাংলাদেশ: সেলিং ফেক করোনাভাইরাস সার্টিফিকেট’। বাংলাদেশ এদিকে ছাড়িয়ে গিয়েছে সবাইকেই। অবশ্য এ তো নতুন কিছু না। অনেক আগে থেকেই তো আমরা এই টপিকে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন।
এবার এদেশের মানুষজনের কথাও অল্প করে বলা যাক। লকডাউনের মধ্যে মাছের ড্রামে করে এদিক থেকে সেদিক ছুটেছেন কেউ কেউ, টাকা দিয়ে ভুয়া সার্টিফিকেট কেনা তো আছেই, মাস্ক না ব্যবহার করে বীরদর্পে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়িয়েছেন। পুলিশ কেন লকডাউন দিয়েছে, সে নিয়ে ঝগড়াঝাটি, মারামারিতেও লিপ্ত হয়েছেন উৎসাহী মানুষজন। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জিনিসপত্র কিনে বাজারে সংকটও তৈরী করেছেন কেউ কেউ।
শুধু তাই না। এমনও হয়েছে মন্ত্রণালয়ের আমলা পিপিই গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অথচ একজন ডাক্তার, যিনি করোনা রোগীর চিকিৎসা করছেন, তার পিপিই নেই। ডাক্তার মৃত্যুর হারে আমরা ছাড়িয়ে গিয়েছি দক্ষিন এশিয়ার সবক'টি দেশকে। মৃত্যুর সংখ্যার বিচারে সার্কভুক্ত খারাপ দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থানে রয়েছি আমরা। তাছাড়া এমনও দেখেছি, নার্স অথবা ডাক্তার ডিউটি শেষ করে বাসায় ঢুকতে চেয়েছেন, বাড়িওয়ালা বাসায় ঢুকতে দেন নি। রাস্তার কুকুর-বেড়ালের মত তাড়িয়ে দিয়েছেন। মানুষ মরে পড়ে আছে। কেউ ধরতেও যায়নি। বিদ্যুৎ বিলের ভুতুড়ে আচরণও লক্ষ্য করেছি। এভাবেই ক্রমশ করোনাভাইরাসকে প্রতিরোধ করে সফল হয়েছি আমরা।
সরকার এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার তোড়জোড় নিচ্ছে। আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হচ্ছে সবই। যানবাহনে এক সীট পরপর বসার নিয়মও বাতিল হচ্ছে কয়দিন পর। করোনা পরীক্ষার জন্যে টাকা নেয়া হচ্ছে সরকারি নিয়ম অনুসারেই৷ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, ভ্যাকসিন ছাড়াই আমরা সফল৷ এরকম এক বিজয়মুহুর্তে প্রশাসনের কাছে একটাই দাবী, কাউকে কল দিলে মোবাইলে যে এক নারীকন্ঠ বলে ওঠে,
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে ঘরের বাইরে নামতে...
এটা একটু বন্ধ করুন, প্লিজ।
এমনিতে তো আমরা সফল হয়েই গিয়েছি। করোনাভাইরাসকেও হটিয়ে দিয়েছি। এখন আর এই ভদ্রমহিলার বিনামূল্যে পরামর্শ নিতে পারছিনা আমরা।
বিষয়টা একটু দেখবেন।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন