করোনার ভ্যাক্সিন ও আমাদের পায়ের নীচে একখণ্ড মাটি
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

সবগুলো ধাপ সফলভাবে শেষ হলেই এবছরের শেষদিকে বাজারে আসবে ভ্যাক্সিনটি। প্রথমেই এটা সাধারণ মানুষ পাবেন না। শুরুতে এটি দেয়া হবে স্বাস্থ্যকর্মী আর চিকিৎসকদের। আগামী বছরের শুরুতে হয়তো এটি বাজারজাত করা হবে...
"ভ্যাক্সিন" শব্দটি সম্ভবত ২০২০ সালে "করোনাভাইরাস"এর পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দ। যেদিন থেকে খোলা মুখ ঢেকে গেলো মাস্কে, মানু্ষ সেদিন থেকেই হাপিত্যেশ করে যাচ্ছে ভ্যাক্সিনের জন্যে। ভ্যাক্সিনের প্রয়োগে পৃথিবী হয়তো একটু স্থির হবে। এটাই সবার আশা। ওদিকে বড় বড় দেশের রাঘববোয়ালরাও অপেক্ষা করছে ভ্যাক্সিনের জন্যে। তাদের অবশ্য পৃথিবী নিয়ে অতটা মাথাব্যথা নেই। ভ্যাক্সিন আবিষ্কৃত হলে ব্যবসা করতে পারবে, এক ধাক্কায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার কামাই হবে, এটাই তাদের আশা। তবে যা-ই হোক না কেন, ভ্যাক্সিন তো আর গলির মোড়ের শিঙাড়া না যে বললেই তৈরী হয়ে যাবে। সেখানে অনেক হিসেবনিকেশ থাকে। সময়ের ব্যাপার থাকে। পরীক্ষানিরীক্ষা, সফলতা-ব্যর্থতার বিষয় থাকে। বললেই তাই হয়ে যায় না সব। তবুও মহামারী শুরুর পর থেকেই পৃথিবীর বহু দেশের অজস্র বিজ্ঞানী তাদের মত গবেষণা শুরু করে দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা'র মতে পৃথিবীজুড়ে ১৪০ টিরও বেশি টীম কাজ করছে কোভিড-১৯ এর ভ্যাক্সিন তৈরী করা নিয়ে।
এই টীমগুলোর মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলো সারাহ ক্যাথরিন গিলবার্ট ও তার টীম। যুক্তরাজ্যে জন্ম নেয়া ক্যাথরিন একজন ব্রিটিশ ভ্যাকসিনোলজিস্ট যিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাকসিনোলজির অধ্যাপক এবং ভ্যাকিটেকেরও সহ-প্রতিষ্ঠাতা। এই মহামারি শুরুর প্রথম দিকেই তিনি বলেছিলেন, যথেষ্ট আর্থিক সহায়তা পেলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি কোভিড- ১৯ ভ্যাক্সিন সরবরাহ করতে পারবেন।
এরপরই অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে ভ্যাক্সিন তৈরীর কাজ শুরু করেন তিনি। এই কাজে ক্যাথরিনের সাথে আরো আছেন অ্যান্ড্রু পোলার্ড, তেরেসা ল্যাম্বে, স্যান্ডি ডগলাস, ক্যাথরিন গ্রিন এবং অ্যাড্রিয়ান হিলের মত গবেষকরা। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ওষুধ উৎপাদনকারী অ্যাস্ট্রাজেনেকা আছে সার্বিক তত্ত্বাবধানে। এই ভ্যাকসিনটির নামকরণ করা হয়েছে সিএইচএডিওএক্সওয়ান এনকোভ-১৯ (ChAdOx1 nCoV-19) নামে। মূলত ‘সিএইচএডিওএক্সওয়ান’ ভাইরাস ব্যবহার করা হচ্ছে এ ভ্যাক্সিনে, সর্দিকাশির দুর্বল ভাইরাস (অ্যাডেনোভাইরাস) হিসেবে যেটি বেশি পরিচিত। শিম্পাঞ্জিকে সংক্রমিত করা এ ভাইরাসটির জেনেটিক কোড পরিবর্তন করে বিজ্ঞানীরা এটিকে মানবদেহে ব্যবহার করছেন, যাতে মানুষের ক্ষতি কম হয়।
সম্প্রতি এই গবেষক দল দিয়েছে এক হৃদয়জুড়ানো সংবাদ। পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের চূড়ান্ত ধাপে পৌঁছেছে তারা। ফেজ-টু তে এই মুহুর্তে আছে তাদের পরীক্ষাটি। যুক্তরাজ্যের পাশাপাশি দক্ষিন আফ্রিকা, ব্রাজিলেও চালানো হচ্ছে পরীক্ষা।
এবার ভ্যাক্সিন বানানোর ফেজগুলো জেনে নেওয়া যাক বরং। কীভাবে এটা আস্তে আস্তে পরিণত হয় সেটা সম্পর্কে জানতে প্রথমেই জেনে রাখা উচিত, যেকোনো ওষুধ আর ভ্যাক্সিন বানানোর প্রক্রিয়া এক না৷ যেহেতু ভ্যাক্সিন মিলিয়ন মিলিয়ন সুস্থ মানুষের দেহে দেওয়া হয়, তাই এখানে সিকিউরিট, লিগ্যাল প্রটোকল , ইনটেনসিভ রিসার্চ সবকিছু বিবেচনা করতে হয় সূক্ষ্ণভাবে। কোনো রিস্কই নেয়া যায় না এখানে।
ভ্যাক্সিন গবেষনার প্রথম ধাপকে বলা হয় "প্রি-ক্লিনিক্যাল স্টেজ।" এই ধাপে এসে বিজ্ঞানীরা তাদের বানানো ভ্যাক্সিন বিভিন্ন প্রাণীর ওপরে পরীক্ষা করে দেখেন যে, ভ্যাক্সিনটি প্রাণীগুলোর দেহে কোনো ইমিউন সিস্টেম তৈরী করতে পারছে কী না। এই ধাপ উতরে গেলে দ্বিতীয় পর্যায়ে আসে "ফেজ-০১, ক্লিনিক্যাল টেস্টিং।" এই পর্যায়ে এসে অল্প কিছু মানুষের ওপরে ভ্যাক্সিনটি প্রয়োগ করা হয়। এবং খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ্য রাখা হয়, ভ্যাক্সিনটি মানুষগুলোর দেহে কীরকম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলছে এবং কীরকম পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। এরপরের ধাপ, ফেজ-০২, ক্লিনিক্যাল টেস্টিং। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভ্যাক্সিনটি এই ধাপটিই পার হয়েছে সম্প্রতি। এই ধাপে শত শত মানুষকে এই ভ্যাক্সিনটি দেয়া হয়। লক্ষ্য করা হয়, কোনো সাইড-এফেক্ট বা কোনো সমস্যা হচ্ছে কী না। ইমিউন সিস্টেম বাড়ছে কী না, এসব। যত বেশি মানুষকে পরীক্ষা করে ভ্যাক্সিনটি সফল হবে, ভ্যাক্সিনটি মানুষের কাছে আসার সম্ভাবনা ততই প্রবল হবে।
এরপরের ধাপে অর্থাৎ শেষ ধাপে এসে আরো অসংখ্য মানুষের মধ্যে এই ভ্যাক্সিনটি পুশ করা হবে। এবং দেখা হবে প্রতিক্রিয়া। যদি কোনো সমস্যা হয় সেগুলোর সমস্যাও সমাধানের চেষ্টা চলবে। এরপর ক্রমশ বাজারে আসবে একটি সফল ভ্যাক্সিন।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির সারাহ গিলবার্টের এই দলটির ভ্যাক্সিন, যার নাম "ভ্যাক্সিন ভেক্টর", সেটি মানবদেহে এন্টিবডির পাশাপাশি শ্বেতরক্তকণিকাও তৈরী করেছে। যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারন দেহের ইমিউন সিস্টেম যদি হয় গেট, তাহলে বডিগার্ড হবে সেখানে এন্টিবডি ও শ্বেতরক্তকণিকা। এই ভ্যাক্সিন দুইটি বিষয়কেই কাভার করছে। যেটা খুবই আশাব্যঞ্জক। ভ্যাকসিনটির এক ডোজ ব্যবহারেই শরীরে এন্টিবডি তৈরী হয়েছে প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষের, বাকি দশ শতাংশ মানুষের জন্যে দিতে হয়েছে ডাবল ডোজ। শ্বেতরক্তকণিকাও তৈরী হয়েছে সেসাথে। তবে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও পাওয়া গিয়েছে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে। হালকা মাথাব্যথা, সর্দিকাশি এরকম। যেগুলো অবশ্য খুব গুরুতর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না। সাধারণ প্যারাসিটামলেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে এই ভ্যাক্সিনগুলোর তৈরী করা এন্টিবডি শরীরে কতদিন থাকবে, সেটা এখনো গবেষকেরা বের করতে পারেননি। এ নিয়ে তাই গবেষণা এখনো চলছে।
দক্ষিন আফ্রিকা ও ব্রাজিলে এই ভ্যাক্সিনের তৃতীয় ধাপের কাজকর্ম শুরু হয়ে গিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে, সেসব জায়গাতেও সফল হবে ভ্যাক্সিনটি। এরপরের ধাপ- চ্যালেঞ্জ ট্রায়াল। অর্থাৎ কিছু মানুষের শরীরে কোভিড-১৯ এর জীবানু ঢুকিয়ে তারপর এই ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করা হবে। যেহেতু এটা একটু রিস্কি এবং মৃত্যুর সম্ভাবনাও থেকে যায়, তাই এটি রাখা হয়েছে সবার শেষে এবং অনেক আইনকানুনেরও বিষয় রয়েছে এখানে। এগুলো সফলভাবে শেষ হলে সম্ভবত এ বছরের শেষের দিকে বাজারে আসবে ভ্যাক্সিনটি। প্রথমেই এটা সাধারণ মানুষ পাবেন না। প্রথমে এটি দেয়া হবে স্বাস্থ্যকর্মীদের, চিকিৎসকদের। আগামী বছরের শুরুতে হয়তো এটি বাজারজাত করা হবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য মিলিয়ন মিলিয়ন ভ্যাক্সিনের অর্ডার এখনই দিয়ে রেখেছেন। সবকিছু ঠিকঠাকভাবে উতরে গেলেই সবার জন্যে উন্মুক্ত হবে ভ্যাক্সিনটি।
যদিও এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। এখনই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার মত কিছু হয়নি। তবুও এই বৈরী সময়ে এই "ভ্যাক্সিন" এর সফলতার খবর আমাদের আশাবাদী করে। আমরা আশায় বুক বাঁধি, ঘুটঘুটে অন্ধকারে টানেলের ওপ্রান্তে আলো বোধহয় খুব কাছেই।
ধন্যবাদ সারাহ গিলবার্ট ও তার টীমকে, এই অসময়ে শান্তির একপশলা সংবাদের জন্যে।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন