হাসপাতালগুলোর কোথাও আইসোলেশন আছে; তো চিকিৎসক নেই, কোথাও রাজিই হচ্ছে না, আবার কোথাও রাজি হলে সেখানে দেখা দিচ্ছে চিকিৎসকদের মধ্যে বিরোধ! আর এসবের মাঝে নিরবে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন রোগী। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

(১) করোনা ভাইরাস বাংলাদেশকে বাইরের বিশ্বের থেকে এক ভিন্ন বাস্তবতার সামনে দাঁড়া করিয়ে দিচ্ছে। অন্যেরা যখন করোনা ভাইরাস নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন, এসময় আমাদেরকে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে হচ্ছে যে করোনা তো দূরে থাক, এসময় কোনো রোগই যেন আমাদের না হয়। কারণ নিতান্ত স্বাভাবিক রোগ হলেও আমরা যে স্বাভাবিক চিকিৎসাটুকুও পাব- এর কোনো নিশ্চয়তা এখন আর নেই।

সকালে উঠেই যে খবরটি আসলো- 'ভর্তি নেয়নি কেউই, ৪ হাসপাতাল ঘুরে মারা গেল রিফাত। লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ছিল স্কুলছাত্র রিফাত। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরের দিকে শারীরিক সমস্যার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে নিতে হয়। কিন্তু খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ একে একে চারটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নেওয়া হলেও কেউ তাকে ভর্তি নেয়নি। শেষ পর্যন্ত বিনা চিকিৎসায় সন্ধ্যার দিকে মারা যায় খুলনা মহানগরীর খালিশপুরের এই স্কুলছাত্র।'

কিন্তু রিফাত তো লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ছিল, করোনায় নয়। তাহলে কেন তাকে এমন একটি হাসপাতালে নেয়া গেল না, যেখানে তার চিকিৎসা সম্ভব? কেন তাকে একের পর এক হাসপাতালে ঘুরানো হল?

কিছুদিন আগেই আমরা পড়েছিলাম একজন মুক্তিযোদ্ধার নির্মম মৃত্যুর খবর । যেখানে উনি ৬ টি হাসপাতাল ঘুরেও চিকিৎসা লাভ করতে পারেননি। আমি যদি আর্টিকেল থেকে কোট করি- 'আলমাছ উদ্দিনের পেটের পুরোনো রোগ। শুক্রবার ভীষণ ডায়রিয়া, সঙ্গে জ্বর। কিছুক্ষণ পর কথা জড়িয়ে যেতে থাকে তাঁর। তখনই পরিবারের লোকজন চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেন। এমনিতে দুটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা করাতেন তিনি। জ্বর-ডায়রিয়া শুনে তাঁরা নিতে চাননি। পরদিন শাহবাগের একটি বড় হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। সেখানে বুকের এক্স-রে করে নিউমোনিয়া মতো মনে হচ্ছিল। করোনাভাইরাসের উপসর্গের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে দেখে তারা রাখেনি। সেখান থেকে তাঁরা ধানমন্ডির একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেন। তাঁদের আইসোলেশন ওয়ার্ড আছে। রোগী ভর্তি করা যাবে এই আশ্বাস পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় আলমাছ উদ্দিনকে। কর্তৃপক্ষ রাখতে রাজি হলেও চিকিৎসকেরা আসেননি। ওই হাসপাতাল থেকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান স্বজনেরা। ভর্তি নেয় তারা। কিন্তু জরুরি বিভাগ থেকে ওয়ার্ডে পাঠানোর সময় চিকিৎসকদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। করোনাভাইরাসের ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য না পেলে রোগী রাখবেন না বলে জানান। তাঁরা কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে যান। পৌঁছানোর আগে আইইডিসিআরে যোগাযোগ করেন। সন্ধ্যার পর আলমাছ উদ্দিনের অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছায় কুয়েত মৈত্রীর গেটে। তাঁরা লক্ষণ দেখে বলেন, রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার আগপর্যন্ত তাঁকে আইসোলেশনে থাকতে হবে। সেখানে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা থাকলে বিপদ। এভাবে ছয় হাসপাতালে গিয়েও বাবাকে ভর্তি করাতে পারেননি সন্তানেরা।"

কী আশ্চর্য! কোথাও আইসোলেশন আছে তো চিকিৎসক নেই, কোথাও রাজিই হচ্ছে না, আবার কোথাও রাজি হলে সেখানে দেখা দিচ্ছে চিকিৎসকদের মধ্যে বিরোধ! আর এসবের মাঝে নিরবে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন রোগী। অথচ চিকিৎসা হলে হয়ত উনি বেঁচে যেতেন, একটা পরিবারে হাসি থাকত। সেই হাসি আমরাই কেড়ে নিচ্ছি।

অবস্থা এতই নাজুক যে করোনা নেগেটিভ রিপোর্ট আসার পরেও আপনি চিকিৎসা পাবেন কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমি এমন একটি স্ট্যাটাস থেকেই কোট করছি- "......৪৮ঘন্টা পর উনার রিপোর্ট আসলো নেগেটিভ, মানে তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নন। তাকে রিলিজ দেয়া হলো। এ অবস্থা আমাদের যার যার অবস্থান থাকে সকল ধরনের কার্ডিয়াক এবং নিউমোনিয়া রিলেটড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে মানবিক আবেদন করেও আমরা কারো মন গলাতে পারিনি। কুয়েত-মৈত্রী হাসপাতাল থেকে আবারো নিয়ে যাওয়া হলো বাসায়। বিগত ৫ দিন তিনি বিন্দুমাত্র ঘুমাতে পারেননি। ইতিমধ্যে উনার হাত পা ফুলে গেছে, ডায়বেটিস চরম হাই, ফুসফুসে পানি জমে গেছে। ৭ দিনের মাথায় অনেককে দিয়ে তদবির করে ভর্তি করানে হলো হার্ট ইনস্টিটিউটে। সেখানে নেই কোনো ডাক্তার। চরম বহেল। যেখানে উনার দরকার তাৎক্ষণিক চিকিৎসা, অক্সিজেন সেখানে চরম ঢিলেঢালা অবস্থা। নেই কোনো ডাক্তার। সবাই নাকি ছুটিতে। ২ দিন থাকার পর হঠাৎ ডাক্তার বললেন আপনারা রিলিজ নিয়ে বাসায় চলে যান। এ চিকিৎসায় সময় লাগবে। তার চেয়ে বাসায় থাকা ভালো। আমরা অনেক বলে কয়েও আর হাসপাতালে থাকার অনুমতি পেলাম না। না জানলাম উনার কী সমস্যা, না জানলাম উনার চিকিৎসা পদ্ধতি। বাসায় নিয়ে আসা হলো নবম দিনের মাথায়। একদিন রাত ২ টায় চরম শ্বাস কষ্ট শুরু হলে দুলাভাইয়ের। আবারও ব্যর্থ প্রচেষ্টার উদ্দেশ্যে অ্যাম্বুলেন্স কল করে হার্ট ইনস্টিটিউটের দিকে রওনা হলাম। সেখানে পৌঁছে জানলাম তিনি আর নেই। সবাইকে সব ধরনের ব্যর্থ প্রচেষ্টা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। তার আর কোনো শ্বাসকষ্টও হচ্ছে না। তিনি মারা গেছেন।"

চিকিৎসা পাওয়া আমাদের মৌলিক অধিকার। হাসপাতালে বেড আছে, প্রয়োজনীয় এক্সপার্টিজ আছে কিন্তু হাসপাতালে রোগী ভর্তিই হতে পারছে না, যার বিনিময়ে মারা যেতে হচ্ছে বিনা চিকিৎসায়। আপনিই বলুন এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে? একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমার প্রশ্ন এই মৃত্যুর দায় কে নিবে? বা দায় দূরে থাক, আমরা সাধারণ মানুষ কোথায় যাব কেউ অসুস্থ হলে? কোথায় গেলে আমরা ন্যূনতম চিকিৎসা পাব? আমি মনে করি একজন চিকিৎসক হিসেবে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া আপনাদের দায়িত্ব।

(২) আমাদের সময়টা এখন ঋতু পরিবর্তনের, এ সময় জ্বর জ্বর বোধ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তাই এরকম ক্ষেত্রে কারও জ্বর যদি বেশি থাকে এবং তার যদি হাসপাতালে যাবার প্রয়োজন হয়, সে কী করবে? আবার পত্রিকায় পড়লাম এ বছর শ্বাসতন্ত্রের রোগে সংক্রমণ অন্য সময়ের চেয়ে বেশি। করোনাতেও যেহেতু প্রায় একই ধরনের লক্ষণ আসে, অনেকে হয়তো এটা করোনা সন্দেহে ভর্তি নিচ্ছে না। হাসপাতাল থেকে করোনা সন্দেহে রোগী ভর্তি নিচ্ছে না, আবার করোনা হয়েছে কিনা সেই টেস্টও কর্তৃপক্ষ সহজে করাচ্ছে না। আবার যেহেতু করোনা নাই এটা টেস্ট দ্বারা কনফার্মড না, সুতরাং হাসপাতালও ভর্তি নিচ্ছে না। আপনারাই বলুন- এই দুষ্টচক্র থেকে মুক্তির উপায় কি?

প্রতিদিন ব্রিফিংয়ে নিয়ম করে বলা হয়- জ্বর সর্দি কাশি হলেই আপনারা করোনা ভাববেন না। আমি বুঝি না এ সতর্কবাণী কার জন্য- ডাক্তারদের জন্য? তারা এই সতর্কবাণী শুনছেন? এই যে একের পর এক বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হচ্ছে, তাতে কি মনে হচ্ছে যে নিয়ম করে ব্রিফিংয়ে বলাটাই যথেষ্ট?

(৩) আমাদের বিভিন্ন হাসপাতালে পড়ছি যে পিপিই সরবরাহ করা হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দিন সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর হাসপাতালে এখন আর পিপিইর কোনো সংকট নেই। কিছু জমাও আছে। জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জানিয়েছে এই মুহূর্তের পিপিইর আর কোনো সংকট নেই।

দেশেও বিভিন্ন মাধ্যমে পিপিই তৈরি ও বিতরণ হচ্ছে। অন্য হাসপাতালগুলোও হয়ত পাচ্ছে। তাহলে জ্বর সর্দি কাশি এ ধরনের রোগীকে যে ডাক্তারের পিপিই আছেন, উনিই পরীক্ষা করুন, ওষুধ দিক। অন্যেরা দূরে থাকুক। দরকার হলে হাসপাতালে আলাদা লাইন, ওয়ার্ড করা হোক যেখানে এ ধরনের কোনো রোগীকে রাখা হবে এবং ট্রিটমেন্ট দিবেন পিপিই পরিহিত ডাক্তাররা। এরপরে যদি কাউকে করোনা সন্দেহ হয় সেক্ষেত্রে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের সাথে তারাই যোগাযোগ করবেন, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন। কিন্তু তাও দয়া করে রোগী ফিরিয়ে দিয়ে তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিবেন না।

কিংবা এমন করা যেতে পারে যে ঢাকার কয়েকটি হাসপাতাল করোনার মতো লক্ষণের রোগী শুধু ভর্তি করবে, চিকিৎসা দিবে। এদের থেকে কারও করোনা হলে তাদের সরকার নির্ধারিত হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হবে।

এক্ষেত্রে আরেকটি ফিজিবল সমাধান হতে পারে র‍্যাপিড টেস্ট কিট। এধরনের কিটে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে মাত্র ১৫ মিনিট লাগে, যদিও ফলস রেজাল্টের আশংকা থাকে। তাই বাইরের দেশে যে র‍্যাপিড টেস্ট কিট ব্যবহার হচ্ছে তার সেন্সিটিভিটি ভালো হলে এটি প্রি-স্ক্রিনিং পর্যায়ে প্রয়োগ করা যায়। এ কিটগুলো সাধারণ হাসপাতালে সরবরাহ করা হলে সর্দি-জ্বরে ভোগা রোগীদের প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করা হবে। যদি রোগী নেগেটিভ হয় তাহলে হাসপাতাল ভর্তি করতে বাধ্য থাকবে। পজিটিভ হলে করোনার জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠাবে। অবশ্যই এখানে ফলস নেগেটিভ আসার সম্ভাবনা আছে, কিন্তু এটা একটা ভাল সমাধান। এছাড়া অন্যদেশে এগুলো কীভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে তা নিয়ে পর্যালোচনা করুন, একটা সিস্টেম দাঁড়া করান। যেটাই হোক, মানুষদের বাঁচান।

(৪) আমাদের দেশে এ যাবৎ করোনার জন্যে যে পরিমাণ মানুষ মারা গিয়েছে, করোনা সন্দেহে চিকিৎসা না পেয়ে প্রায় সম সংখ্যক রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা গিয়েছে। সবচেয়ে ভয়ের কথা এ বিষয়টা সবাইকে যেরকম নাড়া দেয়ার কথা, সেটা করছে না। করোনা যেন আমাদের মানবতার এক নিম্নমুখী অভিযাত্রার সুচনা করছে। খুলনার সিভিল সার্জন ডা. সুজাত আহমেদের একটি কথা আমার মনে হয়েছে গোটা পরিস্থিতির সঠিক চিত্র দিচ্ছে। উনি বলেন, ''হাসপাতাল ও ক্লিনিকে করোনার কারণে মানবিকতা কমছে। দায়বদ্ধতা থেকে এ রোগীর চিকিৎসা সেবা দেওয়া উচিত ছিল।" এই মানবিকতা কমার প্রতিকার কী?

আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে জানি না এর সমাধান কী, কিন্তু এতটুকু জানি একজন মানুষকে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ফুটবলের মতো ঘুরিয়ে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে ধুঁকতে মরতে দেয়া; আর যাই হোক, সভ্যতা না। আমরা যদি নিজেদের সভ্য দাবি করি তাহলে এর থেকে আপনাদের ডাক্তারদের এবং সংশ্লিষ্ট মহলের একসাথে বসে উপায় বের করতেই হবে। ডাক্তাররা যেমন ডেঙ্গু প্রতিরোধে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছেন, তেমনি এখানেও তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।

আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ অসহায়, আর কিছু না পারুন, দয়া করে তাদের চিকিৎসা পাবার মৌলিক অধিকারটুকু অন্তত দিন।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা