নেতারা রাখছেন না অসহায় শ্রমিকের খবর: এটাই কি তবে প্রকৃতির বিচার?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
যে নেতাদের কথায় শ্রমিকেরা একসময় পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে, দেশ অচল করে দিয়েছে- করোনার এই লকডাউনে তারাই সবচেয়ে বিপদে। এখন আর শাহাহান খান বা মশিউর রহমান রাঙ্গারা তাদের খোঁজ নিচ্ছেন না...
প্রায় এক মাস ধরে দেশ লকডাউনে, রাস্তায় নেই গণপরিবহন। জরুরী পণ্য পরিবহনের জন্য ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান বা মিনি ভ্যান চলছে, কিন্ত সেগুলোর সংখ্যাও হাতেগোনা। যাদের জীবন আর জীবিকা নির্ভর ছিল পরিবহন সেক্টরের ওপরে, তাদের অবস্থা এখন বড়ই শোচনীয়। রাস্তায় গাড়ি না নামায় তাদের পকেটে টাকা নেই, ঘরে খাবার নেই, অনাহারে অর্ধাহারে কাটছে তাদের দিন। এত এত নেতা তাদের, শ্রমিক পক্ষের সংগঠনের নেতা, মালিক পক্ষের সংগঠনের নেতা, এতসব ইউনিয়ন- কারো কোন পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না এখন, অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য এগিয়ে আসছে না কেউই। তাদের গডফাদার শাজাহান খান, অথবা মশিউর রহমান রাঙ্গা- কেউই নেই তাদের পাশে!
অথচ কিছুদিন আগেও এই পরিবহন শ্রমিকেরা ছিল রাস্তার রাজা। এদের বেশিরভাগই ধরাকে সরা জ্ঞান করতো বরাবর, নিজেদের ভাবতো সব আইন-কানুনের ঊর্ধে! চালকের ভুলে সড়ক দূর্ঘটনায় যখন নিরীহ কারো মৃত্যু হয়েছে, পরিবহন আইন সংশোধন বা খুনীদের বিচারের দাবীতে যখন সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে, তখন এদের ভয়ংকর নগ্ন চেহারাটা আমরা দেখেছি, আমরা দেখেছি এদের তাণ্ডবনৃত্য। এরা সরকার মানে না, আইন মানে না, নিজেদের স্বার্থটাই ওদের কাছে সবচেয়ে বড় ছিল বরাবর।
সেই স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তারা দেশব্যাপী অঘোষিত অবরোধ ডেকেছে বারবার, সাধারণ মানুষকে জিম্মি করেছে। যারা ব্যক্তিগত গাড়ি বের করেছে, তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে, মুখে কালিঝুলি মেখে দিয়েছে, অপমান করেছে বারবার। ওদের তাণ্ডবে দিশাহারা হয়েছে মানুষ, সরকারও এদের শক্তির কাছে মাথা নত করেছে বারবার, হেঁটেছে আপোষের পথে। এখন এরাই অসহায় অবস্থায় দিনযাপন করছে পরিবার নিয়ে, যারা নিজেরা ধর্মঘট ডেকে দেশ অচল করতো, এই লকডাউনে তারাই সবচেয়ে বিপদে! প্রকৃতি কাউকে ছেড়ে কথা বলে না, প্রকৃতির বিচারে কেউ মাফ পায় না- পোয়েটিক জাস্টিসের এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কি হতে পারে?
শ্রমিকদের অভিযোগ, এই দুর্দিনে নেতাদের কেউই তাদের পাশে নেই। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছেন না তারা। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, পিকআপ ভ্যান, থ্রি-হুইলার, ইজিবাইক চালক ও তাদের সহকারীসহ প্রায় ৫০-৬০ লাখ শ্রমিক দেশের পরিবহনখাতের সাথে জড়িত। লকডাউনের এই সময়টায় উপার্জনের পথ হারিয়ে খুব কঠিন সময় পার করছেন তারা। এখন গার্মেন্টস সেক্টরের মতো তারাও প্রণোদনা চাইছে!
কিন্ত প্রণোদনা দিলেও, তার কতভাগ শ্রমিকের পকেটে যাবে? শ্রমিকরা বলছেন, তাদের কল্যাণ তহবিলের নামে প্রতিদিন যে অর্থ আদায় করা হয়, সেই টাকার সামান্য অংশও যদি তাদের জন্য ব্যয় করা হতো, তাহলে শ্রমিকরা উপকৃত হতো। বাংলাট্রিবিউনের এক প্রতিবেদনে দেখেছিলাম, প্রতিদিন শুধু ঢাকা শহর থেকেই অর্ধ কোটি টাকা শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের নামে আদায় করা হয়। তাহলে সারাদেশের অংকটা কত? কোথায় গেল এই বিশাল অংকের টাকা? কার পকেটে? এখান থেকে অসহায় শ্রমিকদের জন্যে কিছু করা হচ্ছে না? সরকার যদি আগামীকাল পাঁচ বা দশ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, সেটার সিংহভাগও যে বারো ভূতে লুটেপুটে খাবে না, তার কি গ্যারান্টি?
চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন তার অর্ধেকটা জীবন দিয়ে দিয়েছেন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের পেছনে। এই উদ্যোগটাকে নিয়ে তিনি বারবার এই পরিবহন শ্রমিকদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন বারবার, তাদের বলেছেন, লাইসেন্স ছাড়া যেন কেউ গাড়ি না চালায়, ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ে যাতে কেউ রাস্তায় না নামে। মানুষের জন্য ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো ইলিয়াস কাঞ্চনকে এই পরিবহন শ্রমিকেরা শত্রু ভেবেছে তাদের গডফাদারদের ইশারায়, তাদের অঙ্গুলি হেলনে তারা ইলিয়াস কাঞ্চনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে, তার নামে বিকৃত পোস্টার ছেপেছে, তার গালে গালে জুতার বাড়ি মারতে চেয়েছে!
অথচ আজ যখন এই মানুষগুলোর ঘরে খাবার নেই, যখন তাদের নেতারা তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, তখন ইলিয়াস কাঞ্চন আর তার নিরাপদ সড়ক চাই এর পক্ষ থেকেই পরিবহন শ্রমিকদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, স্বল্প পরিমাণে হলেও চাল-ডাল-তেল-আলু তারা পৌঁছে দিচ্ছেন অভাবী আর অসহায় পরিবহন শ্রমিকদের ঘরে। শাজাহান খান বা মশিউর রহমান রাঙ্গা, যাদের ইশারায় পরিবহন শ্রমিকেরা গাড়ি বন্ধ করে দেশ অচল করে দিতো, তারা এখন শ্রমিকদের খোঁজ নিচ্ছেন না, শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন ইলিয়াস কাঞ্চন, যাকে এরা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করতো! আইরনি আর কাকে বলে!
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আজকের এই অসহায় অবস্থায় পড়ে কান্নাকাটি করা পরিবহণ শ্রমিকেরা আবার ধরাকে সরা জ্ঞান করা শুরু করবে, সেটা আমরা জানি। এদের স্বভাব বদলাবে না, তখন এদের নেতারাও ফিরে আসবে স্বমূর্তিতে। এরাও মনে রাখবে না, বিপদের দিনে কে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, আর কে ছেড়ে গিয়েছিল। মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি তো এটাই, খারাপ সময় কেটে গেলে সব ভুলে যাওয়ার এই স্বভাবটা তো তার চিরকালীন...