আপনার 'করোনার চেয়েও শক্তিশালী রাষ্ট্র' আপনাকে কতটা বঞ্চিত করেছে, কীভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে তার ছোট্ট একটা গাণিতিক উদাহরণ দিই।

১৮ কোটির দেশে এখন পর্যন্ত টেস্ট হয়েছে মাত্র ১৩১৭৮টি৷ প্রতি দশ লাখ মানুষের মাঝে টেস্ট করা হয়েছে ৮০ জনকে। নাইজেরিয়া, গুয়েনতেমালা, হাইতি, মোজাম্বিক, মায়ানমার, জিম্বুয়াবুয়ে, মালাউই এবং পাপুয়া নিউগিনি ছাড়া আর কোনো দেশ নাই যারা জনসংখ্যা অনুপাতে এত কম টেস্ট করেছে। (চীন, কুয়েত, আফগানিস্তান, সিরিয়ার মতো হাতে গোণা কয়েকটা দেশের তথ্য পাওয়া যায়নি)

এখানে নাইজেরিয়া ছাড়া বাকি দেশগুলোতে কেস একশর নিচে। হাইতি, মোজাম্বিক, মালাউই, জিম্বাবুয়ে একেবারে দরিদ্র দেশ। তুলনা চলে না। বাংলাদেশে করোনা পজেটিভ পাওয়া গেছে ১০১২ জন। ঠিক উপরে থাকা হংকং এ পজেটিভ পাওয়া গেছে ১০১৩ জন৷ এই ১০১৩ জন বের করার জন্য হংকং টেস্ট করেছে কত জানেন? ৯৬৭০৯ জনকে। মনে করিয়ে দিই, বাংলাদেশ করেছে ১৩১৭৮ টা টেস্ট।

বলবেন হংকং তো উন্নত দেশ। তুলনা চলে না। আচ্ছা তবে কাছাকাছি তুলনায় আসি। মধ্য এশিয়ার দেশ উজবেকিস্তানে করোনা পজেটিভ রোগীর সংখ্যা ১১৬৫, বাংলাদেশের প্রায় কাছাকাছি। এই ১১৬৫ কেস পেতে উজবেকিস্থান টেস্ট করেছে ৭০ হাজার! আন্তর্জাতিক মন্টেনারি ফান্ডের ২০১৯ সালের হিসেবে মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশের ঠিক পরের জায়গায় আছে উজবেকিস্তান। (১৪৩ ও ১৪৪)

৩ কোটি মানুষের দেশ উজবেকিস্তান যারা মাথাপিছু আমাদেরও পেছনে তারা সমসংখ্যক কেস পেতে টেস্ট করেছে আমাদের চেয়ে সাড়ে পাঁচগুণ বেশি। লজ্জাজনক এই পরিসংখ্যানের শেষ নেই। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক ১৪০০ করোনা পজেটিভ বের করেছে ৪৬ হাজার টেস্ট করে। মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশের কাছাকাছি থাকা ভিয়েতনাম ২৬৭ টা কেস বের করেছে ১ লাখ ২২ হাজার টেস্ট করে। হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন ২৬৭ কেসে তারা সোয়া লাখ টেস্ট করেছে।

আমরা নিত্যদিন যে দেশকে টেনে নিজেদের ট্রল করি সেই উগান্ডাও আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। ৫৫ টা কেস পেতে তারা টেস্ট করেছে ৬ হাজার৷ জনসংখ্যা অনুপাতে টেস্ট করেছে আমাদের চেয়ে দ্বিগুণ। কোন দেশটার হিসেব নেবেন বলেন?

ভেনেজুয়েলা, বর্তমানে দেউলিয়া অবস্থায় পড়ে যাওয়া রাষ্ট্র, ১৯৩ টা কেস পেয়েছে ২ লাখ ২৫ হাজার টেস্ট করে। নেপাল মাত্র ১৬টা কেস পেয়েছে, কিন্তু টেস্ট করে ফেলেছে ৬ হাজারের বেশি। ভারত পাকিস্থান ছাড়া কোনো পরিসংখ্যান পূর্ণতা পায় না।

ভারতে এখন পর্যন্ত এক্টিভ কেস ১১৪৮৭। ভারত টেস্ট করেছে ২ লাখ ৪৫ হাজার। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশে কেস ১১ ভাগের এক ভাগ। আর ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ টেস্ট করেছে ১৯ ভাগের এক ভাগ। ভারত প্রতি দশ লাখে জনসংখ্যার মধ্যে টেস্ট করেছে ১৭৭ জনকে। বাংলাদেশেরটা মনে আছে? ৮০ জন। পাকিস্তান এখন পর্যন্ত টেস্ট করেছে ৬৯৯২৮ টা। প্রতি দশ লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে ৩১৭ জন। আমরা ৮০।

পরিসংখ্যান

ফিলিস্তিনের কথা বলে শেষ করি। ইসরায়েলের দুই পাশে দুই খণ্ড পরাধীণ ভূমি। মাথার উপর বোমা, জঙ্গী বিমান। বছর বছর ইসরায়েলের হামলা৷ কোনো কিছুই স্টাবল না। আয়তন ৬ হাজার বর্গকিলোমিটার। এই পরাধীন দেশটা পর্যন্ত ১৭ হাজারের বেশি টেস্ট করেছে ৩৩৪ কেসের জন্য। ভাবা যায়?

হিসাব কিতাব দিলে প্রতিটা দেশের সাপেক্ষেই দেয়া যাবে, বলা যাবে। বাদ দিই। এই টেস্টের হিসাব কেন দিলাম? এখন তো বাংলাদেশ টেস্ট করতে শুরু করেছে, শীঘ্রই আমরা পাকিস্তানকে হারিয়ে দিতে পারি, এটাও হয়তো ভাবছেন অনেকেই। একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলেই বুঝতে পারবেন করোনার ক্ষেত্রে টেস্ট ও টেস্টের সময়কাল দুইটাই গুরুত্বপূর্ণ।

আপনি যত দ্রুত সাসপেক্টেড রোগীকে কনফার্ম করতে পারবেন সে করোনা পজেটিভ কিনা, তত দ্রুত আইসোলেটেড করা সম্ভব। তাতে আরেকজনকে আক্রান্ত করার সম্ভাবনা কমে যায়। আপনি একজনকে টেস্ট করলেন না, সও একশজনকে আক্রান্ত করে ফেলল। তারপর এক মাস পর আপনি ৫০ জনকে টেস্ট করে পজেটিভ পেলেন। অন্যদিকে আরেকজন শুরুতেই দশজনকে টেস্ট করে পজেটিভ পেয়ে আইসোলেটেড করে ফেলল। মানে তারা সঠিক সময়ে অল্প টেস্ট করেই করোনা কন্ট্রোল করে ফেলেছে।

এজন্যই শুরুতেই ব্যাপকভাবে টেস্ট করা দরকার। তাইওয়ান হংকং করোনা কন্ট্রোল এমনি এমনি করে নাই। ৩৯০ কেস পেতে তাইওয়ান ৫০ হাজার টেস্ট করেছে। হংকং এর কথা তো আগেই বলেছি। পাকিস্তান ভারত খুব শীঘ্রই বেশি টেস্ট করার সুফল পেয়ে যাবে। অলরেডি ভারতের কেরালা রাজ্য করোনাকে হারিয়ে দিয়েছে। কীভাবে হারিয়েছে সেটা পড়ে নিয়েন।

যখন ব্যাপক হারে টেস্ট করার কথা তখন আমরা বসে ছিলাম। যখন ব্যাপক হারে আইসোলেশন কোয়ারেন্টাইন করার কথা, তখন আমাদের দেশে সিটি নির্বাচন হয়। প্রধানমন্ত্রী ভোট দিয়ে ভি চিহ্ন দেখান। মন্ত্রীবর্গ জোকারি করেন।

"করোনার চেয়ে শক্তিশালী" "উন্নত বিশ্বের চেয়ে ভালো প্রস্তুতিওয়ালা" এবং "ক্ষেমতার" জোরে ডাক্তার বহিষ্কার করা রাষ্ট্র যে উগাণ্ডা ফিলিস্তিনের চেয়েও পিছিয়ে আছে করোনা প্রস্তুতিতে সেটা জানিয়ে গেলাম। মাকে বনে ফেলা দেয়া, লাশ দাফনে খাটিয়া না দেয়া, লাশ দাফন না করার জন্য গোরস্থানে নোটিশ দেয়া, করোনা হাসপাতালে হামলা করা জাতি নিয়ে অন্য কখনো বলব।

আরও পড়ুন-

১. আমাদের ক্ষমা করবেন না ডা. মঈন
২.
অথচ রাষ্ট্র তাকে একটা অ্যাম্বুলেন্সও দিতে পারেনি!
৩.
দেশটা আল্লামা শফীর, ডা. মঈনদের না...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা