একজন ডাক্তার কিন্তু মহামারি আসার জন্য বসে থাকে না। তাকে প্রতিদিনই মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য কাজ করে যেতে হয়। অথচ তাদের কতটুকু প্রস্তুত আমরা রাখতে পেরেছি?

একটা পরিসংখ্যান দিচ্ছি। আজকের দিনের হিসেবে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৭৭৭ কোটি ৩৯ লক্ষ ১৬ হাজার ৯৬২ জন। শুধু আজকের দিনে এই পর্যন্ত পৃথিবীতে মোট জন্মগ্রহণ করেছে ২ লাখ ৭৭ হাজার ৩ শত ৮৮ জন। শুধু আজকের দিনে এই পর্যন্ত পৃথিবীতে মোট মৃত্যুবরণ করেছে ১ লাখ ১৬ হাজার ৪ শত ৫৪ জন। দিনের সময় কিন্তু আরও কিছুটা বাকি। এবার আসি করোনা নিয়ে। করোনা সংক্রমণে গত ডিসেম্বর থেকে শুরু করে আজ অবধি মোট ১১৯ দিনে সারা পৃথিবীতে মারা গেছেন ২৮ হাজার ২ শত ৩৮ জন। যেখানে পৃথিবীতে আজ একদিনেই এখন পর্যন্ত মারা গেছেন সোয়া এক লাখের মত, সেখানে প্রায় চার মাসের এই ২৮ হাজার মৃত্যু নিয়ে পুরো পৃথিবী স্থবির। আমরা চিন্তিত, ভীত এবং আতংকিত।

এবার আসি, আমরা কেন এতটা আতংকিত? 

সত্যিকারার্থে আমরা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর প্রতিনিয়ত জানতে পারছি। কেন জানতে পারছি জানেন? কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং মেডিক্যাল সায়েন্টিস্টদের জন্য এই ভাইরাস বিশাল মাথা ব্যথার কারণ। তারা দেখছেন এই ভাইরাসটি একে তো ছোঁয়াচে, অন্যদিকে এর কোন ওষুধ এখনো জানা নেই। মূলত ছোঁয়াচে হবার কারণেই তারা এ বিষয়ে সবাইকে সচেতন করছেন।

আর যখন থেকেই আমরা সচেতন হয়েছি, জানতে পেরেছি এই ভাইরাস সম্পর্কে, তখন থেকেই আমাদের ভেতরে এই ভাইরাস নিয়ে একটা তীব্র ভয় কাজ করছে। আর আমরা ভাবছি, এই বুঝি করোনায় আক্রান্ত হব এবং সেই ২৮ হাজার পৃথিবী থেকে চলে যাওয়া মানুষের সাথে নিজেকে যুক্ত করে ফেলব।

আরেকটা তথ্য শেয়ার করি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থ্যার তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর শুধু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে ১ কোটি ৭৯ লক্ষ জন। গড়ে প্রতিদিন শুধু হৃদরোগে মৃত্যু বরণ করে ৪৯ হাজার জন। আর এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে গড়ে প্রতিদিন মারা গেছে ১৮৯ জন। (এটা অবশ্য সামনে আরও বাড়বে। তবে সেটা কত পর্যন্ত যেতে পারে?)  

এই হার্টের অসুখ বা হৃদরোগই পৃথিবীতে মৃত্যুর প্রধান কারণ। কেবল হৃদরোগের এই পরিসংখ্যানগুলো আগে থেকে জানি না বলে, হৃদরোগ নিয়ে আমাদের মাঝে কোন ভয় কাজ করে না। জানি না বলেই নিজের অজান্তে আমরা ধরে নিয়েছি, আমাদের বোধ হয় হৃদরোগ হবে না। যেমনটা আমাদের নিম্নবিত্ত কিংবা অথর্ব বোকা মানুষগুলো করোনার পরিসংখ্যান জানে না বলে তারা ধরে নিয়েছে করোনায় তারা আক্রান্ত হবে না। এজন্যই যারা জানে আর যারা জানে না তারা সমান না। 

তাহলে কি করোনাকে ভয় পাবার আর দরকার নেই? অবশ্যই করোনাকে ভয় পাবার দরকার আছে। ভয় পেয়ে আমাদের যা যা করা উচিত তা যথাযথভাবে করে যেতে হবে। তবে, শুধু করোনাকে ভয় পেলেই সব কিন্তু শেষ হয়ে যাবে না। এমন করোনার মত কতশত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে যে আমরা চলছি, সেগুলোকেও ভয় পেতে হবে। করোনা এভাবে আমাদের সামনে এসে তা আমাদের শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, এই যা।

যেমন ধরুন, আপনি ইচ্ছামত ধূমপান করেই যাচ্ছেন, ফাস্টফুডে বসে চর্বি জাতীয় খাবার খেয়েই যাচ্ছেন আর একটু একটু করে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এটা নিয়ে আপনার একটুও ভয় নেই। করোনা আমাদের যেই বিশাল শিক্ষাটা দিয়ে যাচ্ছে তা হলো, সবার আগে নিজের শরীরের যত্নটা নিতে হবে। আর সে যত্নের শুরুটা হল পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা। করোনা আপাতত শুরু করিয়ে দিল। আল্লাহ তায়ালা বাঁচিয়ে রাখলে,  বাকি কাজটা কিন্তু আমাদের।

করোনার আরেকটা শিক্ষা হলো, কেবল নিজে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকলেই হবে না, তা সমষ্টিগত ভাবে প্র্যাকটিস করাটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে, অন্যের দোষে নিজে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থেকে যাবে।

সুতরাং কি কি মৃত্যুঝুঁকি আমাদের চারিপাশে ঘুরুঘুর করছে তা জানার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সে সব মৃত্যুঝুঁকির সাথে প্রতিনিয়ত ফাইট করার জন্য নিজের শরীরটাকে সবসময় তৈরি রাখা। এ বিষয়ে বিস্তারিত অন্য কোন এক লেখায় লেখা যাবে।

করোনা ভাইরাসের শিক্ষা কি এতটুকুই? না। করোনা ভাইরাস যে এই পৃথিবীকে কি কি শিখিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তা লিখতে গেলে অনেক অনেকটা লিখেও শেষ করা যাবে না। তবে, আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নিয়ে কথা না বললেই নয়।

আমাদের দেশের সশস্ত্র বাহিনীর মূল কাজ কি বলুন তো? দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। কোন বাহিরের পরাশক্তি আমাদের আক্রমণ করলে তাদের বিরুদ্ধে দূর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলে দেশকে বিজয়ী করা। তাই, কোন আক্রমণের পূর্বাভাস না থাকার পরও আমরা বছরের পর বছর এই বাহিনীকে দেখেশুনে রাখি, তাদের সকল চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি তাদের আধুনিক প্রশিক্ষণ আর যন্ত্রপাতি দিয়ে পুরোপুরি প্রস্তুত রাখি এবং দেশের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আর অনুগত রাখার চেষ্টা করি।  এমন যদি হতো যে আমাদের কোন আধুনিক সশস্ত্র বাহিনী নেই আর এমন সময় আমাদের কেউ আক্রমণ করেছে! তখন আমাদের কি অবস্থা হতো? এই বাহিনীকে হয় পালিয়ে যেতে হতো অথবা মরতে হতো।

বর্তমানে আমাদের দেশের ডাক্তার নার্স সহকারে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত বাহিনীর এই একই অবস্থা। যুদ্ধের ময়দানে দাঁড়িয়ে বর্ম আর অস্ত্র ভিক্ষা করতে হচ্ছে। অথচ সারাদেশ তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। অথচ এই বাহিনীকে সারাবছর জুড়ে প্রস্তুত রাখার দায়িত্ব কিন্তু আমার, আপনার, আমাদের, সরকারের সবার। কিন্তু আমরা তা করি নি। ভেবে দেখুন, সেনাবাহিনী দৈনিক দাপ্তরিক কাজ আর মিশনে যাওয়া ছাড়া খুব দেশোদ্ধার করা কি কাজই বা করে? একজন ডাক্তার কিন্তু মহামারি আসার জন্য বসে থাকে না। তাকে প্রতিদিনই মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্য কাজ করে যেতে হয়। অথচ তাদের কতটুকু প্রস্তুত আমরা রাখতে পেরেছি? উল্টো সময় সুযোগ পেলেই তাদের পিণ্ডি চটকেছি। আবার অসুস্থ হলেই লেজ গুটিয়ে তাদের কাছেই ধরনা দিয়েছি। কেবল তাদের জন্য সচেতনভাবে কিছু করার কথা কখনো চিন্তাও করি নি।   

করোনা ভাইরাস আমাদের শিখিয়ে দিয়ে গেল,  আমরা যেন এই ফ্রন্টলাইন হেলথ সোলজারদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে, সমরাস্ত্র দিয়ে এবং সুযোগ সুবিধা দিয়ে সবসময় প্রস্তুত রাখি। নতুবা সামনের দিনগুলো আরও ভয়াবহ হতে যাচ্ছে।

শেষকথা: আমি যেই পরিসংখ্যান একেবারে শুরুতে শেয়ার করেছি তা প্রতি সেকেন্ডে পরিবর্তনশীল। আমার এই লেখা চলাকালীন সময়ে তা অনেকটা বদলে গেছে। আপনরা চাইলে নিচের তথ্য সূত্রগুলোতে ক্লিক করে দেখে আসতে পারেন। 

তথ্যসূত্র:

1. Worldmeter
2. World Health Organization 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা