ইন্ডিয়ার কেরালার দিকে তাকান। শ্রীলংকার দিকে তাকান। তাকান ভিয়েতনামের দিকে। চীনের প্রতিবেশী তাইওয়ানের দিকেও একটু নজর দিন। ওরা কেউ ধনী রাষ্ট্র না। অথচ বুদ্ধিমানের মতন শুরু থেকেই সাবধান ছিলেন। এই সুযোগটা আমাদেরও ছিলো। কিন্তু আমরা কী করেছি?

চীনে যখন প্রথম করোনা ভাইরাস ছড়াতে শুরু করে, তখন থেকে লাগাতার বলে আসছি এই রোগের ব্যাপারে। লোকে পাত্তা দেয়নি। কারন আশি হাজারের বেশি আক্রান্ত হয়েও মরেছে মাত্র তিন হাজারের মতন মানুষ। রেশিও অনুযায়ী কিছুই না। চীনের মতন ঘন বসতিপূর্ণ দেশে, যেখানে জনসংখ্যা শত কোটির বেশি, সেই দেশে "মাত্র" আশি হাজার আক্রান্ত হয়েছে, এতে প্যানিক করার কি আছে?

ইনফ্লুয়েঞ্জা ফ্লুতে এরচেয়ে বেশি মানুষ মরে। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় এর চেয়ে বেশি মানুষ মরে। ইত্যাদি ইত্যাদি বলেছেন বিজ্ঞজনেরা। কিন্তু সেই বিজ্ঞদের একজনের মাথাতেও কি আসেনি ভাইরাসটি "এতটা সামান্য" হলে চীনা ডাক্তাররাই কেন স্পেস স্যুটের মতন এয়ার টাইট পিপিই দিয়ে চিকিৎসা করছে? জ্বর সর্দির মতন সিমিলার ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের জন্য কেন ওদের এত কড়াকড়ি?

কেন ওদের একেকজন স্বাস্থকর্মী হাসপাতালে যাবার আগে পরিবার থেকে এমনভাবে বিদায় নিচ্ছে যেন সুইসাইড মিশনে যাচ্ছেন? কেন চীন লকডাউনে চলে গেল যেখানে গোটা বিশ্বের মোটামুটি প্রতিটা প্রোডাক্ট ব্র্যান্ডের ফ্যাক্টরি ওদের দেশে আছে? এত কোটি কোটি টাকার লোকসান কেন তুলবে তাঁরা? নিশ্চই কোথাও কোন সমস্যা ছিল, ঠিক না? সাধারণ বুদ্ধি অন্তত তাই বলে।

তারপরও বাংলাদেশ থেকে শুরু করে আমেরিকা পর্যন্ত, বিশ্বের সব প্রান্তের বিশাল সংখ্যক মানুষ চীনের সরকারি হিসেবের উপর ভরসা রেখেছেন। মাত্র সাড়ে তিনহাজার মানুষের মৃত্যু। শত কোটি চীনার মধ্যে নব্বই হাজারও আক্রান্ত হননি। সবাই দিব্যি ভুলে গেলেন চীন একটি কমিউনিস্ট দেশ, এবং ওদের সংবাদপত্রে সেটাই প্রকাশ হয় যা তাদের সরকার চায়। সেখানের জনগণ তোতাপাখির মতন তাই বলে যা ওদের সরকার শিখিয়ে দেয়।

এখন ট্রাম্প ও আমেরিকা দোষ চাপাচ্ছে চীনের ঘাড়ে যে ওরা তথ্য গোপন করেছে। এখন চীন মোটামুটি স্বীকার করে বলেছে উহানে আরও ৫০% বেশি লোক মারা গাছে। মানে, সাড়ে তিন হাজার নয়, পাঁচ হাজারের কাছাকাছি মানুষ মরেছে। যদিও ওদের মোবাইল কোম্পানি দেড় দুই মিলিয়ন মানুষের কোন হদিস নাকি পাচ্ছেনা। সেটা যেহেতু প্রমাণিত নয়, তাই ও নিয়ে কিছু বলতে চাইনা। কিন্তু সিআইএর দেশ আমেরিকা জানতো না যে চীনারা তথ্য গোপন করা জাতি? ওরা কোন বুদ্ধিতে এমন ভন্ড পীরের অন্ধ মুরিদ হয়ে গেল?

এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশেও একই নিয়ম করা হচ্ছে। মন্ত্রী ও নেতারা একদম শুরু থেকেই জনগণকে বিভ্রান্তিতে রেখে যা ক্ষতি করার করেছেন, এখন হুকুম এসেছে হসপিটালের নার্সরা গণমাধ্যমে কিছু বলতে পারবে না। বক্তব্য দিলেই সরকারি ব্যবস্থা নেয়া হবে। মানে, নো টেস্ট, নো করোনা থিওরি দিয়ে আমাদের বুঝ দেয়া হবে দেশে করোনা আক্রান্ত রোগী সংখ্যা অতি কম, মরছেও কম। 

এবং সব শেষে আমরা সফলভাবে করোনার বিরুদ্ধে জয়ী হবো। মাঝে দিয়ে আমাদের জনসংখ্যা থেকে হঠাৎ করে নেই হয়ে যাওয়া মানুষরা শ্বাস কষ্ট আর নিউমোনিয়ায় মারা যাবেন। গত এক সপ্তাহে গোটা বিশ্ব থেকে পঞ্চাশ হাজার মানুষ বিদায় নিয়েছে। এটি অফিসিয়াল হিসাব। টেস্ট করা হয়নি এমন কতজনের হিসাবতো নেইই।

সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হচ্ছে, এত সন্দেহজনক টেস্টিং ও কাউন্টিংয়ের পরেও আমাদের দেশে সুস্থ হবার সংখ্যার চাইতে মৃতের সংখ্যা বড়। বিশ্বের আর কোন দেশে এমন আছে জানা নেই। আল্লাহ মাফ করুন।

আজকেই খবর এসেছে অর্ধশত পুলিশ সদস্য করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের করোনা হবারই ছিল। কোন প্রটেকশন ছাড়াই তাঁদের রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে জনগণকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়িতে পাঠাতে। লক্ষী জনতাকে বুঝালেই সোনামুখ করে তাঁরা বাড়িতে ফেরত যাবেন, এই হচ্ছে আমাদের সবার ধারণা।

প্রটেকশন ছাড়া ডাক্তাররা ফ্রন্ট লাইনে অনেক আগে থেকেই ছিলেন। যে কারনে একের পর এক হসপিটাল বন্ধের খবর আসছে। একের পর এক ডাক্তার কোয়ারেন্টাইনে যাচ্ছেন। নিউইয়র্কে একজন ডাক্তার প্রতিদিন একশোর বেশি রোগী দেখছেন। একজন ডাউন মানে আরেকজনের উপর রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়া। আল্লাহ মাফ করুক, বাংলাদেশের অবস্থা নিউইয়র্কের মতন হলে আমাদের একেকজন সাধারণ ডাক্তারকেই প্রতিদিন হাজার খানেক রোগী দেখতে হবে।

কারন করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু আসবে, সাথে অন্যান্য সাধারণ রোগতো আছেই। এই সময়ে একেকটা ডাক্তার, নার্স ডাউন হতে থাকলে আমরা চিকিৎসা করাবো কাদের দিয়ে? পুলিশ, ডাক্তার, আর্মি, বা অন্যান্য পেশাজীবী, যারা আমার ফ্রন্ট লাইন যোদ্ধা, তাঁদের একেকজনের হার মানে ভাইরাসের কাছে আমাদের গণ পরাজয়। সামনে আমাদের মহা গজব অপেক্ষমাণ, আল্লাহ মাফ করুক।

এদিকে ট্রাম্প আংকেল চিন্তাভাবনা করছেন লকডাউন তুলে নেয়ার। কারন আমাদের পয়সা শেষ হয়ে আসছে, গত দশ বছরে অর্থনীতি যেভাবে এগিয়েছিল, বেকরত্বের হার রেকর্ড পরিমান নেমে গিয়েছিল, সেখানে মাত্র এক মাসের ব্যবধানেই অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে বেকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের ইকোনোমি শেষ। একে খানিকটা প্রাণ দিতেই ট্রাম্পের এই সুইসাইডাল চিন্তাভাবনা। হয় না খেয়ে মরবি, নাহয় অসুখে মরবি। কিন্তু মরতে তোকে হবেই। এই হচ্ছে আপাতত প্ল্যান।

সবাই আশায় আছেন দ্রুত অ্যান্টি ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে যাবে। দেখুন, রিয়েলিস্টিক্যালি চিন্তা করলে, যদি আজকেও ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়, তবু সেটা পুরো মার্কেট পেতে খোদ আমেরিকাতেই তিন মাস সময় লাগবে। গোটা বিশ্বের কথা তাহলে অনুমান করে নিন। এখন কবে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে, কবে পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে একে নিরাপদ ঘোষণা করে বাজারে ছাড়া হবে - সেতো অনেক দূরের পথ।

সুখের ব্যাপার হচ্ছে, আমরা কোনপ্রকার চেষ্টাই বাদ দিচ্ছি না। যে যেভাবে পারছে, সেভাবেই এর বিরুদ্ধে লড়ছেন। দেখলাম এক রাস্তায় পোর্টেবল চেম্বার বানানো হয়েছে। যার মধ্যদিয়ে মানুষ গেলে বৃষ্টির মতন জীবাণুনাশক স্প্রে করা হবে এবং মানুষটি জীবাণুমুক্ত হয়ে বের হবে। খুবই ভাল উদ্যোগ। তবে এর সমস্যা একটাই। এটি কেবল আপনার পোশাকের জীবাণু মারতে পারবে, আপনার শরীরের ভিতরের করোনা ভাইরাসের কিছুই হবেনা। আপনি এই চেম্বার থেকে বেরিয়ে এসে পাশেরজনের গা ঘেঁষলেই বেচারা আক্রান্ত হয়ে যাবেন। শুনতে খারাপ লাগলেও এটিই সত্যি।

হাত ধোয়ার বেসিন বসানোর ব্যাপারটাও তাই। আপনি সাবান দিয়ে হাত ধোন, কোনই সমস্যা নাই। কিন্তু করোনা রোগীর সাথে মেলামেশা করলে আপনার শরীরে করোনা ঢুকবেই। সে নিজের নিজের পথ খুঁজে নিবে। এবং সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার, না আপনি, না করোনা রোগী স্বয়ং, কেউই জানবে না তাঁরা এই ভাইরাস আদান প্রদান করছেন। প্রথম চৌদ্দদিন হয়তো বুঝতেও পারবেন না এই ভাইরাস আপনার শরীরে বসত গেড়েছে।

তাহলে এখন উপায়? উপায় এখন একটাই। টাইট হয়ে বসে থাকেন। বাড়িতে চারপাঁচজন মিলে থাকেন, এক বেডরুমের বাসা। ঘিঞ্জি বাড়ি। দম বন্ধ লাগে। মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে চান। কিন্তু উপায় নেই। যেভাবেই হোক, বাড়িতে থাকেন। ভেবে নিবেন বাইরে বোমা হামলা চলছে। বা গোলাগুলি চলছে। বেরুলেই গুলি খেয়ে মরবেন। কাজেই, সাবধান। বাড়িতে থাকুন।

কালিজিরা খেলে, গরুর পেশাব খেলে, খেজুর খেলে, গরম পানি খেলে, গাঞ্জা খেলে, এলকোহল খেলে, ম্যালেরিয়ার ওষুধ খেলে, রসুন খেলে, জমজম পানি খেলে, হুজুরের পানি পড়া খেলে, বিলেত প্রবাসী কোন মাতবরের নিজস্ব ফর্মূলার ওষুধ খেলে ইত্যাদি ইত্যাদি প্রেসক্রিপশন, যা এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়নি, সেটা অন্ধবিশ্বাসে খেয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরতে বের হবেন না প্লিজ।

মাথায় রাখুন, মরলে আপনি একা মরবেন না। পুরো পরিবার নিয়ে মরবেন। এবং তারচেয়ে বড় কথা, আল্লাহকে পরীক্ষা করার দুঃসাহস এখানে দেখাতে যাবেন না। যে হুজুর বলেছিল, "এই দোয়া পড়ে বাইরে বেরুবেন, করোনা আপনাকে ধরলে কুরআন মিথ্যা হয়ে যাবে" কিংবা "এটি ইহুদি খ্রিষ্টানদের উপর গজব, মুসলমানদের কিছু হবেনা" অথবা করোনার ইন্টারভিউ নেয়া অমন ভন্ড, মূর্খ, ধর্মব্যবসায়ীদের কথা শুনে কতজন ইতিমধ্যেই মারা গেছেন, সেটার হিসেব করুন। আপনি কেন সেই তালিকায় নিজের গুষ্ঠি সহ নাম লেখাবেন?

ইন্ডিয়ার কেরালার দিকে তাকান। শ্রীলংকার দিকে তাকান। তাকান ভিয়েতনামের দিকে। চীনের প্রতিবেশী তাইওয়ানের দিকেও একটু নজর দিন। ওরা কেউ ধনী রাষ্ট্র না। অথচ বুদ্ধিমানের মতন শুরু থেকেই সাবধান ছিলেন বলে আজকে ওদের দিকে তাকিয়ে ইউরোপ আমেরিকা হিংসায় পুড়ছে। এখন হাত কামড়ে আমরা বলছি, আহারে, তিনটা মাস সময় পেয়েছিলাম! আহারে! 

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা