এই যে সকল পেশার মানুষ পরস্পরের প্রতি চূড়ান্ত অশ্রদ্ধা, ঘৃণা এবং আক্রমনাত্মক মানসিকতা পোষণ করতে থাকেন, প্রচার করতে থাকেন, প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন। কাদা ছোড়াছুড়ি করতে থাকেন। এতে দীর্ঘমেয়াদে একটি ক্ষতি হয়। কী সেটা জানেন?

বাংলাদেশে কোন পেশাটা আসলে ‘ভালো’? এই প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ঘুরেছি দীর্ঘকাল। তারপর যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি তা হচ্ছে এদেশে ব্যংকাররা মূলত সুদখোর, ডাক্তাররা কসাই, সাংবাদিকরা সাঙ্ঘাতিক, পুলিশরা অসততা-অন্যায়ের চূড়ান্ত, লেখক-কবি-অভিনেতারা দুশ্চরিত্র, সরকারি আমলারা দুর্ণীতিবাজ, উকিল-জজ অসৎ, শিক্ষকরা ফাঁকিবাজ, এনজিও কর্মীরা ধান্ধাবাজ- ধর্মবিদ্বেষী, হুজুররা ধর্মব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদরা? আর না বলি...


মানে এমন কোনো পেশা নেই, যে পেশা মূলত সম্মানজনক কিংবা ন্যায়নিষ্ঠ কিংবা সততার প্রতিভূ। প্রশ্ন হচ্ছে কেনো নেই? এই না থাকার পেছনে যদি একটিমাত্র কারণও বলতে বলা হয়, তাহলে সেই কারণটা মূলত 'আমি'। এখানে আমি বলতে আমরা প্রত্যেকেই। প্রত্যেক ইন্ডিভিজ্যুয়াল।

কারণ, এই যে ব্যাংকার, ডাক্তার, পুলিশ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ যত পেশা আছে তার কোনো না কোনোটিই আমার কিংবা আপনার পেশা। এখন আমার পেশা যদি সৎ না হয় তাহলে সেই দায় আমার পেশার নয়, মূলত আমার। কারণ, পেশার ক্ষমতা নেই নিজে নিজে সৎ বা শ্রেষ্ঠ হওয়ার, তার হাত-পা নেই, মগজ নেই, চিন্তা নেই। কিন্তু সেই সৎ হওয়ার ক্ষমতা আছে 'পেশাদার'-এর, অর্থাৎ ওই পেশার মানুষটির। তার মানে দাঁড়ালো, পেশা কখনো সৎ-অসৎ বা ভালো-মন্দ হয়না, হয় সেই পেশার মানুষটি।


এবার প্রশ্ন হচ্ছে দেশের সব পেশাই কেনো খারাপ? কিংবা আদৌ খারাপ কিনা? এই প্রশ্নেরও নানামুখী বাস্তবভিত্তিক নিষ্ঠুর ব্যাখ্যা আছে। তবে সেসব ব্যাখ্যায় না গিয়ে অন্য একটি প্রসঙ্গে আসি। সেটি হচ্ছে, পেশা হিসেবে একজন পুলিশের কাছে কি পুলিশ খারাপ? উত্তর হচ্ছে, না। কারণ, তিনি সেই পেশার একজন কর্মী। তার যুক্তি, উপলব্ধি কিংবা বাস্তবতায় একজন পুলিশ চূড়ান্তভাবে অবহেলিত, অমূল্যায়িত, ‘মিস-জাজড’। তাহলে একজন পুলিশ কার কাছে খারাপ?


একজন পুলিশ খারাপ তিনি ছাড়া বাকী আর সব পেশার মানুষের কাছে। তারা নির্বিচারে পুলিশ মাত্রই খারাপ, এটি সবিস্তারে বর্ণনা, প্রচার, প্রসার করতে থাকেন। যেন জগতে একটিও ভালো পুলিশ নেই। কিংবা যারা পুলিশে চাকুরি করেন, তারাও কোনো পরিবার থেকে আসেননি। তাদের ন্যায়-অন্যায় বোধ নেই। ভালো-মন্দের অনুভব নেই। কোনো একজন পুলিশও জীবনে একটা ভালো কাজও করেননি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ঠিক এই একই ধারণা একজন ডাক্তার সম্পর্কেও। ডাক্তাররা অসৎ, কসাই ইত্যাকার নানান অভিধায় অভিধিত। প্রশ্ন হচ্ছে, এটি ঠিক কার কার ধারণা? নিশ্চয়ই একজন ডাক্তারের চোখে নয়? একদমই না। একজন ডাক্তার কিংবা পেশা হিসেবে ডাক্তারিও মূলত তারা ছাড়া অন্যান্য সকল পেশার লোকেদের কাছে অতি অতি খারাপ।

সবচেয়ে নিকৃষ্ট পেশার একটি। যেন একজন ডাক্তারও তার জীবদ্দশায় কোনো ভালো কাজ করেন নি। একজন মানুষকেও বিনামূল্যে চিকিৎসা দেননি। ভালোবাসেন নি। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসংখ্য মানুষের জীবন বাঁচাতে রুখে দাঁড়ান নি!

ঠিক এই একই ধারণা প্রত্যেক 'প্রফেশন' সম্পর্কে অন্য প্রফেশনের মানুষের। ডাক্তাররা যেমন কেবল তাদের প্রফেশনই সবচেয়ে 'মিস-জাজড' বা 'অন্যায় মূল্যায়নের' স্বীকার বলে সারাক্ষণ প্রবল মনোবেদনায় ভোগেন। ঠিক তেমনি একই মনোবেদনায় ভোগেন পুলিশ, ব্যাংকার, সাংবাদিক, এনজিওকর্মী থেকে শুরু করে সকল পেশার লোকেরা।

গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রত্যেকেই যেমন ভাবেন তার প্রফেশনই সবচেয়ে অবহেলিত, সবচেয়ে অবমূল্যায়িত, সবচেয়ে কষ্টের, সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত। আবার ঠিক তেমনি এই প্রত্যেকেই কেবল তার পেশা ছাড়া বাদবাকি আর সকল পেশা সম্পর্কেই কম বেশি প্রবল নেতিবাচক, অসম্মানজনক, অশ্রদ্ধাপূর্ণ ধারণা পোষণ করেন। শুধু যে পোষণ করেই ক্ষ্যান্ত হন তা-ই না, সেটি ক্রমাগত তাদের আচরণে, বক্তব্যে, ব্যবহারে প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন।

এতে দেশের সকল পেশার মানুষই তাদের নিজেদের ভাবতে থাকেন সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন, সবচেয়ে প্রান্তিক, সবচেয়ে ত্যাগী অথচ অবমূল্যায়িত, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা পেশার মানুষ। ফলে সে তার কমিউনিটির বাইরের আর সবাইকে তার প্রতিপক্ষ, সুবিধাভোগী কিংবা অগুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করে। আর এই ভাবনার ফলে তার নিজের পেশার বাইরে আর সব পেশার প্রতি, আর সব পেশার মানুষের প্রতি সেও ক্রমাগত বিষোদগার ছড়াতে থাকে।

যার ফলশ্রুতিতে সকল পেশা কিংবা সকল পেশার মানুষ পরস্পরের প্রতি চূড়ান্ত অশ্রদ্ধা, ঘৃণা এবং আক্রমনাত্মক মানসিকতা পোষণ করতে থাকেন, প্রচার করতে থাকেন, প্রতিষ্ঠিত করতে থাকেন। কাদা ছোড়াছুড়ি করতে থাকেন। এতে দীর্ঘমেয়াদে একটি ক্ষতি হয়। সেই ক্ষতিটি হচ্ছে আমরা পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রাপ্তি, সফলতা কেবল আমাদের নিজেদেরই থাকছে, পক্ষান্তরে অন্যের ঈর্ষার কারণ হচ্ছে।


আবার ঠিক একইভাবে আমাদের ব্যর্থতা, দুঃখ-দুর্দশা অন্য পেশার মানুষের কাছে আনন্দের কারণ হয়ে উঠছে। আঘাত করার মোক্ষম সুযোগ হয়ে উঠছে। কিন্তু আমরা যদি অন্যের পেশার প্রতি অশ্রদ্ধা এবং কেবল নিজের পেশাটাই সেরা, এই এককেন্দ্রিক ভাবনা না ভেবে অন্যের পেশার অপ্রাপ্তি, অসুবিধা, সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সহানুভূতিশীল হতাম, এবং তার সফলতা, ডেডিকেশন, কমিটমেন্ট, পরিশ্রম, ত্যাগকে সহাস্যে স্বীকৃতি দিতে পারতাম, তবে সেই পেশার মানুষটিও অনুপ্রাণিত অনুভব করতেন। অন্যের সম্পর্কেও তার শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব, আচরণ গড়ে ওঠার সুযোগ ছিলো।


এটি সার্বিকভাবেই একটি দেশের সকল পেশার সকল মানুষের জন্য খুবই জরুরী একটি ভাবনা। এই মুহূর্তে দেশ একটি ভয়াবহ সংকটকাল অতিক্রম করছে। এই সংকটে আমাদের সকল ধর্ম, বর্ণ পেশা নির্বিশেষে সকল মানুষের একই সাথে লড়তে হবে। সেই লড়াইয়ে সবার দৃশ্যমান কিংবা সরাসরি সক্রিয় অংশগ্রহণ সমান থাকবেনা। কিন্তু অদৃশ্য শক্তি কিংবা অনুপ্রেরণা হয়ে আমরা পাশে থাকতে পারি সেইসকল পেশার মানুষের, যারা এই মুহূর্তে নিজেদের জীবন বাজী রেখে সরাসরি সশরীরে এই লড়াইয়ে শামিল হয়েছেন।

আমরা তাদের নিরাপত্তার জন্য সোচ্চার হতে পারি। তাদের সাহস যোগাতে পারি। ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী সহ যে সকল পেশার মানুষ এই মুহূর্তে এই ভয়াবহ লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি। বলতে পারি, আমরা আপনাদের পাশে আছি। এই যুদ্ধ আমাদের, তবে এবার এই যুদ্ধের সেনাপতি আপনারা।

কিন্তু সহযোদ্ধা হয়ে আমরাও আপনাদের পাশেই আছি। পরবর্তিতে অন্যকোন লড়াইয়ে হয়তো সামনের সারিতে থাকতে হবে আমাদের। নিশ্চয়ই তখন এভাবেই পেছনের সারিতে সহযোদ্ধা হিসেবে আপনাদেরও আমরা পাশে পাবো। কারণ প্রতিটি যুদ্ধই আমাদের সকলের। আমরা সকলে মিলেই সেই যুদ্ধে জয়ী হবো। হবোই...

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা