আমরা বর্তমানে যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ বা উপভোগ করি সেগুলোকে আমরা 'ফর গ্রান্টেড' ধরে নেই। যে চিকিৎসাব্যবস্থা আমাদের সুস্থ রাখছে, আয়ু বাড়িয়ে দিচ্ছে সেটা হঠাৎ করে আসেনি, এটা বহু যুগ ধরে মানুষের সম্মিলিত জ্ঞানচর্চার ফল। নিঃসন্দেহে বলা যায়, যত সময় যাবে তত এই জ্ঞান সমৃদ্ধ হবে।

মহামারি মানুষের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মহামারির সাথে লড়াই করার সক্ষমতা বাড়ে আমাদের। এক সময় মহামারিকে স্রষ্টার অভিশাপ হিসেবে গণ্য করা হত। ধর্মীয় বইগুলোতেও মহামারিকে অবিশ্বাসীদের প্রতি শাস্তি এবং বিশ্বাসীদের জন্য পরীক্ষা হিসেবে বর্ণনা করা আছে। কারণ সেই সময় মানুষ ছিল অসহায়। হঠাৎ করে আসা এইসব মহামারি কেন হচ্ছে, সে সময়ের চিকিৎসা ব্যবস্থায় কীভাবে সেটা সামাল দেয়া যাবে, এটা অজানা ছিল মানুষের। তাই রোগের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া তাদের কাছে বিকল্প কোন পথ ছিল না।

কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে উন্নত চিকিৎসা ও গবেষণাব্যবস্থায় মানুষ জানে, রোগের উৎপত্তি কীভাবে ও কোথায় হচ্ছে। রোগের পিছনে কোন জীবাণু কাজ করছে সেটা বের করে সেটার জিনোম সিকোয়েন্স বের করে ফেলছে বিজ্ঞানীরা। চাইলে আপনিও গুগল করে এই ভাইরাসের গঠন প্রকৃতি দেখে নিতে পারবেন!

যেহেতু রোগ সৃষ্টির জীবাণু সম্পর্কে মানুষ জানে, তাই তারা এখন কাজ করছে এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য। কোন অলৌকিক সত্তার ঘরের দিকে নয়, বরং সারা পৃথিবীর মানুষ তাকিয়ে আছে পৃথিবীর কোন ল্যাব থেকে করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার হচ্ছে, সেই দিকে। মানুষ জানে, আজ হোক বা কাল, বিজ্ঞানীরা একটা উপায় বের করবেই।

বিজ্ঞানীরা এখন প্রতিষেধক আবিষ্কারের চেষ্টা করছে

আগেকার যুগের মতো মানুষকে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে হচ্ছে না। ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত কীভাবে এর বিস্তার রোধ করা যায় মানুষ সেটা জানে। আমাদের কাছে স্যানিটাইজার, জীবাণুনাশক আছে। ভাইরাসে আক্রান্তদের জন্য আছে চিকিৎসা ব্যবস্থা। প্রশ্ন করা যায়, তাহলে এত মানুষ অসহায়ের মতো মরছে কেন?

কল্পনা করুন মধ্যযুগের কোন একটা সময়। যখন যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল আজকের সময়ের তুলনায় অনেক সীমিত। সেই সময়েও কোন মহামারী ছড়িয়ে পড়তো দূর দূরান্তে। যারা আক্রান্ত হত তাদের বাঁচার সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। এখনকার যুগে মহামারিতে আক্রান্ত যে হাজার হাজার মানুষ সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরছে চিকিৎসার কল্যাণে, সেটা ওই যুগে সম্ভব ছিল না। তারপরেও যারা মারা যাচ্ছে বা চিকিৎসা পাচ্ছে না সেটা যতটা না আমাদের জ্ঞানের কমতির জন্য হচ্ছে, তার থেকে বেশি হচ্ছে রাজনৈতিক কারণে।

যেসব দেশে বিপর্যয় হচ্ছে, কেন হচ্ছে? কারণ তারা সবাইকে পর্যাপ্ত চিকিৎসা দিতে পারছে না। অর্থাৎ চিকিৎসা দিতে পারলে এই মৃত্যুহার আরো কমিয়ে আনা যেত। চিকিৎসা দিতে না পারার কারণ পর্যাপ্ত হাসপাতাল, হাসপাতালের সক্ষমতার অভাব, পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর বা আইসিইউ এর অভাব, জনপ্রতি চিকিৎসকের অভাব। আর অভাবের কারণ আমাদের জ্ঞানের স্বল্পতা নয়, বরং এর কারণ স্বাস্থ্যখাতে আমরা যথেষ্ট টাকা ব্যয় করিনি। দেশগুলো সামরিক খাতে, অস্ত্রশস্ত্র কিনতে যে ব্যয় করে, স্বাস্থ্যখাতে সেটা করে না। যদি আমাদের আরো বেশি পরিমাণে হাসপাতাল, আইসিইউ, ভেন্টিলেটর থাকতো, আরো বেশি রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা যেত।

লক্ষ করে দেখবেন, যেসব দেশ শুরু থেকে গবেষকদের কথা অনুযায়ী পদক্ষেপ নিয়েছে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে রোগিদের শনাক্ত করে আইসোলেটেড করেছে এবং যাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত তারাই সফলভাবে তাদের নাগরিকদের রক্ষা করতে পেরেছে। আর যারা ট্রাম্পের মতো গোঁয়ার্তুমি করেছে বা আমাদের মতো মধ্যযুগীয় স্টাইলে অলৌকিক সত্তার উপর সব দায় চাপিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছে এবং যাদের চিকিৎসা খাতের অবস্থা শোচনীয়, তারাই পড়ছে বিপর্যয়ের মধ্যে।

অব্যবস্থাপনার কারণেই মৃতের সংখ্যা বাড়ছে

কাজেই ভাইরাসের কাছে মানুষের পরাজয় ঘটেনি, পরাজয় ঘটেছে লোভ আর অব্যবস্থাপনার কাছে। মধ্যযুগে এই ভাইরাস আরো মানুষের প্রাণ নিত নিঃসন্দেহে। এখন আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা আছে, গবেষকরা আছে। এমনকি এই কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখার জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে! আপনাকে অজানা আতঙ্ক নিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে না দূর শহরে থাকা কোন স্বজনের জন্য। চাইলেই ভিডিও কল করতে পারছেন তাকে!

ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে আমাদের গবেষণা, শিক্ষা আর স্বাস্থ্যখাতে আরো ব্যয় বাড়াতে হবে। ভরসা করতে হবে বিজ্ঞানের উপর। আমাদের আস্থার জায়গা এগুলোই। করোনা কালে এটাই পৃথিবীর মানুষের সব থেকে বড় শিক্ষা।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা