এই দেশে করোনা কতটা মরণঘাতী হতে চলেছে তার আরেকটি গাণিতিক ব্যাখা।
করোনায় কমপক্ষে ১০০ জন আক্রান্ত হয়েছে এবং কমপক্ষে ৬ জন মারা গেছে এমন দেশগুলোর মধ্যে মাত্র ৯ টা দেশ আছে যেখানে সুস্থ হবার চেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন। নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, ব্রিটেন, সুইডেন, নরওয়ে, পর্তুগাল, হন্ডুরাস ও বলিভিয়ার সাথে তালিকায় আছে বাংলাদেশও।
ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, সুইডেন বা পর্তুগালে ঠিক কতজন সুস্থ হয়েছেন তার অথেন্টিক খবর নেই। ধারণা করা হয় সেখানে খুব বেশি মানুষ সুস্থ হোননি। এখানে লক্ষণীয় বিষয়, নয়টা দেশের মধ্যে ৬ টি দেশই ইউরোপের, যেখানে করোনা সবচেয়ে ভয়ানক ছোবল দিয়েছে। ২ টা আছে মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার। বাকি দুনিয়ার একমাত্র প্রতিনিধি বাংলাদেশ।
"আমাদের ইমিউনিটি খুব ভালো, আমরা ঢাকার মতো শহরে বাস করি। আমরা ড্রেনের বল তিন ড্রপ খাইয়ে পরিষ্কার করি"- করোনা দেশে আসার আগে এমন বহু আত্মবিশ্বাসী বক্তব্য দেখা গেছে। বাংলাদেশের মৃত্যু হার খুব সম্ভবত সেই আত্মবিশ্বাসকে ভেঙে দেবে।
পৃথিবী ব্যাপী টোটাল যে সংখ্যা তাতে রিকোভারির বিপরীতে মৃত্যুহার ২১%। আমাদের দেশে এই মুহুর্তে এটা আছে ৫৫% এ! বৃহত্তর চীন অঞ্চলে (চীন, হংকং, তাইওয়ান) করোনা প্রায় পরাজিত। ইতালি, স্পেনেও প্রকোপ সামান্য কমেছে। আশাবাদী মানুষ হিসেবে ধরে নেয়া যায় তারা ধীরে ধীরে করোনা জয় করে ফেলবে৷ ফ্রান্সে মৃত্যু কিছুটা কমছিল, গতকালকে রেকর্ড মৃত্যু আবার আশাহত করেছে। ইউকে, ইউএসএ, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগালের মতো দেশে এখনো গ্রাফ উর্ধ্বমুখী।
এশিয়া, আফ্রিকা, আমেরিকার প্রায় প্রতিটা দেশেই এখনো গ্রাফ উপরের দিকে উঠছে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রকোপ এসেছে প্রায় একই সময়ে। সুতরাং আমাদের দেশে করোনা নতুন, তাই মৃত্যু হার অন্যদের চেয়ে একটু বেশি- এটা ভেবে তৃপ্ত হওয়ার সুযোগ নেই।
কমপক্ষে ১০০ আক্রান্ত ও কমপক্ষে ৬ জন মারা যাওয়া দেশের সংখ্যা ১২৮। এই ১২৮ দেশের মধ্যে ক্লোজড কেসের মধ্যে ৫০% এর উপরে মৃত্যু হারের মাত্র ৯ টা দেশের একটা হওয়া গর্বের না, খুব বেশি আতংকের।
ভয় বাড়ানোর জন্য আরো একটা তথ্য দিই। আমাদের টোটাল কেস ১৫৭২। টোটাল কেসের হিসেবে আমরা তালিকার ৬৮ নাম্বারে আছি। (দুইদিন আগে ছিলাম ৮৪ তে)
যেহেতু টোটাল কেসে ৬৮ নাম্বারে আছি, তাই সাম্যবাদী হিসেবে মৃত্যু বা রিকোভারির তালিকায়ও আমাদের ৬৮ নাম্বার হওয়া উচিত। কিন্তু হিসেব তেমন না। মৃত্যুর তালিকায় আমাদের অবস্থান ৫২ নাম্বারে। সুস্থ হওয়া রোগীর তালিকায় আমাদের সিরিয়াল ১১৯। ব্যবধান ধরা যাচ্ছে?
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাপেক্ষেও আমাদের অবস্থান যথেষ্ট নাজুক। ভারতে ১৫১৪ জন সুস্থ হবার বিপরীতে মারা গেছে ৪২৩ জন। ক্লোজড কেসে মৃত্যু ২২%। (গড় ২১% এর কাছাকাছি)। পাকিস্তানে ১৬৪৫ জন সুস্থ হবার বিপরীতে মারা গেছে ১২৮ জন। ক্লোজড কেসে মৃত্যু হার ৭.২১%। আফগানিস্তানে ৫৪ জন সুস্থ হবার বিপরীতে মৃত্যু ৩০। ক্লোজড কেসে মৃত্যুর হার ৩৫.৭২%। শ্রীলংকায় ৬৮ জন সুস্থ হবার বিপরীতে মৃত্যু ৭৷ ক্লোজড কেসে মৃত্যুর হার ৯.৩৩%। নেপাল, ভুটান ও মালদ্বীপে কোনো মৃত্যুই নেই।
ভারত-পাকিস্তান-শ্রীলংকা এমনকি আফগানিস্তানের সাপেক্ষে আমাদের অবস্থা এত খারাপ হবার কারণ কী? খুব সহজে এর দায় ডাক্তারদের উপর ফেলা যায়। তবে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে দেখা যাবে এখানে ডাক্তারের ভূমিকা খুব বেশি নেই।
করোনার কোনো চিকিৎসা নেই, সবাই জানেন। এমন না যে ডাক্তার অপারেশন করলেন, রোগী সেরে উঠলেন। যত ভালো সার্জারী, যত ভালো মেডিসিন, তত বেশি সম্ভাবনা সুস্থ হওয়ার- এখানে এমন সুযোগ নেই। করোনা রোগীর সুস্থ হবার সবচেয়ে বড় নিয়ামক ভাগ্য- সন্দেহ নেই। কিন্তু তারপরেও আরো কিছু ব্যাপার জড়িত থাকে।
আপনি কত দ্রুত রোগী শনাক্ত করতে পারছেন, কত দ্রুত তাকে সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট দিচ্ছেন সেটা একটা বড়ো ফ্যাক্টর। তারপর আসে আইসিইউ-ভেন্টিলেটর ফ্যাসিলিটি। দেশে কয়টা আইসিইউ তৈরি আছে সেটা নিয়ে এখনো সবাই কনফিউজড। ভেন্টিলেটরের হিসেবে একেকবার একেক রকম শোনা যায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন ৫০০, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলে ২০০, আরেকজন বলেন দুইটা তথ্যই ঠিক।
এর মধ্যে খবর বের হয় ফরিদপুর মেডিকেলের সব ভেন্টিলেটর নষ্ট। (ঐ যে ৩৭ লাখ টাকার পর্দাওয়ালা মেডিকেল) খবর আসে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনই নাই। সিলেট মেডিকেলের মারা যাওয়া ডাক্তারের আইসিইউ এম্বুলেন্স না পাওয়ার খবর তো বাসি হয়ে গেছে। করোনা ও মৃত্যুর মাঝখানে ডাক্তারের পাশাপাশি এই জিনিসগুলো কিন্তু লাগে।
এ পর্যন্ত অসংখ্য খবর বের হয়েছে যেখানে মারা যাওয়ার পর রোগীর রেজাল্ট এসেছে পজেটিভ। বেঁচে থাকা অবস্থায় রোগীকে শনাক্ত করতে না পারা, চিকিৎসার আওতায় না আনতে পারা ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকেই নির্দেশ করে। করোনা ক্লিনিকালী শনাক্ত করা যায় না। জিহ্বা দেখে পেটে চাপ দিয়ে করোনা নিশ্চিত করা সম্ভব না। এক্ষেত্রে ল্যাব টেস্ট মাস্ট। ডাক্তার সাস্পেক্ট করতে পারেন, রোগীকে রেফার করতে পারেন। করোনা হাসপাতালে আসলে চিকিৎসা করতে পারেন।
কিন্তু হচ্ছে কী? টেস্ট কম হয়েছে শুরুর দিকে, পজেটিভ ধরা পড়েছে অনেক দেরিতে। রোগী তথ্য লুকিয়েছে। বিক্রমপুরী মুফতি সাহেব তিনটা হাসপাতালে তথ্য গোপন করে চিকিৎসা নিয়ে মারা গেছেন। রোগীরা হাসপাতাল ছেড়ে পালাচ্ছে। কেন তথ্য গোপন করে? কেন পালাচ্ছে? একটা কারণ তারা করোনা ব্যাপারে ঠিকমতো জানে না। আরেকটা কারণ হতে পারে হাসপাতাল তাদের জন্য ভীতিকর মনে হয়েছে। এর দায় কার?
প্রস্তুতি নেয়া হয়নি। প্রস্তুতি মানে কিন্তু খালি অনেক কিছু করা না, অনেক কিছু না করাও। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিশ্চয়ই কিছু মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। সেটা বন্ধ করে করোনার দিকে নজর দেয়া যেত। মুফতি ইব্রাহিম, তারেক মনোয়ার, আমির হামজা, কাশেমীরা মাইক ঝালাপালা করেছে...তাদেরকে থামানো হয়নি। সবাই জানত এরা ভুল বকছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। খালি জানত না প্রশাসন। এদের বক্তব্য লাখ না, কোটি মানুষকে প্রভাবিত করেছে। বিশ্বাস না হলে একবার র্যান্ডমলি রাস্তা ঘাটের ২০ জন মানুষের সাথে কথা বলেন, টের পাবেন।
এখনো মুফতি ইব্রাহিম ভিডিও করে, এখনো টিভি চ্যানেলে গিয়ে করোনা নিয়ে কথা বলে। কীভাবে সম্ভব? আমার মতো আমজনতা আজকে প্রধানমন্ত্রীকে গালি দিয়ে বাইরে থাকতে পারব? আইডি থাকবে? করোনা এখন বিশ্বযুদ্ধের সমান সমস্যা। এই ব্যাপারে যারা ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে, মানুষকে বিভ্রান্ত করছে তাদের অপরাধ প্রধানমন্ত্রীকে গালি দেয়ার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি জঘন্য। কীভাবে ছাড় পাচ্ছে তারা? এটাও কি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা নয়?
মূল পয়েন্টে ফিরে আসি। মৃত্যুর হার ৫৫%, মনে রাখেন। মনে রাখেন ক্লোজড কেসে মৃত্যুর হারের দিক থেকে আপনি এশিয়া আফ্রিকার মধ্যে সেরা। করোনা চলে যাবার পর মৃত্যু হার হয়তো ৫৫% ছেড়ে নিচে নেমে আসবে। তবে ততদিনে হয়ত লাখ ছাপিয়ে কত কোটি মানুষ আক্রান্ত হবে তার হিসেব কিন্তু নেই। কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের নার্স খাবার না পেয়ে কান্নাকাটি করে ভিডিও করেন, হিসেব করেন করোনা হলে আপনার অবস্থা কেমন হবে।
হিসেব করেন ভেন্টিলেটরের, হিসেব রাখেন আইসিইউ এর। বেঁচে থাকলে ডাক্তারকে অনেক গালি দিতে পারবেন। আপাতত নিজের নিরাপত্তা নিয়েই ভাবেন। করোনা থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় করোনা হতে না দেয়া। ড্রেনের পানিতে বল তিন ড্রপ খাওয়াইছেন ভালো করেছেন, এখন বাসায় বসে থাকেন।
এক ৪০ দিন আগে পোস্ট দিয়ে বলেছিলাম, আমাদের খবর আছে। দেশ শ্মশান হতে পারে৷ কেউ কেউ বিশ্বাস করেন নাই। যারা করেছেন তারাও চোখ কপালে তুলে বলেছেন, তাই নাকি? আগে তো ভাবি নাই। মৃত্যু এখন দুয়ারে। ৫৫% পার্সেন্টকে ৫০% হিসেবেও যদি ভাবি, হিসেব ওয়ান ইজ টু ওয়ান৷ বাঁচা মরা কয়েন ছুঁড়ে ডিসিশন নেয়ার মতো। চেষ্টা আপনার।