নির্লজ্জ-ইতরের মতো আমরা নিজেদের কথাটাই ভাবছি শুধু, এটা একবারও ভাবছি না যে একটা মিথ্যা কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে, একজন ডাক্তার কোয়ারেন্টাইনে গেলে কতশত রোগী প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারে

সুনামগঞ্জের এক প্রসূতি মা জরুরী প্রসবকালীন চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সুনামগঞ্জে ডেলিভারী ট্রায়াল দিয়ে ব্যর্থ হবার পরে রোগীকে নিয়ে আসা হয়েছিল সিলেটে। হাসপাতালে তার সিজারিয়ান অপারেশন হয়েছিল। প্রসবের পরে করোনার উপসর্গ জ্বর ও শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে কোভিড ১৯ সাসপেক্ট হিসেবে টেস্ট করা হয় এবং রিপোর্ট পজিটিভ আসে। চিকিৎসা, অপারেশন, পোস্ট অপারেটিভ কেয়ার সহ চিকিৎসার প্রয়োজনে ১৯ জন চিকিৎসক উনার সংস্পর্শে আসেন। এই ঘটনায় ১৯ জন চিকিৎসক, ১৪ জন নার্স ও ১১ জন স্টাফ সহ মোট ৪৪ জন ফ্রন্টলাইন কোভিড-১৯ ফাইটারকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে।

না, সেই প্রসূতি মা’কে আমরা দোষ দিচ্ছি না। দোষটা তার স্বামীর। সেই ভদ্রলোক (!) সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জে ফিরেছেন। নারায়ণগঞ্জ- যে জায়গাটা করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে, শ’খানেক মানুষ আক্রান্ত হবার পরে পুরো জেলা লকডাউন হয়েছে, সেই মৃত্যুকূপ থেকে তিনি পরিবারের কাছে ফিরেছেন ভাইরাস নিয়ে, কোয়ারেন্টাইনের ধার না ধরে স্ত্রীর সংস্পর্শে এসেছেন, তাকেও আক্রান্ত করে ফেলেছেন।

সন্তান জন্মের মুহূর্তটা সব পিতার কাছেই খুব আকাঙ্ক্ষিত একটা সময়। নিতান্তই পাষণ্ড বা দায়িত্বজ্ঞানহীন না হলে সব পুরুষই তখন স্ত্রীর পাশে থাকতে চান। কিন্ত সেটা করতে গিয়ে স্ত্রীর জীবনটাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দিচ্ছেন কিনা, অনাগত সন্তানকে মেরে ফেলার রাস্তা বের করছেন কিনা- সেটা মাথায় রাখাও একটা সেন্সিবল মানুষের কর্তব্য। সুনামগঞ্জের সেই লোকটা সেই কর্তব্য পালন করতে পারলেন কোথায়?

তথ্য গোপন করে ডাক্তারদের বিপদে ফেলছেন রোগীরা

ওই লোকের আহাম্মকির কারণে তার স্ত্রী আক্রান্ত হয়েছেন, তাকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়েছেন ডাক্তার-নার্সসহ ৪৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী। এমনিতেই ডাক্তারের সংখ্যা হাতেগোনা, এর মাঝে এতগুলো ডাক্তার-নার্স এখন কোয়ারেন্টাইনে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন শুধু একজন মানুষের অপদার্থের মতো আচরণ করার কারণে- এটা কি মেনে নেয়া যায়?

গাজীপুর জেলা লকডাউন করা হয়েছে দু’দিন আগে। সেই লকডাউনের মধ্যেই এক শ্রীমান গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার লকডাউনকৃত এলাকা থেকে পালিয়ে চলে এসেছেন ময়মনসিংহে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি থেকে তাকে মেডিসিন বিভাগে ভর্তি দেওয়া হয় সম্ভবত গত পরশু বিকেল সাড়ে ৩ টা নাগাদ। এরপর উনি এদিক-সেদিক ঘুরে বেরিয়ে ৯-৯.৩০ নাগাদ ১৪ নং ওয়ার্ডে হাজির হয়েছেন। এই ৬ ঘন্টায় তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কি করেছেন সেটা  উনি ছাড়া কেউ জানেন না।

ওয়ার্ডে গিয়ে সেই রোগী জনাকয়েক ডাক্তারকে উনার হিস্ট্রি বলেছেন- ১ মাসের জ্বর, তল পেট ব্যাথা। একবারের জন্যও বলেননি যে তার কাশি আছে, তার বাড়ি লকডাউন করা, এমনকি করোনা সন্দেহে তার নমুনা পর্যন্ত কালেক্ট করে কোভিড পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে শ্রীপুর থেকেই। চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী সেই রোগীকে পেটের ব্যাথার জন্য আল্ট্রাসাউন্ড করানো হয় ওয়ান স্টপে। নিয়ে যাওয়া হয় হুইল চেয়ার বা ট্রলিতে লিফটে করে। তার আল্ট্রা করার পর ওই একই টেবিলে আরো কয়েকশো আল্ট্রা হয়েছে। ওই ট্রলি দিয়েও ২০-২৫ জন কমপক্ষে আনাগোনা করেছেন।

এরপর তিনি তো নিশ্চয়ই ওয়ার্ডে বিচরন করেছেন, টয়লেটেও গিয়েছেন। বেশ কয়েকজন ডাক্তার-নার্স তাকে দেখেছেন। তথ্য গোপন করে এভাবে চিকিৎসা পাওয়ার পর দ্বিতীয় দিন (গতকাল) জানা গেছে সেই রোগী কোভিড-১৯ পজিটিভ। উনিই শুধু নন উনার স্ত্রীও পজিটিভ। পেশায় গার্মেন্টস কর্মী ওই রোগীর তথ্য গোপনের কারণে এখন তিনি যে ওয়ার্ডে ভর্তি ছিলেন, সেই ওয়ার্ডের ৬ চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীসহ মোট ১৮ জনকে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া হাসপাতালের ১৪ নম্বর ওয়ার্ড লকডাউন করা হয়েছে। সেই ওয়ার্ডের ১২ জন রোগীকেও আলাদাভাবে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে।

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

এর আগে ঢাকার যাত্রাবাড়ির আজগর আলী হাসপাতালে শ্বাসকষ্টের কথা গোপন করে ভর্তি করা হয়েছিল মুফতি আবদুল্লাহ নামের এক ব্যক্তিকে। অথচ তিনি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন, যেটা পরে জানা গেছে। আজগর আলী হাসপাতাল থেকে স্বজনরা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানেও তারা করোনার লক্ষণগুলোর কথা কিছু জানাননি ডাক্তারদের। ফলে দুই হাসপাতালেই একাধিক ডাক্তার এবং বেশ কয়েকজন নার্স, যারা সেই রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন- তাদের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হয়েছে। এমন ঘটনা দেশের আনাচে কানাচে ঘটছে, একটা দুটো নয়, হিসেব কষতে বসলে শত শত উদাহরণ পাওয়া যাবে।

করোনার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে আমরা বারবার ডাক্তার-নার্স এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়র’ হিসেবে উল্লেখ করছি, আবার নিজেরাই এই ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়রদের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়ে দিচ্ছি। নির্লজ্জ-ইতরের মতো আমরা নিজেদের কথাটাই ভাবছি শুধু, এটা একবারও ভাবছি না যে একটা মিথ্যা কতটা বিপদ ডেকে আনতে পারে, একজন ডাক্তার কোয়ারেন্টাইনে গেলে কতশত রোগী প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হতে পারে।

সারাক্ষণ ‘আমি আমি আমি’ নিয়ে ব্যস্ত থাকা স্বার্থপর আমরা বুঝতে পারছি না, বা বোঝার চেষ্টাও করছি না যে, সত্য গোপন করে চিকিৎসা নিতে গিয়ে কীভাবে নিজেদের জালে আত্মঘাতি গোল দিচ্ছি বারবার। এমনটা চলতে থাকলে একের পর এক হাসপাতাল বন্ধ হবে, ডাক্তারেরা দলে দলে কোয়ারেন্টাইনে যাবেন। যুদ্ধের ময়দানে সৈনিকেরা থাকবেন না, আমাদের ফ্রন্টলাইন ওয়ারিয়রেরা অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকবেন বিছানায়, লাশের সারি কেবল দীর্ঘ হবে, সেই লাশ গোনার ধৈর্য্য আমাদের হবে তো?

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- ডা. জোবায়ের আহমেদ, ডা. আরিফ

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা