করোনার দিনগুলোতে মানসিকভাবে সুস্থ থাকার যত উপায়
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
করোনায় এই দুঃসময়ে মানসিক স্বাস্থ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঘরবন্দী এই সময়ে মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে কী করণীয়? কীভাবে নিবেন মনের যত্ন?
আমাদের সবার জন্যই গত একটা মাস খুব উদ্বেগের মাস ছিল। করোনা নিয়ে সিরিয়াস হবো কি হবোনা সেগুলো ভাবতে ভাবতেই করোনা আমাদের নিয়ে সিরিয়াস হয়ে গেছে। ঘরবন্দি জীবন কাকে বলে এবং কত প্রকার ও কী কী, সেটা গত দুই সপ্তাহে আমরা বুঝে ফেলেছি। অস্থিরতা, প্যানিক অ্যাটাক, চাকরি এবং ব্যবসায় লসের হতাশা, কাছের মানুষগুলোর পাশে না থাকতে পারার যন্ত্রণা এবং সেইসাথে ঘরবন্দি থাকার একটা প্যারার মধ্যে পরেছে সবাই। কী হবে, কী হচ্ছে, কবে শেষ হবে- ইত্যাদি প্রশ্নের ঝড় আমাদের মনকে শুধু অস্থির করেনি, দুর্বলও করে ফেলেছে। এর মধ্যেও কিছু মানুষ মিম করছে, গান বাজনা করছে, রান্না করে ছবি দিচ্ছে, দোয়া-দরূদ শেয়ার করছে, কেউ কেউ আবার ঘুমানোর সময় ছাড়া বাদবাকি পুরো সময়টা ফেসবুকে থাকছে। সবাই আসলে যার যার মতন করেই ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে থাকা এই দুর্যোগপূর্ণ সময়কে ডিল করছে।
এপ্রিল মাসের শুরুতে আমরা বুঝে গেছি করোনা একটা সিরিয়াস ঘটনা। এর থেকে নিজেকে বাঁচানোটাই এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ। আর যেকোনো যুদ্ধে সবার আগে এফেক্টেড হয় মানুষের মন। মানুষের মন বড়ই বিচিত্র। এই দুঃসময়ে আমাদের মন নানা রকম আচরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। কেউ শান্ত থাকবে, কেউ ঝগড়া করবে। আবার কেউ হয়তো কিছুই করবেনা, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে অধিক চিন্তিত হয়ে যাবে। করোনার প্রতিষেধক এবং প্রতিরোধক নির্ণয়ে যেমন সব জ্ঞানীগুণী গবেষকরা উঠে পরে লেগেছে, তেমনি এই করোনা আক্রান্ত সময়টুকু সবাই যেন মানসিকভাবে সুস্থ্য থেকে পার করতে পারে, সেজন্য নানান সাইকোলজিস্ট এবং বেহেভিওরালিস্টরাও (মানব আচরণ বিশেষজ্ঞ) অনেক লেখালেখি করছেন। এই সময়ে মনের সাথে সাথে আমাদের মানসিকতার যত্ন নেয়াও খুব জরুরি।
মানসিকতার যত্ন অনেকভাবে নেয়া যায়, আমি চারটি টিপস শেয়ার করছি। আমার মনে হয়েছে এই টিপসগুলো জেনে রাখা আমাদের সবার জন্যই সময়পোযোগী। এই টিপসগুলো যে কাটায় কাটায় ফলো করতে হবে তা নয়। তবে শুধু একটু মাথায় রাখলেই চলবে।
১। পটভূমি- যেকোনো বই, নাটক বা সিনেমার পটভূমি জানা এবং বোঝাটা খুব জরুরি, যদি সে সিনেমায় আপনি কোনোভাবে অংশগ্রহণ করেন। এর মানে এই না যে আপনাকে সিনেমায় অভিনয় করতে হবে বা আপনি পরিচালক। একজন দর্শক হিসেবেও আপনার পটভূমি বোঝার দরকার আছে। তাহলে পুরো বিষয়টা বুঝতে সহজ হবে। কী হচ্ছে, কীভাবে হলো ইত্যাদি কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপনার সময় নষ্ট হবে না।
করোনা আমাদের জীবনে একটা সিনেমার মতনই, তবে এই সিনেমায় আপনি না চাইলেও অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক। এই সিনেমার সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, এখানে ঠিকভাবে অংশগ্রহণ করতে না পারলে আপনি মরবেন এবং আপনার পরিবারকে মারবেন। সমাজ, দেশ বা পৃথিবীর কথা বাদ দিলাম, এগুলো অনেক ব্যাপক, অনেক বিস্তৃত। আপাতত আপনার জন্য ফোকাসটা হওয়া উচিত আপনি এবং আপনার পরিবার। করোনা সিনেমার পটভূমি হলো- এটা একটা ভাইরাস এবং এর সংক্রমণটা হয় মানুষ থেকে। মানুষের হাঁচি-কাশি এবং স্পর্শের মাধ্যমে।
পটভূমির যে অংশটা আপনাকে বুঝতে হবে, তা হলো- পৃথিবীতে এই মুহূর্তে টপ লেভেলর সায়েন্টিস্ট, মেডিকেল এক্সপার্ট আর স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের এবং প্রয়োগের জন্য দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা কাজ করছে। তাদের ঘুম-খাওয়া হারাম। সেক্ষেত্রে আপনার ঘুম-খাওয়া হারাম না করলেও চলবে। আপনি শুধুমাত্র আপনার এবং আপনার পরিবারের হাইজিনটা নিশ্চিত করেন। আর কিছু না।
Make your perspective narrow for the moment, focus on what you should know and you should be following. That’s all. Keep it there short and precise.
২। মিডিয়া কাভারেজ- আপনি যদি তিনবেলা টানা সাতদিন পোলাও-মাংস খান, তাহলে এই সুস্বাদু খাবারও বিস্বাদ আর বোরিং লাগবে। পেট খারাপও হতে পারে। কোনো কিছুই বেশি ভালো না। খাবারের সাথে সাথে করোনা বিষয়ক নিউজের জন্যও একটা ডায়েট চার্ট ফলো করুন। কোন খবর খাবেন এবং দিনে কয়বার খাবেন।
এটা কোনো ক্রিকেট খেলা চলছে না যে দিনে ঘন্টায় ঘন্টায় মৃত্যু বা আক্রান্তের সংখ্যার স্কোর দেখতে হবে আপনাকে। তাছাড়া সময়টা এমন যে, প্রতিদিন এর চিত্র পাল্টাচ্ছে। অতএব দিনে এক থেকে দুইবার খবর দেখুন এবং তা যেন বিশ্বাসযোগ্য মিডিয়া কভারেজ হয়। অতিরিক্ত খবর, ফেসবুকিং আপনার এংজাইটি তৈরী করবে। যেহেতু আমরা ইতিমধ্যে জানি যে, এই মহামারি বা এর প্রভাব কম করে হলেও আগামী ছয় থেকে বারো মাস থাকবে, তাই আপনার প্রতিদিনের উদ্বেগকে যদি এখন থেকেই কন্ট্রোল না করেন, তবে সেটা ক্রনিক এংজাইটি তৈরি করবে।
আল্লাহ না করুক আপনার করোনা যদি হয়েও যায়, অতিরিক্ত উদ্বেগ আপনার জন্য ক্ষতিকারক। এংজাইটি এমন একটা মানসিক রোগ, যা সবার আগে আমাদের শরীরে আঘাত করে। এটা আমাদের নিঃশ্বাস বা রেসপিরেটরি সিস্টেমকে ভয়াবহ দুর্বল করে দেয়। আর অন্যদিকে করোনা মোকাবেলার জন্য আমাদের ভালো রেসপিরেটরি সিস্টেম থাকা খুব খুব জরুরি।
তাই থানকুনি পাতা খাওয়া বাদ দিয়ে বরং অতিরিক্ত উদ্বেগ এখন থেকেই কন্ট্রোল করতে শিখুন।
You know what, even if you don’t watch the news, it will keep happening. You don’t have control over media coverages but you do have control on how much information you should be taking a day and this includes your facebook hours.
৩। অহেতুক অনুমান: বাংলাদেশে মে মাসের মধ্যে অর্ধেক জনসংখ্যা করোনায় আক্রান্ত হবে এবং পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি করোনা মৃত্যু এই দেশেই হবে। কারণ এই দেশের জনসংখ্যা বেশি এবং অধিকাংশ সবাই বোকা এবং গরিব।
কে দিয়েছে আপনাকে এই তথ্য? কোথায় পেলেন এই হিসাব? কেউ দেয়নি, এগুলো আপনার মনে মনে ধারণা। দুই দুই এ চার মেলানোর মতন ধারণা। আপনার ধারণায় এই মুহূর্তে আপনারই ক্ষতি সবচেয়ে বেশি হবে, তাই ধারণা করা বাদ দিন। বাংলাদেশে কতজন আক্রান্ত হবে, আপনি এই হিসাব করার কেউ না। এই হিসাবের জন্য অন্য লোক আছে। আপাতত আপনার হিসাব হলো, জরুরি কাজ ছাড়া বের হবেন না। বের হবার আগে সব জরুরি কাজগুলো আরেকবার হিসাব করুন তারপর বের হন।
আর করোনা ভাইরাস একটা অসাম্প্রদায়িক ভাইরাস। সে দেশ-জাতি-বর্ণ-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে আলিঙ্গন করেছে। আপনি কোন গোত্রের বা ধর্মের, সেটা নিয়ে করোনার তেমন মাথা ব্যথা নেই। তাই আপনার যদি ধারণা হয় আপনি বিশেষ ধর্মের বা গোষ্ঠীর বলে করোনা আপনাকে ছুবে না, তাহলে সেটা বোকামি। আপনি যে গোষ্ঠীর বা ধর্মেরই হন, যদি নিজেকে সুরক্ষা না করেন, তবে সে আপনাকে আক্রমণ করবে। নিজে বাঁচলে বাপের নাম। আপনি বাঁচলে আপনার জাতি, বর্ণ, গোষ্ঠী এমনেই বেঁচে যাবে।
৪। নীতিবোধ এবং সহানুভূতিসম্পন্ন- সময় যতই কঠিন হোক, মনে রাখবেন আপনার নীতিবোধই আপনাকে শেষ পর্যন্ত ভালো রাখবে, সুখী রাখবে। সুষ্ঠু নীতিবোধ এবং একে অপরের প্রতি সমবেদনা হলো অনেকটা 'ফিশ অয়েল ট্যাবলেটের ' মতন। যে ট্যাবলেট না খেলেও চলে, তবে প্রতিদিন যদি একটা খাওয়া যায় তবে এর সুফল বিপদে পাওয়া যাবে। সমব্যথী হয়ে, পজিটিভ থেকে, ভার্চুয়াললি একে ওপরের পাশে দাঁড়ানোটা এই সময়ে সবচেয়ে বেশি জরুরি।
আমরা সবাই আইসোলেটেড, সবাই। আমি অস্ট্রেলিয়ায় যেমন আছি, আপনিও বাংলাদেশে তেমনি আছেন। একা অথবা ঘরবন্দি কিংবা কে জানে, আমার মতন দুটোই। এই দুঃসময় আমাদের সবাইকে ছুঁয়ে গেছে। এই বন্দি জীবন আমাদের সবার জন্য ধার্য হয়েছে। তাই অনলাইন জগতে কেউ যদি শাড়ি পরে সেলফি চ্যালেঞ্জ করে বা তিনবেলা মজার মজার খাবার পোস্ট করে, তাহলে জানবেন, এই কাজগুলো করে সে তার মনের অবরুদ্ধ ভাব দূর করার চেষ্টা করছে। হয়তো আপনি মনে করেন- এই দুঃসময়ে শাড়ি-সেলফির দরকার নেই, কিন্তু সেটা কেবল আপনারই মনে হওয়া। আপনার যেটা ভালো লাগে সেটা করুন, সেই সাথে অন্যের ভালোলাগাকেও শ্রদ্ধা করুন।
যদি না করেন, তাহলে কার সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে জানেন? আপনার। কারণ আপনার মতামতের ধার এই অনলাইন জগতে কেউ দিবে না। ক্রমাগত আপনি এগুলো দেখতে দেখতে খেপে যাবেন, রেগে যাবেন। তারপর আপনার ঘরের ভেতর যে মানুষগুলো আছে, যারা আপনার আইসোলেশনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী, তাদের উপর সেই রাগ ঝাড়বেন। তারচেয়ে বরং নিজের একটা সেলফ কেয়ার রুটিন তৈরী করুন, পারলে ফেসবুকে কম যান, ফেসবুকের ভেতরের মানুষগুলোর উপর আপনার যেমন কোনো কন্ট্রোল নেই, তেমনি তাদেরকে অশ্রদ্ধা করার অধিকারও আপনার নেই।
আরো অনেক কিছু আছে যা আমাদের এই করোনার ক্রান্তিকালে মানসিকভাবে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করবে, যেমন- লাইট এক্সসারসাইজ, হেলথি ডায়েট, সন্তানের সাথে সময় কাটানো, ছবি আঁকা, গান গাওয়া ইত্যাদি যা এই মুহূর্তে আপনাকে ভালো রাখবে, আপনার মনের কার্যক্ষমতা বাড়াবে। তবে উপরের চারটা একদম সরাসরি আপনার লং টার্ম মানসিক স্বাস্থ্যের সাথে জড়িত। মানে করোনা চলে গেলেও, এই প্র্যাকটিস আপনার আজীবন কাজে লাগবে। সবাই সুস্থ্য থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন।
সোর্স: সাইকোলজি টুডে, ব্ল্যাক ডগ ইনস্টিটিউট, বিয়ন্ড ব্লু (সবগুলো অস্ট্রেলিয়ার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক এনজিও এবং অনলাইন প্রকাশনা )