কাবা গৃহের তাওয়াফ সাময়িক বন্ধ হওয়া কেয়ামতের লক্ষণ না। কাবা গৃহে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে, সাইক্লোন, টর্নেডো, অগ্নিকান্ড বা বন্যায় এই ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সেটাও কেয়ামতের লক্ষণ না।

কাবা ঘরের মসজিদ বন্ধ/ তাওয়াফ বন্ধ হওয়ায় লোকজন হাহাকার করছেন যে কেয়ামত সন্নিকটে!

কারন রাসূলুল্লাহর (সঃ) নাকি হাদিস আছে, কেয়ামত পর্যন্ত তাওয়াফ চলবে। ঝড় তুফান কোন কিছুই কখনই তাওয়াফ বন্ধ করতে পারবে না। ইত্যাদি ইত্যাদি।

হাদিসের কোনই রেফারেন্স নাই। থাকবে কিভাবে? হাদিসটাই যে ভুয়া। আমাদের রাসূলুল্লাহ (সঃ) কখনই এমন কথা বলেন নাই। বরং কেয়ামতের আগের কিছু লক্ষণ নিয়ে বর্ণনা করা হাদিসে তিনি বলেছেন, "কেয়ামতের আগে ইসলামের অবস্থা এমন হবে যে কাবা ঘর ভেঙে পড়লেও কারোর মনে কোন দাগ কাটবে না।"

মানে মুসলিমদের মধ্য থেকে দ্বীন উঠে যাবে।

দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।

ফাঁকা কাবা শরীফের ছবি শেয়ার করায় লোকজন আমাকে গালাগালি করছিল এই বলে যে আমি নাকি প্যানিক সৃষ্টির চেষ্টা করেছি, ফিৎনা ছড়িয়েছি, এবং ইসলাম বিরুদ্ধ কাজ করেছি। তাওয়াফ চলেছে দ্বিতীয় তলায়। এবং ইত্যাদি ইত্যাদি।

তারপরে যখন খোদ হারাম শফির কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করলো সব ধরনের ওমরাহ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তখনও এনারা থামলেন না। কারন, "নাহলে যে কেয়ামত চলে আসবে!"

এখন ঐতিহাসিক একটি সত্য তথ্য তুলে ধরি।

ইতিহাস অনুযায়ী কাবা ঘরের মসজিদ চল্লিশবার অফিসিয়ালি বন্ধ করতে হয়েছিল।

একটি যেমন ৮৬৫ সালে। ইসমাইল ইবনে ইউসুফ নামের এক উন্মাদ হজ্জ্বে এসে হাজারের উপর মানুষকে হত্যা করেছিল। সেই সময়ে কাবা টেম্পোরারিলি বন্ধ হয়।

কাবায় তাওয়াফ বন্ধ হয় ৯৩০ সালে। কারমাতিয়া নামের এক্সট্রিমিস্ট শিয়া গ্রূপ ছিল, যারা ঘোষণা দিয়েছিল যে কাবার চারদিকে তাওয়াফ করা জাহেলী আরবদের প্রথা, তাই ওরা কাবা ধ্বংস করতে আসে। লড়াই হয়, এবং ওরা কাবার সামনের কালো পাথরটি নিয়ে পালিয়ে যায়। ২২ বছর সেটা ওদের দখলে ছিল, এবং অদ্ভুত ব্যাপার হলো, ওরা ওটাকে ঘিরেই পূজা শুরু করে দিল। পরে এটিকে উদ্ধার করা হয়, এবং তারপর থেকে আবারও কাবার সামনে প্রতিস্থাপন করা হয়।

আবারও কাবায় তাওয়াফ বন্ধ হয়েছিল ১২৫৮ সালে। মঙ্গলরা তখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম। বাগদাদে দুই মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করে ফোরাত নদীর পানির রঙ পাল্টে ফেলেছিল। ইসলামের খলিফাকে হত্যা করে তারা। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কারোর সাহস হয়নি বাড়ির বাইরে এক কদমও ফেলার। তাই ওমরাহ এবং হজ্ব সেই বছরের জন্য বাতিল করা হয়।

১৮১৪ সালে প্লেগ ছড়িয়ে পরে এবং আরব অঞ্চলেই আট হাজারের উপর মানুষ মারা যান। সেই সময়ে কাবার তাওয়াফ বন্ধ করা হয়। ১৮৩১ ইন্ডিয়া থেকে কিছু হাজি, ওমরাহকারী এক ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে আসেন, যার ফলে কাবায় উপস্থিত এক তৃতীয়াংশ মানুষ সেই রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যান। আবারও কাবা বন্ধ করতে হয়।

১৮৯২ কলেরা ছড়িয়ে পরে। ১৯৭৯ সালে সন্ত্রাসী হামলা ঘটে। এইভাবে ১৯৮৭ সর্বশেষ ম্যানেনজিসাইটিস আউটব্রেক ঘটে, এবং কাবা বন্ধ করা হয়। এছাড়াও কাবা গৃহে অগ্নিকাণ্ডের ফলেও কাবা তাওয়াফ বন্ধ ছিল।

জনশূন্য কাবা ঘর

তারমানে দেখা যাচ্ছে, নানান কারণেই ইতিহাসে বিভিন্ন সময়ে কাবা তাওয়াফ বন্ধ করতে হয়েছে। তার মানে, ভবিষ্যতেও বহুবার বন্ধ করা হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন? যেই আল্লাহ এত সর্বশক্তিমান, তিনি কেন তাঁর ঘরকে প্রটেক্ট করেন না? আবাবিল পাখি পাঠাবার ঘটনাতো আমরা কুরআনেই পাই।

দেখুন, আপনার যদি এই ধারণা হয়ে থাকে, তাহলে আপনার ঈমানে সমস্যা আছে। মানে, ইসলাম সম্পর্কে আপনার পূর্ণাঙ্গ ধারণা নেই বলেই এমন চিন্তা আপনার মাথায় আসছে। ইসলামের মূল ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়, তাঁর শরিক কেউ নেই। এই বাক্য আমরা সবাই জানি, মানি, কিন্তু উপলব্ধি করছি না। এই বাক্যের মানে আল্লাহ ছাড়া পৃথিবীর ও পৃথিবীর বাইরের সবকিছুই নশ্বর। আর কারোরই কোন ক্ষমতা নেই। না নবীর (সঃ), না কাবা গৃহের, না কোন আসমানী ফেরেশতার, না অন্য কারোর। সব ক্ষমতার মালিক আল্লাহ নিজে। এই ব্যাপারটি আপনাকে বুঝতেই হবে। কারন এটি না বোঝার কারণেই যেদিন আমাদের নবী (সঃ) মারা গেলেন, সেদিন মদিনার মুনাফেকরা বলতে শুরু করেছিল এ কেমন নবী যে মারা যায়? ওদের বিশ্বাস ছিল যেহেতু আল্লাহ একজনকে নবী নির্বাচন করেছেন, তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন, জরামুক্ত থাকবেন, অসুস্থ হবেন না, ক্ষুধা তৃষ্ণা ইত্যাদি কিছুই পাবে না ইত্যাদি।

আমাদের ধর্ম এটি শিক্ষা দেয় না। আমাদের নবী একজন মানুষ ছিলেন, যাকে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন তাঁর বাণী প্রচার করতে। রাসূলের কোন ক্ষমতা ছিল না কাউকে মুসলিম বানাবার। যে কারনে পৃথিবীতে তাঁর সবচেয়ে আপন মানুষ, প্রিয় ব্যক্তিত্ব আবু তালিব মুসলিম হননি।

রাসূলকেও যুদ্ধের সময়ে লড়তে হয়েছে, খন্দকের যুদ্ধে পরিখা খনন করতে হয়েছে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় পেটে পাথর বাঁধতে হয়েছে। এসবের পেছনে কী কারন ছিল? যাতে লোকে তাঁর পূজা শুরু করে না দেয়। যদি দেখা যেত লোকজন ক্ষুধায় মরছে, এবং রাসূলুল্লাহ (সঃ) হাওয়া থেকেই পোলাও কোর্মা রোস্ট নামিয়ে দিচ্ছেন, তাহলে লোকে তাঁর পূজা শুরু করে দিত। হ্যা, মোজেজা ঘটেছে, কিন্তু সেগুলোও আল্লাহর নির্দেশেই, আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী। সর্বক্ষেত্রে ঘটেনি। এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছেনতো?

তেমনি কাবার ব্যাপারটিও তাই। আমাদের বুঝতে হবে কাবার কোন নিজস্ব শক্তি নেই, ক্ষমতা নেই। ওটা স্রেফ একটি ঘর। সব ক্ষমতা আল্লাহর, যিনি নির্দেশ দিয়েছেন বলেই আমরা ওখানে ওকে ঘিরে চক্রাকারে হাঁটি। লোকজন এইটাই মানতে পারেনা। ওরা কাবার গিলাফ ছিঁড়ে বাড়ি নিয়ে গিয়ে পানিতে ধুয়ে খায়। মানত করে, দোয়া করে, মাটিতে পড়ে গেলে তুলে মাথায় ঠ্যাকায়। লোকজন কাবার দিকে পা ফিরিয়ে শোয় না, পিঠ দেখিয়ে হাঁটে না। এমন অনেক কিছুই ঘটে যা অতি ভক্তির ফলে শির্কের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

লোকে কিছু চাইতে হলে, তওবা করতে হলে বা অন্য কোন নিয়্যত থাকলে কাবা ধরে কান্নাকাটি করে, যেন কাবায় আল্লাহ থাকেন, বা কাবাই আল্লাহ। অথচ নিজের বাড়িতেই তাহাজ্জুদ আদায় করে আল্লাহর কাছে চাইলেও যে আল্লাহ শোনেন, এই ব্যাপারটাই উপলব্ধি করে না। কাজেই, এইসব ঘটনায় আমাদের বুঝতে হবে কাবা গৃহের কোন ক্ষমতা নেই। মূল ক্ষমতা তাঁর মালিকের। এখন বুঝতে পারছেন?

আমাদের দেশে প্রায়ই এমন ছবি শেয়ার হতে দেখবেন যে সুনামিতে গোটা দেশ ধ্বংস হয়ে গেছে, কিন্তু মসজিদের কোনই ক্ষতি হয়নি। চকবাজারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মানুষ মরে গেছে, কিন্তু মসজিদের দেয়ালে কলেমা লেখার কিছু হয়নি বলে লোকে সুবহানাল্লাহ বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলছে। এরা যে কাবা ঘরের তাওয়াফ বন্ধ দেখলে হার্ট এটাক করবে, সেটাইতো স্বাভাবিক।

জেনে রাখুন, ইসলামের দৃষ্টিতে, আল্লাহর সৃষ্ট একজন মানুষের প্রাণের মূল্য, কাবা গৃহের হাজারটা ইটের মূল্যের চেয়ে বহুগুন বেশি। কাজেই, নির্বোধের মতন যা তা শেয়ার করার আগে বুদ্ধিবিবেচনা কাজে লাগাবেন।

শেষ করি নবীজির (সঃ) মৃত্যুর সময়ে আবু বকরের দেয়া দুই লাইনের দেয়া ভাষণ দিয়ে, যেখানে তিনি বলেন, "যারা মুহাম্মদের (সঃ) পূজা করতো, তাঁরা জেনে নিক তিনি মারা গেছেন। এবং যারা আল্লাহর ইবাদত করে, তাঁরা জেনে নিক আল্লাহ অবিনশ্বর, চিরঞ্জীব।"

কাবা গৃহের তাওয়াফ সাময়িক বন্ধ হওয়া কেয়ামতের লক্ষণ না।

কাবা গৃহে যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে, সাইক্লোন, টর্নেডো, অগ্নিকান্ড বা বন্যায় এই ঘর ক্ষতিগ্রস্থ হয়, সেটাও কেয়ামতের লক্ষণ না।

মুসলিম হলে অবশ্যই জেনে রাখবেন, সবই আল্লাহর হুকুমে হচ্ছে, সবকিছুর নিয়ন্ত্রনে তিনি আছেন, এবং সবই আমাদের শিক্ষার জন্যই হচ্ছে। কাজেই নিজের ঈমান তাজা করুন। ভুয়া আজগুবি কথাবার্তা শোনার অভ্যাস ত্যাগ করুন। মুসলিম হলে ইসলামকে সঠিকভাবে অনুধাবন করার চেষ্টা করুন।

বাকি আল্লাহ ভরসা।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা