করোনাভাইরাসের জীবদ্দশা কতক্ষণ? বাতাসে কতক্ষণ ভেসে বেড়াতে পারে এটি? কোনো দ্রব্য বা বস্তুর উপর কতক্ষন বেঁচে থাকে? কত সময় পর ভাইরাসটি নতুন করে আক্রান্ত করার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে?

অফিস-আদালত সব খুলে দিচ্ছে। যারা এতদিন বাসায় নিরাপদে অবস্থান করেছেন, বাধ্য হয়ে তাদেরও বাইরে বের হতে হবে এবার। শুধুমাত্র মাস্ক, গ্লাভস পরেই নিস্তার মিলবে না নতুন প্রজাতির (SARS-CoV-2) এই করোনাভাইরাস থেকে। প্রতিদিনই যেখানে শনাক্তের রেকর্ড ভাঙছে, সেখানে বাইরে বের হতে হলে প্রয়োজন বাড়তি সতর্কতা। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি,কাঁশি, লালার মাধ্যমেই সাধারণত ভাইরাসটি ছড়িয়ে থাকে৷ তাই আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ ছাড়া এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার চান্স খুব একটা নেই। প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ তো এড়িয়ে চলা যায় সামাজিক দূরত্ব মেইন্টেইনের মাধ্যমে, পরোক্ষ সংস্পর্শ এড়াতেই প্রয়োজন যত সতর্কতা।

আক্রান্ত ব্যক্তি যদি কোনো একটা জিনিস স্পর্শ করে, সেটি আবার সুস্থ কোনো ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে সুস্থ ব্যক্তিও আক্রান্ত হতে পারেন করোনায়। এটিই পরোক্ষ সংস্পর্শে আক্রান্ত হওয়া। আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো বস্তু স্পর্শ করার পর, যদি বস্তুটিতে করোনাভাইরাস থেকেও থাকে, একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা অতিক্রম করার পর ভাইরাস তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। অর্থাৎ, সেই বস্তুটি সুস্থ মানুষ স্পর্শ করলেও আক্রান্ত হবার ভয় নেই। 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি   

তো কথা হলো, করোনাভাইরাসের জীবদ্দশা কতক্ষণ? বাতাসে কতক্ষণ ভেসে বেড়াতে পারে এটি? কোনো দ্রব্য বা বস্তুর উপর কতক্ষন বেঁচে থাকে? কত সময় পর ভাইরাসটি নতুন করে আক্রান্ত করার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে? 

যেহেতু SARS-CoV-2 নতুন প্রজাতির ভাইরাস, এটি নিয়ে গবেষণা এখনো চলছে, এবং গবেষকেরা নিত্যনতুন সিদ্ধান্তে আসছেন এর জীবদ্দশার ব্যাপারে। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন  ও দ্য ল্যানসেট- এ দুটি স্বনামধন্য জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গবেষকরা  রুম টেম্পারেচারে বিভিন্ন তল বা পৃষ্ঠের উপর ভাইরাস নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। গবেষণা অনুযায়ী একেক তলের উপর একেক সময় ধরে বেঁচে থাকে ভাইরাসটি। 

প্লাস্টিক ও স্টেইনলেস স্টিল 

দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিনের গবেষণা অনুযায়ী ৩ দিন পরেই প্লাস্টিক ও স্টেইনলেস স্টিলের উপর থাকা করোনাভাইরাস তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু দ্য ল্যানসেটের গবেষণা বলছে ক্ষুদ্রাকারের করোনাভাইরাস প্লাস্টিক ও স্টেইনলেস স্টিল তলের উপর বেঁচে থাকতে পারে সর্বোচ্চ ৭দিন পর্যন্ত৷

অতএব, এটিএম কার্ড, পানির বোতল, লাইটের সুইচ, কম্পিউটার কীবোর্ড, মাউজ, দরজার হাতল, চাবি, লিফটের বাটন ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যবহার্য প্লাস্টিক ও স্টিলের জিনিসপত্র ব্যবহারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এগুলো নিয়মিত পরিস্কার রাখতে হবে এবং ধরবার পরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিতে হবে।

কাঁচ

দুই গবেষণাতেই দেখা গেছে কাঁচের উপর করোনার জীবনকাল সবচেয়ে বেশি, ৪দিন! মোবাইল, কম্পিউটারের স্ক্রিন, জানালার কাঁচ, আয়না, চশমা ইত্যাদি ব্যবহারে তাই সতর্ক হতে হবে। বিশেষ করে বাইরে বের হলে যেহেতু মোবাইল ফোন আর চশমা সাথেই থাকে, তাই বাসায় ফেরার সাথে সাথে এগুলোকে অবশ্যই স্যানিটাইজার দিয়ে তুলোর সাহায্যে ভাল করে স্যানিটাইজ করতে হবে। 

বাইরে থেকে এসে অবশ্যই মোবাইল ফোনের স্ক্রিন পরিষ্কার করতে হবে  

কাগজ

টাকা, পেপার, ম্যাগাজিন, টিস্যু- এগুলোর উপরও করোনা সর্বোচ্চ ৪দিন বেঁচে থাকতে পারে৷ তাই পেপার-ম্যাগাজিন-টাকা স্পর্শ করবার পর অবশ্যই হাত ধুতে হবে। এবং টিস্যু বাজার থেকে কিনে আনার অন্তত ৪দিন পর ব্যবহার করতে হবে, অথবা প্লাস্টিকে মোড়ানো থাকলে উপরের প্লাস্টিক ফেলে দিয়ে ব্যবহার করা যাবে।

তামা

তামার তৈরি জুয়েলারি, হাড়িপাতিল ইত্যাদি বাইরে থেকে ক্রয় করার অন্তত ৪ ঘন্টা পর এগুলো ব্যবহার করা নিরাপদ। অন্যথায় ডিসইনফেক্টেড স্প্রে দিয়ে এগুলোকে জীবানুনাশক করে তারপর ব্যবহার করতে হবে। 

বাতাস

আক্রান্ত ব্যক্তি যদি মুক্ত বাতাসে হাঁচি বা কাশি দেয়, তবে তার নাক-মুখ থেকে নির্গত হওয়া জলকণা বা ড্রপলেটের মাধ্যমে করোনাভাইরাস বাতাসে ছড়িয়ে পরে৷ অপেক্ষাকৃত ভারি ভাইরাসগুলো অভিকর্ষজ ত্বরণে মাটিতে পরে যায়, আর হালকা ভাইরাসগুলো ৩ ঘন্টা সময় পর্যন্ত বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। তবে সময়ের সাথে ভাইরাসগুলো নিচের দিকে নামতে থাকে এবং ভাইরাসের 'অর্ধ জীবন' বা 'হাফ লাইফ' টার্মের কারণে ভাইরাস সংখ্যাও কমতে থাকে।

কাপড়

করোনাভাইরাস যেহেতু বাতাসে ৩ ঘন্টা পর্যন্ত ভেসে থাকতে পারে, অতএব মাস্ক পরে নাক-মুখ দিয়ে ভাইরাস ঢোকা থেকে রক্ষা পেলেও কাপড়ে লেগে থাকতে পারে এটি। কাপড়ের প্রকৃতি ও বিভিন্নতার উপর নির্ভর করে এর উপর করোনার জীবনকালও বিভিন্ন হয়ে থাকে৷ নিশ্চিত করে তাই বলা যায়নি কাপড়ে কতক্ষণ বেঁচে থাকে করোনাভাইরাস। তবে সে সময়টা আনুমানিক ২৪ ঘন্টা ধরা হচ্ছে। 

তাই বাইরে থেকে বাসায় এসে সতর্কতার সাথে কাপড় পরিবর্তন করে শুকনা বালতি বা গামলায় রেখে কাপড়ের উপর জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে, অথবা অতি দ্রুত ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে। 

এছাড়া কাঠের উপর করোনাভাইরাস ২দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। বাড়ির আসবাবপত্র তাই নিয়মিত জীবাণুনাশক দ্রব্য দিয়ে মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।

মোদ্দা কথা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে, নিজেকে; ঘরকে। দরজার হাতল, নব, লিফটের বাটন, কলিং বেলের সুইচ- ইত্যাদি প্রতিনিয়ত পরিষ্কার করতে হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুকে যেহেতু চোখে দেখা যাচ্ছে না, এবং একমাত্র অস্ত্র যেহেতু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, সচেতন থাকা, তাই  বাড়তি সতর্কতায় কোনো আপোষ করা চলবে না। 

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা