গতকাল বকেয়া বেতনের দাবিতে গুলিতে নিহত হয়েছেন একজন পাটকল শ্রমিক। করোনার ক্রান্তিকালে তারা কী করে বেতন ছাড়া সংসার চালাবেন? তাদের কথা কি কেউ ভেবেছে? মাথার ঘাম পায়ে ফেলে করা তাদের এই উপার্জন, তাও পাচ্ছেন না।

দিনাজপুরের বিরল উপজেলায় বকেয়া বেতনের দাবিতে পাটকলশ্রমিকদের বিক্ষোভের সময় গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তির নাম সুরত আলী। আহত হয়েছেন ১০ থেকে ১২ জন। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ১০ টার দিকে ‌উপ‌জেলার বিরল ইউনিয়নের র‌বিপুর গ্রা‌মে পাটকলের প্রধান ফটকে এই ঘটনা ঘটে।

যে শ্রমিকদের কথা কেউ বলে না, সেই পাটকল শ্রমিকেরা নিজেদের দাবি নিয়ে অনশন করেছিলেন। কিন্তু, তাদের এই আন্দোলন যেন পাত্তাই পেলো না আমাদের নিত্যদিনকার নাগরিক সমাজে। আমরা কথা বলি কত কিছু নিয়ে, কিন্তু পাটকল শ্রমিকদের আর্তনাদ আমাদের কানে পৌঁছায় না।

পাটকল শ্রমিকদের জীবনে অস্থিরতা বিরাজ করছে অনেকদিন ধরেই। এর আগেও তারা আন্দোলনে নেমেছিলেন। এবারও নামলেন। নিয়মিত মজুরি পরিশোধ সহ ১১ দফা দাবি ছিল তাদের। তারা বলছেন, নিয়মিত মজুরি না পাওয়ায় তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ, ঘরভাড়া দিতে না পারা– এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন।

আমরণ অনশনে বসেছিলেন শ্রমিকরা। ঐ শীতের দিনে রাতে তারা দাবি আদায়ের জন্যে এইরকম কষ্ট করে গেলেন। কিন্তু, কারো কি মন গলেছে? বিবেকে ধাক্কা লেগেছে? তাদের ঐ ভোগান্তি এখনো চলছে। করোনাভাইরাসের ক্রান্তিকালে কালে তারা কী করে বেতন ছাড়া সংসার চালাবেন? তাদের কথা কি কেউ ভেবেছে? মাথার ঘাম পায়ে ফেলে করা তাদের উপার্জন, তাও পাচ্ছেন না।  

এই আহাজারি কি পৌঁছাবে নীতি নির্ধারকদের কাছে?

কারো মস্তিষ্কে অনুরনন তৈরি করতে না পারলেও জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে একজন শ্রমিকের। যেমন বাঁচানো যাচ্ছে না পাটকলগুলোকে, যেমন ধুঁকে ধুঁকে মরে যাচ্ছেন পাটকলের শ্রমিকরা। উল্লেখ্য, সব সেক্টরের মজুরি কমিশন থাকলেও নেই পাটকল কেন্দ্রিক মজুরি কমিশন। সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল কর্পোরেশন শ্রমিকদের জন্য জাতীয় মজুরি কমিশন ২০১৫ ঘোষণা করলেও তা বাস্তবায়ন হয়ে ওঠেনি এখনো।

বারবার পাটকল শ্রমিকরা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হচ্ছেন। তারও আগে আরো কয়েকদফা তাদের পথে নামতে হয়েছিল। তারা কি চান আসলে? খুব বেশি কিছু কি? শুধু তারা একটু বেঁচে থাকতে চান৷ তারা চান তাদের বকেয়া বেতনগুলো দেয়া হোক, তাদের মজুরিগুলো যথাসময়ে তারা পান। কিন্তু, এই দাবিগুলো বার বার বার জানিয়েও তারা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।

সরকারি পাটকলগুলোতেই কেন এই অচলায়তন? জানা যায় এখানেও দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার কারণে সরকারকে লোকসান দিতে হচ্ছে। এছাড়া সরকারি পাটকলে উৎপাদনশীলতা কম, যন্ত্রপাতিও অনেকদিনের পুরানো, নেই আধুনিকায়নের চেষ্টা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিজেএমসির পাটকলগুলোর লোকসানের পরিমাণ ছিল ৪৮১ কোটি টাকা। তার পর গত অর্থবছরে লোকসান হয়েছে ৪৬৬ কোটি টাকা। এবছরও ৬০০ কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা। কেন এভাবে লামসাম ভাবে চলছে সরকারি পাটকল? কেনো এতোগুলো শ্রমিকের জীবন এখনো অনিশ্চয়তায়?

একজন শ্রমিক সুরত আলীর মৃত্যু নাগরিক সমাজে আলোড়ন তুলতে না পারলেও, এই দেশে হাজার হাজার পাটকল শ্রমিকের জীবনের দুর্দশার প্রতীক এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুটি। কাঙ্ক্ষিত জীবন তাদেরকে রাষ্ট্র উপহার দিতে পারছে না, জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না বলে আজ পাটকল শ্রমিকদের পথে পথে ধুঁকতে হচ্ছে। জীবনের সাথে পাঞ্জা লড়ার এই খেলা থেকে কি রেহাই পাবেন পাটকল শ্রমিকেরা?


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা