করোনাভাইরাস অন্যান্য দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আর প্রস্তুতির পরীক্ষা নিচ্ছে, আর আমাদের দেশে পরীক্ষা নিচ্ছে মানবতার। করোনা ভয়াল রূপ ধরার আগেই সেই পরীক্ষায় আমরা ডাহা ফেল করে বসে আছি...

করোনাভাইরাসের এই সময়টায় আমাদের মানবিক হবার কথা ছিল। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার কথা ছিল। অথচ আমরা নিজেদের বিরুদ্ধে লড়ছি, ভাইরাসের আতঙ্কে আপনজনকে করে দিচ্ছি পর। নিরাপদ দূরত্বের সংজ্ঞাটা আমাদের কাছে পরিস্কার না একদমই, এক মিটারের জায়গায় আমরা তৈরী করছি আকাশ-পাতাল দূরত্বের। মানবতার গল্প শোনার কথা ছিল শত শত, অথচ রচিত হচ্ছে অমানবিক সব গল্প, হৃদয় ভেঙে দেয়া অজস্র আখ্যান। তেমনই একটা সত্যি ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলাম আমরা। টাঙ্গাইলের সখীপুরে করোনার আতঙ্কে রাতের বেলায় মাকে জঙ্গলে ফেলে গেছে সন্তানেরা- এর চেয়ে নির্মম ঘটনা আর কি হতে পারে? 

সখীপুর উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়ন এলাকায় শাল-গজারির বনে গতকাল গভীর রাতে পাওয়া গেছে বছর পঞ্চাশের এক মহিলাকে। চিৎকার করে কাঁদছিলেন তিনি, সাহায্য চাইছিলেন। তার চিৎকারে লোকজন জড়ো হয় দ্রুতই। সেই নারী উপস্থিত লোকজনকে জানান, গত কয়েকদিন ধরে তার ঠান্ডা-জ্বর এবং সর্দিতে ভুগছিলেন তিনি। এক ছেলে এবং দুই মেয়ে আছে তার, সবাই বিবাহিত। ছেলে, মেয়ে এবং দুই মেয়ে জামাই মিলে তাকে জঙ্গলে ফেলে গেছেন, তাদের সন্দেহ তার করোনা হয়েছে। বনের ভেতরে রেখে যাওয়ার সময় ছেলে তাকে বলেছেন, ‘মা, তুমি এই বনে এক রাত থাকো। কাল এসে তোমাকে নিয়ে যাব।’

ওই মহিলাকে উদ্ধার করা হয়েছে রাত দেড়টার সময়। মহিলার দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, কয়েকটা ঘন্টা একা তিনি পড়েছিলেন ওই জঙ্গলে। তারপর টিকতে না পেরে চিৎকার করেছেন, কেঁদেছেন, সাহায্য চেয়েছেন। তার চিৎকার শুনে মানুষ ছুটে এসেছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের খবর দেয়া হয়েছে, এসেছেন ইউএনও। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে উদ্ধার করে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

ঢাকায় এসেও হেনস্থা শেষ হয়নি ওই মহিলার। প্রথমে তাকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেয়া হয়েছে, কিন্ত তারা ভর্তি নেননি। পরীক্ষায় পজিটিভ প্রমাণীত রগী ছাড়া কাউকে ভর্তি নিচ্ছেন না তারা। করোনা টেস্টের জন্যে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ওই মহিলার, আজ সকাল সাতটায় তাকে ভর্তি করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, সেখানে আলাদা করে আইসোলেশনে রাখা হয়েছে তাকে। ওই নারীর জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি ও কাশি আছে বলে জানা গেছে।

করোনায় আক্রান্ত সন্দেহে এই নারীকে ফেলে গেছেন ছেলে-মেয়েরা

প্রথম আলোর সংবাদ মারফত জানতে পারলাম, ওই নারীর বাড়ি শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলায়। গাজীপুরের সালনায় একটি পোশাক কারখানায় ওই মহিলার এক ছেলে, দুই মেয়ে ও জামাতারা চাকরি করেন। সবাই মিলে সালনায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। ওই নারী সবাইকে রান্না করে খাওয়াতেন। কয়েক দিন ধরে ওই নারীর জ্বর, সর্দি, কাশি শুরু হলে আশপাশের বাসার লোকজন তাঁদের তাড়িয়ে দেন। একটি পিকআপভ্যান ভাড়া করে শেরপুরের নালিতাবাড়ী যাওয়ার পথে সখীপুরের জঙ্গলে সন্তানেরা মাকে ফেলে যান।

ভাবছি, ভাবনার খেই হারাচ্ছে বারবার, কূল-কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না কোন। সন্তান জন্ম দেয়ার সময় একজন মাকে যে প্রসব বেদনাটা সহ্য করতে হয়, সেটা নাকি শরীরের বিশটা হাড় ভাঙার যন্ত্রণার সমান। সেখানেই তো আর মায়ের দায়িত্ব শেষ না। রক্ত পানি করে সন্তানকে বড় করেন মা, হাঁটতে শেখান, কথা বলতে শেখান, খাবারের যোগানও দেন- সন্তানকে পৃথিবীর এই রঙ্গমঞ্চে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করতে করতে নিজের জীবনের সুখ-শান্তি সব বিসর্জন দেন।

আর তার বিনিময়ে মায়ের প্রাপ্তি কি? এমন অবহেলা? মা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তিনি সঙ্গে থাকলে তো আমাদেরও রেহাই নেই- এই আতঙ্কে মাঝরাতে বয়স্ক মাকে জঙ্গলে নিয়ে ছেড়ে আসা? এই মহিলার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে একটা কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি- করোনাভাইরাস অন্যান্য দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আর প্রস্তুতির পরীক্ষা নিচ্ছে, আর আমাদের দেশে পরীক্ষা নিচ্ছে মানবতার। করোনা ভয়াল রূপ ধরার আগেই সেই পরীক্ষায় আমরা ডাহা ফেল করে বসে আছি...

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা