এতদিন কী করেছে আমাদের প্রশাসন? একটা থার্ড ওয়ার্ল্ড দেশের মানুষের মগজে কিছু ঢুকানোর জন্য সময় লাগে। একদিনে আপনি একটা নোটিশ দেবেন আর মানুষ সেটা হজম করে ফেলবে, ম্যাজিক নাকি?

দূরের এক মসজিদে জুম্মার নামাজ পড়তে হয়েছে। গ্রামের মসজিদ। ট্যাপের ব্যবস্থা নাই। ছোট্ট একটা পুকুরের ৭-৮ ফুট লম্বা ঘাটে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে ওজু করছেন ১০ জন করে মানুষ। পেছনে আরো এক দুই সারি অপেক্ষমান। এই সিজনে এখনো বৃষ্টি হয়নি। পুকুরে পানি একেবারেই অল্প, হাঁটু কিংবা কোমর পানি হবে সর্বোচ্চ। ঘোলা শ্যাওলা জমা পানি। জুম্মার নামাজে আসা ৩০০-৪০০ মানুষ পালা করে ওজু করলেন এই পানিতে। গ্রামের দিকের মসজিদের জন্য এটা অতি পরিচিত দৃশ্য।

অন্য এলাকার মসজিদ। কোনো প্রবাসী হোম কোয়ারেন্টাইন ভেঙে নামাজ পড়তে এসেছে কিনা জানি না৷ আমি পুকুরে ওজু করলাম না৷ রাস্তার পাশের টিউবওয়েল এ কনুই চেপে চেপে ওজু সেরে নিলাম। আমি যখন টিউবওয়েলের হাতলে কনুই চেপে ওজু করছি তখন মসজিদে আসা প্রায় প্রতিটা মানুষ চোখ বড়ো বড়ো করে দেখছে আমাকে। পুকুর থাকার পরও কেউ একজন একা একা টিউবওয়েলে ওজু করছে এটা অস্বাভাবিক। কনুই দিয়ে হাতল চাপা তো আরো অস্বাভাবিক। সবার বিস্মিত চোখ একটা কথাই বলছিল, "এই মাল এলো কোত্থেকে!"

জানাজায় গিয়েছিলাম। জানাজা শেষে হুজুর মৃত্যু নিয়ে কিছুক্ষণ কথা বললেন। কথা প্রসঙ্গে চলে এলো করোনা ভাইরাস ইস্যু৷ হুজুর জানালেন সরকার থেকে জানানো হয়েছে মানুষকে যেন সচেতন করা হয়। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এক দেড় মিনিট কথা বললেন তিনি। তারপর দোয়া। দোয়ার এক পর্যায়ে করোনা থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর দয়া চাইলেন। তখনই ঘটল আজব এক সার্কাস।

একজন দোয়া ছেড়ে হাঁটা ধরল। তাকে দোয়া ছেড়ে যাওয়ার জন্য ধমক দিল অন্য একজন। দুইটা পক্ষ হয়ে গেল মুহুর্তেই। ব্যস! হাতাহাতি শুরু। "কোন হাদিসে আছে করুনা, কোন কোরানে আছে করুনার লাইগা দোয়া করতে হইব" "ঈমান ঠিক থাকলে করুনা না, করুনার বাপেও কিছু করতে পারব না।" "করুনার মায়েরে আমি *********" খিস্তি-পাল্টা খিস্তি, হুমকি-পাল্টা হুমকিতে জড়িয়ে গেল শখানেক মানুষ৷ পাশে একটা লাশ আছে সেটা মনেই রইল না কারো। আধা ঘন্টা চলল হাতাহাতি-গালাগালি৷ এমন গালিগালাজ আমার জীবনে খুব কম শুনেছি। রেকর্ড করে রেখে দিয়েছি ফোনে। মাঝে মাঝে বিস্মিত হবার দরকার পড়লে শুনব। তুমুল গালাগালির মধ্যেই লাশ নিয়ে গোরস্থানে চলে গেল মৃতের স্বজনরা। প্রায় লাশ নিয়ে পালিয়ে গেল।

না ভাই, এই মানুষজনদের প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নাই। একটা মহামারীকে সামনে রেখে যে তারা নির্বিকার সেটা নিয়ে তাদেরকে আমি দোষ দেব না। এসব মানুষদের একটা বড়ো অংশ দিন মজুর, অশিক্ষিত। তারা কীভাবে জানবে বাস্তব পরিস্থিতি? কীভাবে বুঝবে কত বড়ো বিপদ ঘরের দোয়ারে দাঁড়িয়ে? এই যে পশ্চাৎপদ মানুষজন, তাদের জন্য কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? তাদের কানে কেউ কোনো বার্তা দিয়েছে? আচমকা তারা দেখতে পাচ্ছে কেন জানি খেলার টুর্নামেন্ট বন্ধ, কেন জানি ওয়াজ মাহফিল বন্ধ। বাতাসে গুঞ্জন, মসজিদও বন্ধ হতে পারে যখন তখন।

এই মসজিদ বন্ধের গুঞ্জনের প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়ছে। আমার ব্যক্তিগত অবজারভেশনে দেখেছি, মসজিদ বন্ধ আর ওয়াজ বন্ধের প্রতিক্রিয়ায় মানুষ করোনা বিষয়ক সকল সতর্কতার ঠিক উল্টোটা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। "বাবারা, তোমরা আমাদের ধর্ম নষ্ট করতে আইবা, আর আমরা ছাইড়া দিমু ভাবছ?"

এতদিন কী করেছে আমাদের প্রশাসন? একটা থার্ড ওয়ার্ল্ড দেশের মানুষের মগজে কিছু ঢুকানোর জন্য সময় লাগে। একদিনে আপনি একটা নোটিশ দেবেন আর মানুষ সেটা হজম করে ফেলবে, ম্যাজিক নাকি? দেশের মানুষের মনে মগজে গেঁথে আছে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। প্রতিটা অণু পরিমাণ সমস্যায়ও মানুষ ভাবে কোনো না কোনো ষড়যন্ত্র হয়ে যাচ্ছে। মানুষের এই সাইকোলজি আগে বোঝা উচিত ছিল না?

প্রধানমন্ত্রীকে কটুক্তি করে ফোন হাত থেকে নামানোর আগে বান্ধা ধরা পড়ে যায়। অথচ দিনের পর দিন মুফতি ইব্রাহিম আর তারেক মনোয়ারের মতো বক্তা করোনা ভাইরাস নিয়ে যা খুশি বলেই গেল, কোনো ব্যবস্থা নেই। গ্রেফতারের দরকার নেই, কেবল উনাদের ডেকে নিয়ে সতর্ক করাও গেল না? আইটি বিভাগ ভিডিওগুলো সরাতে পারল না? পেজ ডিজেবল করা গেল না?

বলবেন সব রেখে উনাদের কথা কেন?

কারণ উনাদের কথা পাবলিক বিশ্বাস করে৷ দেশের সবচেয়ে ডিগ্রিধারী মানুষ, সবচেয়ে বড়ো স্কলার কোটি টাকার প্রোগ্রাম করে তার কথা যতজনের মাঝে পৌঁছাতে পারেন, তারেক মনোয়ার বা মুফতি ইব্রাহিমের একটা ভিডিও মানুষ রিচ করে আরো বেশি। দেশের মানুষজন যুগ যুগ ধরে দাঁড়ি-টুপি পরা যে কারো কথাকেই কোরান হাদিসের কথা ভেবে বিশ্বাস করে আসছে। এখনো করছে. এই যে মানুষ করোনার মা কে ডট ডট করছে, এই আত্মবিশ্বাস এসেছে কোথা থেকে? এই মানুষগুলো যা টুকটাক ফেসবুক চালায়, ইউটিউব দেখে তার বড়ো অংশ জুড়েই থাকে এমন ভন্ড হুজুরদের ওয়াজ। মানুষ কেন বিশ্বাস করবে না?

অনেক হুজুর দেরিতে হলেও ভালো ভালো কথা বলছেন। মাওলানা সাইফুল্লাহ'র কথা বলা যায়। উনাদের কথাগুলোকে কেন রাষ্ট্রীয়ভাবে পেন্ট্রোনাইজ করা হচ্ছে না? বাস্তবতা আপনাকে বুঝতে হবে। আমি যত বড়ো জ্ঞানী হই না কেন, পাবলিকের মাঝে গ্রহণযোগ্যতার বিচারে আমার মসজিদের ইমামের কাছে আমার কোনো বেইলই থাকবে না।

আজকে জুম্মাবার গেল। প্রতিটা মসজিদের ইমামরা যদি আজ খুতবায় করোনা ব্যাপারে ভাসা ভাসা সঠিক তথ্যগুলোও বলতেন, কোটি টাকার প্রচারণার চেয়েও এটা বেশি কাজ করত। এই ইমামদের সাথে সরকারের কেউ যোগাযোগ করেছেন?

নির্বাচন স্থগিত না করে, ডাক্তারদের প্রটেকশন না দিয়ে মসজিদ বন্ধের ঘোষণা করা সম্ভব না জানি। আপাতত খোলা থাকুক মসজিদ। মানুষ প্রার্থনা করে হলেও কিছুটা কন্সার্নড হোক। কিন্তু তারপরও তো কিছু কাজের সুযোগ ছিল। এই যে আগের মতোই দল বেঁধে যারা ওজু করলেন, পরিষ্কার ধারণা থাকলে হয়তো সবাই নিজের বাড়ি থেকে ওজু করে আসত। পুকুর বা টিউবওয়েল এখন সবার বাড়িতেই থাকে। বাড়িতে ওজু করা যাবে না এমন কোনো নিয়ম নিশ্চয়ই নেই। খুতবা সংক্ষেপ করা যেত। শুক্রবারের ওয়াজ প্রায় মেন্ডেটরিভাবে করা হয়, সেখানে দেয়া যেত দিক নির্দেশনা। মসজিদে হাঁচি কাশি দেয়াকে নিরুৎসাহিত করা যেত।

সব বাদ দিলাম। ন্যূনতম ধারণা যদি থাকত মানুষের মধ্যে, লাশ পাশে রেখে এতগুলো মানুষ মিলে করোনা নিয়ে এই সময়ে আধা ঘন্টা হট্টগোল করত না। কত কত কিছু কেবল আজকেই যে করার ছিল! এখন দুইটা পক্ষ দুইটা প্রশ্ন তুলবেন। এক পক্ষ বলবেন, এই কাঠ মোল্লারা লাইনে আসবে না। এরা উল্টাপাল্টা কথা বলেই যাবে। ভাই, আপনি তাদেরকে পরিস্থিতি ব্যাপারে বুঝিয়ে বলার কোনো উদ্যোগ নিয়েছেন কখনো? বিপর্যয় সামনে রেখে সরকার ডেকেছে তাদেরকে?

সবাই অবিবেচক না। বুঝিয়ে বললে অনেকেই বুঝতেন৷ এই বোঝানোটা আজকের জুম্মার এক ঘন্টা আগে না, কমপক্ষে এক মাস আগে থেকে দরকার ছিল। ২৫% হুজুরকেও যদি কন্সার্ন করা যেত, ২৫% বেশি মানুষ আজকে সচেতন হতো। কিন্তু আমার ধারণা ঘটনা ঘটেছে বিপরীত৷ সচেতনামূলক ওয়াজ যদি কোথাও কোথাও করা হয়ও, তথাকথিত "মসজিদ বন্ধের ষড়যন্ত্র" আর "করোনা বলে কিছু নেই" ধরনের ওয়াজ হয়েছে আরো বেশি। আরেকপক্ষ এতক্ষণে মাথা গরম করে হয়তো কমেন্ট করেই ফেলেছে, পাইছেন তো খালি মোল্লাদের। মুফতি ইব্রাহিম দেখলেন, মন্ত্রীদের দেখেন না? মোল্লাদের নিয়ে (ধর্ম নিয়ে, ইসলাম নিয়ে) চুলকাইতে আরাম লাগে?

ভাইলোগ, আমি কথা বলছি সোশ্যাল ইম্পেক্ট নিয়ে, বিশ্বস্ততা নিয়ে। বাংলাদেশের মানুষ মন্ত্রীদের কোনো কথাই বিশ্বাস করে না। ধরুন কোনো মন্ত্রী ক্যামেরার সামনে এসে কাতর স্বরে বলত, আমরা করোনা নিয়ে খুব ভয়ে আছি। দেশে অনেক করোনা রোগী আছেন। আমাদের সক্ষমতা কম। তবুও আমরা যত যা দরকার সব করব। কেউ বিশ্বাস করত এমন কথা? বলত, ওরে বাটপার, ওরে বাটপার। মানুষ যাকে বিশ্বাস করে, তার ওপর দায় ও দায়িত্ব বর্তাবে এটাই স্বাভাবিক না?

প্রসঙ্গ গ্রামের মানুষের সচেতনতা। এখন পর্যন্ত গ্রামে এসে মানুষের সচেতনতা দেখছি -২০%। হ্যাঁ জিরোর নিচে মাইনাস। এই মাইনাসটা হচ্ছে "আইসো আমাদের ধর্ম নষ্ট করতে! দেখি কেমনে করো..." দেশের ৮০% মানুষ থাকে গ্রামে। করোনা মোকাবেলায় এই হচ্ছে গ্রামের অবস্থা। গ্রামের মানুষকে আমি কোনোভাবেই দায় দিচ্ছি না। দায় সরকারের, দায় ২০ টা দেশ ঘুরে বিত্তশালী জীবন যাপন করে সব বুঝেও মানুষকে অজ্ঞ রাখার বিজনেসে থাকা আলেমদের, দায় আমাদের মতো তথাকথিত শিক্ষিতদের।

আমরা নিজেরাই কতটা সচেতন, নিজেরা নিজেদের পরিবারকে কতটা সামলাতে পারছি? আমাদের যখন যা বলার কথা সেটা কি বলতে পেরেছি? মুফতি ইব্রাহিম আর তারেক মনোয়ারদেরকে ভাইরাল কারা করেছে? তার মুরিদদের চেয়ে তাকে ট্রল করা লোকজনের অবদান এখানে বেশি। এই ট্রল তাদেরকে আরো বেশি মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছে। ভালোকে এড়িয়ে গিয়ে মন্দ নিয়ে মাতামাতির বদঅভ্যাস শিক্ষিতজন থেকে কখনোই বোধহয় যাবে না।

প্রসঙ্গ অনেক। ডাক্তারদের প্রটেকশন, মূল্য বৃদ্ধি, সিটি নির্বাচন...সব মাথায় আছে। তবে রাইট নাও আমি ও আমার পরিবার যে কারণে ঝুঁকিতে সেটা নিয়েই কথা বললাম। আবারো বলছি গ্রামের মানুষদের অসচেতনতার জন্য আমার দুঃখ কম। দুঃখ বরং শিক্ষিত ও দেশের দেখভাল করতে বসা লোকজন নিয়েই বেশি। আমার বন্ধু তালিকা মোটামুটি ফিল্টার করা। এলেবেলে লেখি না, ট্রল স্যাটায়ার করি না বলে এলেবেলে লোকজনের আমাকে ফলো করার সম্ভাবনা খুবই কম। তাও আমি খুব ভালো করেই জানি এত ব্যাখা দেয়া আমার এই পোস্ট অনেকেরই ভালো লাগবে না। ভালো কেন লাগছে না সেটাও পরিস্কারভাবে বুঝবে না তারা। অনুভব করবে চুলকাচ্ছে কিন্তু জায়গাটা ঠিক খুঁজে পাচ্ছে না।

তারচেয়ে বড়ো কথা, অনেকেই আছে যারা করোনাকে এখনো স্বীকারই করে না। এই আমার বন্ধু তালিকার লোকজনই। সৃষ্টিকর্তা আসন্ন বিপদ থেকে সকল শিশু এবং বিবেচক ও ভালো মানুষদের রক্ষা করুক।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা