চট্টগ্রাম একই পরিবারের ৭ জন যেভাবে হারিয়ে দিলেন করোনাকে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একই পরিবারের সাত জন আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনায়, ১৪ থেকে ৭৫ বছর বয়েসী সবাই ছিলেন সেই দলে। সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন আজ, জয় করেছেন করোনার ভয়কে...
মোবাইলে যেদিন মেসেজগুলো এলো একে একে, জীবন থমকে গিয়েছিল তাদের। একজন-দুজন হলে কথা ছিল, একই পরিবারের ছয় সদস্য করোনায় আক্রান্ত! তাদের আরও এক আত্মীয়ের রেজাল্টও পজিটিভ এসেছে- ভেঙে পড়ার জন্যে এটুকুই যথেষ্ট ছিল। আক্রান্তদের মধ্যে ১৪-৭৫ সব বয়সের মানুষই ছিলেন। শংকা ছিল খারাপ কিছু ঘটার। তবে এই লড়াইয়ে করোনাভাইরাসকে হোয়াইটওয়াশ করেছে পরিবারটির সদস্যরা। ছয়জনই সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছেন, তাদের আরেক আত্মীয় যিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, তিনিও এখন সুস্থ। বিরল এই ঘটনার সাক্ষী হয়েছে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার রূপনগর এলাকা।
করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া এক আত্মীয়ের জানাজায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন এই পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। এই অসাবধানতাই কাল হয়েছিল তাদের জন্য। যদিও মারা যাওয়া ওই ব্যক্তি আসলেই করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কিনা, সেটা তখনও জানতেন না তারা। দাফন-কাফনের কাজ শেষ করে আসার কয়েকদিন পরেই করোনার উপসর্গগুলো প্রকট হতে শুরু করে তাদের শরীরে, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে পরিবারের নারী সদস্যদের মধ্যেও।
এদিকে মারা যাওয়া ব্যক্তি যে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন, সেটা জানা গেছে ততদিনে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেই জানাজায় অংশগ্রহণকারীদের বাড়ি লকডাউন করে ফেলেছিল স্থানীয় প্রশাসন। এই পরিবারটিও সেই লকডাউনের আওতায় ছিল। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ায় গত ২০শে এপ্রিল তাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয় চট্টগ্রামের বিআইটিআইডি থেকে। ২৬শে এপ্রিল আসা ফলাফলে জানা যায়, পরিবারের ছয় সদস্যই করোনায় আক্রান্ত!
করোনা পজিটিভ প্রমাণ হওয়ার পরে তাদেরকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। সেই জানাজায় অংশ নেয়া মোট ১২ জনের শরীরে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ছয়জনের এই পরিবারটির সদস্য শামসুল আলমের বয়স ৫৬, তার ৭৫ বছর বয়স্ক বৃদ্ধা মা'ও আক্রান্ত হয়েছেন করোনাভাইরাসে। এছাড়াও শামসুল আলমের স্ত্রী ও তিন সন্তানও করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর বাইরে তার ছোট ভাই সেই জানাজায় অংশ নিয়েছিলেন, তারও ফলাফল পজিটিভ এসেছিল, তাকেও চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল একই সময়ে।
দিনগুলো খুব কঠিন ছিল। পরিবারের সবার আক্রান্ত হবার খবরটাই হজম করার মতো ছিল না। শামসুল আলম বলছিলেন, "২০ এপ্রিল আমাদের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ২৬ এপ্রিল করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার খবর পাই। পরিবারের এতজন সদস্যের করোনা শনাক্ত হওয়ার খবরে মুষড়ে পড়েছিলাম। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকদের আন্তরিকতা আমাদের মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে। তা ছাড়া পরিচিত লোকজন এবং হাসপাতালের অন্যান্য মানুষও প্রতিনিয়ত আমাদের সাহস জুগিয়েছেন, ভেঙে পড়তে দেননি। এতেই আমরা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পেরেছি।"
জানাজায় অংশ নেয়া থেকেই যে করোনা শরীরে ছড়িয়েছে, এটা নিয়েও নিঃসন্দেহ শামসুল আলম, জানালেন- "মারা যাওয়া এক আত্মীয়ের দাফন-কাফন ও জানাজায় অংশ নিয়েই আমরা একই পরিবারের সাতজন করোনায় আক্রান্ত হই। আমার ছোট ভাই কয়েক দিন আগে করোনামুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বুধবার সন্ধ্যার দিকে ছাড়পত্র পেয়ে ঘরে ফিরেছি মা, স্ত্রীসহ আমরা ছয়জন।"
শামসুল আলমের মায়ের বয়স ৭৫ বছর। আক্রান্ত রোগীর বয়স ৫৫-৬০ এর ওপরে হলেই ঝুঁকি বেড়ে যায়। সেই ঝুঁকিকে হারিয়ে দিয়ে বীরদর্পে ফিরে এসেছেন বৃদ্ধা এই ভদ্রমহিলা, করোনাকে দেখিয়েছেন বৃদ্ধাঙ্গুলি। একই পরিবারেত ছয়জনের করোনায় আক্রান্ত হবার খবরটা যেমন মন ভেঙে দেয়ার মতো ছিল, তাদের সবার ফিরে আসাটাও তেমনই আশা জাগানীয়া এক সংবাদ। এর মূলমন্ত্রটাও জানিয়েছেন শামসুল আলম, বলেছেন- "করোনায় আক্রান্ত হলে ভেঙে পড়া চলবে না। সাহস রাখতে হবে। মনকে শক্ত করতে হবে।"
করোনাভাইরাস প্রাণঘাতি, কোন সন্দেহ নেই। কিন্ত সাবধান থাকলে যেমন একে প্রতিহত করা যাবে, তেমনই সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিলে, উপযুক্ত চিকিৎসা ও সেবা-যত্ন পেলে যে কোন রোগীই সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন অনায়াসে। চট্টগ্রামের এই পরিবারটি সেটাই প্রমাণ করলো যেন...