হাসপাতালে ছিলাম ১০ দিন। এই ১০ দিনে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। করোনা সন্দেহে মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে গেছে ছেলে, কিংবা করোনা আক্রান্ত বাবার লাশ নিতে অস্বীকৃতি... এরকম খবরে যখন ফেসবুকের নিউজ ফিড ভর্তি, ঠিক তখনি এই হাসপাতালে আমার চোখের সামনে পৃথিবী তার অন্য রূপ মেলে ধরলো।

ফাইজ নাফিয়া রহমান: ৭ এপ্রিল সন্ধ্যায় কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট আসার পর দ্বিধায় পরে গেছিলাম কোথায় থেকে ট্রিটমেন্ট নিব। IEDCR এর একজন ডাক্তার বললেন, আপনার যেহেতু তেমন কোন লক্ষণ নেই তাই আপনি বাড়িতে থেকেই ট্রিটমেন্ট নিতে পারেন। বাসায় বয়স্ক বাবা-মা আর ছোট ভাগ্নে থাকায় তাদের সেফটির কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিলাম হসপিটালের সার্ভিস যতই খারাপ হোক হাসপাতালেই যাব। IEDCR এ আমার এই সিদ্ধান্তের কথা জানতেই ওরা আমাকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের কন্ট্রোল রুমের নাম্বার দিল। ফোন দিলাম অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য। রাত ১০.০০ টার দিকে অ্যাম্বুলেন্স এ করে রওনা দিলাম হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। রাত ১১.৩০ এর দিকে পৌঁছলাম। আমাকে রুমে পাঠানোর আগেই এক ডাক্তার আমার সব ডিটেলস নিয়ে নিল।

হাসপাতালে ছিলাম ১০ দিন। এই ১০ দিনে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। ফেসবুক খুললেই অনেক কিছু দেখা যায়- যেমন: ছেলে করোনা সন্দেহে মাকে জঙ্গলে ফেলে চলে গেছে আবার করোনা আক্রান্ত বাবার লাশ নিতে অস্বীকৃতি... এই রকম খবরে যখন ফেসবুকের নিউজ ফিড ভর্তি, ঠিক তখনি এই হাসপাতালে আমার চোখের সামনে পৃথিবী তার অন্য রূপ মেলে ধরলো। সেই পৃথিবী ভালোবাসার। একে অপরের পাশে থাকার। তাইতো কোভিড-১৯ পজিটিভ স্ত্রীর পাশে থাকার জন্য, সাহস যোগানোর জন্য সুস্থ স্বামীও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে.. অসুস্থ মা- বাবাকে সেবা করার জন্য নিজের লাইফ রিস্ক নিয়ে মেয়েও থেকে গেছে হাসপাতালে। ২৪ ঘন্টা কোভিড-১৯ আক্রান্ত প্রিয়জনেদের সেবা করে যাচ্ছে তারা। 

"হাতের উপর হাত রাখা খুব সহজ নয় সারা জীবন বইতে পারা সহজ নয়..." কিন্তু যারা বইতে পারে তাদের জন্যই আছে উত্তম প্রতিদান। আর সেই প্রতিদান আসে পরম করুনাময় আল্লাহ তাআলা র পক্ষ থেকে। আর তাই আল্লাহর অশেষ রহমতে আর মেহেরবানীতে আমি চলে আসার দিন পর্যন্ত এই মহান হৃদয়ের অধিকারী মানুষদের কোভিড-১৯ নেগেটিভ ছিল।এতো নেতিবাচক খবরের ভীড়ে এই রকম ভালোবাসা,বিশ্বাস আর সাহসিকতার গল্প গুলো অল্প হলেও নতুন করে বাঁচতে নতুন করে ভাবতে শেখায়।

আরো এক কেস দেখলাম, কোভিড-১৯ শুধু জ্বর, কাশি বা শ্বাসকষ্ট তেই থেমে নেই, এটা আসে বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে। আমি যখন IEDCR এ জানালাম আমার তো জ্বর কাশি শ্বাসকষ্ট কিছুই নেই... যে গলা ব্যথা ছিল ঐটাও অ্যান্টিবায়োটিক নেয়ার পর অনেকটাই কমে গেছে। গত ১৯ দিন আমি আর আমার পরিবারের কেউ ঘরের বাহিরে যাই নি! আমার কীভাবে পজিটিভ এলো! আমার প্রশ্নের উত্তরটা ছিল এই রকম যে- দেশের প্রায় ৮০% লোকের পজিটিভ আসবে যদি টেস্ট করানো হয় কিন্তু এদের কোন লক্ষণ নেই। ভাইরাসটা ওদের আক্রান্ত করে ঠিকই কিন্তু কিছু বোঝার আগেই রোগী ভালোও হয়ে যায়।হাসপাতালেও তার নমুনা দেখলাম কয়েকটা। পুরান ঢাকার এমন দুইটা পরিবারের সাথে পরিচয় হয়েছে। 

১। লোকটি হাসপাতালে ভর্তি হয় কোভিড-১৯ পজিটিভ সব লক্ষন নিয়ে। পরিবারের অন্যান্যদের কেউ যখন টেস্ট করানো হলো তখন দেখা গেল উনার স্ত্রী ও এক ছেলের পজিটিভ কিন্তু বাকি দুই ছেলের নেগেটিভ। আর আরো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পজিটিভ স্ত্রী আর ছেলের কোন লক্ষণ ছিল না, আর এখন পর্যন্ত নেই। ওরা চাইলেই ঘরে বসেই চিকিৎসাt নিতে পারতো, কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে এতোটাই নিম্নমানের যে বাড়িওয়ালা ওদের বাসা থেকে বের করে দেয়াতে হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয়েছে। যাই হোক, লোকটি এখন পুরোপুরি সুস্থ। আশা করি ২-৩ দিনের মধ্যে পুরো পরিবার রিলিজ পেয়ে যাবে।

২। আমার দেখা পুরান ঢাকার ২ নাম্বার পরিবারের কথা বলি। এই আঙ্কেল (বয়স আুমানিক ৬৫+) এর পজিটিভ ধরা পরে শুধুমাত্র ডায়রিয়া সিম্পটমস নিয়ে, দুদিন পর উনার স্ত্রী ভর্তি হলো করোনার সব লক্ষণ নিয়ে। এর দুদিন পর উনাদের ছেলে ভর্তি হল শুধুমাত্র কাশি নিয়ে। যদিও একইসাথে ছিল তারপরও ছেলের বউ আর ওদের ছেলে-মেয়েদের নেগেটিভ ছিল। আমি আসার দিন দেখে আসছি আঙ্কেল অনেকটাই সুস্থ আর আন্টিরও জ্বর চলে গেছে, শুধু হালকা শ্বাসকষ্ট আছে- ওইটাও চলে যাবে ইনশাআল্লাহ। হতেই পারে আগামী সপ্তায় হয়তো এই পরিবারটাও রিলিজ পেয়ে যাবে।

আরো একটা ঘটনা বলি যারা ICU নিয়ে ভয়ে আছেন তাদের জন্য। এক ভাইয়া করোনা পজিটিভ নিয়ে ভর্তি হয় ৫ এপ্রিল.. অবস্থা অনেক খারাপ থাকায় উনাকে ICU তে নিয়ে যাওয়া হয়। উনার ভাষ্যমতে ICU-তে ২৪ ঘন্টা নার্স থাকে (এই তথ্য তাদের জন্য যারা ভাবেন নার্সরা শুধু ঘুমাইতেছে দেশের এই ক্রাইসিস মোমেন্টে)। যাই হোক উনি করোনার সাথে ICU তে ৩ দিন লড়াই করে নরমাল ওয়ার্ডে চলে আসেন ৯ এপ্রিল। হয়তো গতকাল উনার রিলিজও হয়ে গেছে।

আমি হাসপাতালের যে ফ্লোরে ছিলাম সেখানে বেশিরভাগ এর অবস্থাই অনেক স্টেবল ছিল। এই ১০ দিনে আমি মৃত্যু দেখেছি দুই জনের। আল্লাহ যেন উনাদের সহ আরো যারা করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন সবাইকে কবরের আযাব মাফ করেন এবং বিনা হিসেবে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করেন, সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি। আমিন।।

এবার আসি ডাক্তারদের নিয়ে যাদের চুলকানি আছে, এই ১০ দিনের এমন একটা দিনও ছিল না যেদিন ডাক্তাররা ভিজিটে আসেন নি। প্রতিদিন দুইবার করে রাউন্ড দিয়ে গেছেন। রোগীদের সাহস দিয়ে গেছেন, রোগীদের কথা শুনেছেন, সেই হিসেবে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। যে রোগের কোনো ঔষধ এখনো পর্যন্ত আবিষ্কার হয় নাই, সেখানে আর কতোটুকুইবা করবে ডাক্তাররা! আমাকে রিলিজ দেয়ার আগের দিন এক ডাক্তার আমাদের বলেছিল "আপনারা রিলিজ নিয়ে চলে যাবেন আর আমরা এখানে ভর্তি হবো!" 

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল

কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সব ডাক্তার-নার্সদের সবারই স্যাম্পল নিয়ে গিয়েছিল IEDCR, কারন ওরা অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল! তাই বলছি ডাক্তার-নার্সদের সম্মান করতে না পারেন অন্তত গালি দিয়েন না। একবার শুধু ভেবে দেখুন বর্তমান আক্রান্তের সংখ্যা এখনো দুই হাজার এর মধ্যে আছে, আর এখনি যদি সব ডাক্তার-নার্সরা অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে আমেরিকা-স্পেন-ইতালির মতো অবস্থা হলে কে আপনাকে চিকিৎসা দিবে? সৈনিক ছাড়া তো আর যুদ্ধ করা যায় না! আর এই করোনা যুদ্ধের আসল সৈনিক তো এরাই, ডাক্তার-নার্সরা। 

সবশেষে এই হাসপাতাল নিয়ে কিছু বলবো। এই ১০দিন ৩ বেলা নিয়মিত খাবার-ঔষধ পেয়েছি। আগেই বলে রাখি ভাই এটা সরকারী হাসপাতাল, তাই আইসোলেশন রুমের কথা মাথাতেও আনবেন না। ভিটামিন সি বা সাপ্লিমেন্টারি দরকার হলে বাইরে থেকে কিনে হাসপাতালে ঢুকবেন। একদমই ভাবতে যাবেন না যে এইগুলো হাসপাতাল প্রোভাইড করবে! হাসপাতাল অনেক পরিস্কার কিন্তু আমরা জাতি হিসেবে অনেক নোংরা। তাই পরিস্কারের মর্ম আমরা বুঝি না। এইখানে গিয়ে বুঝতে পারছি যে জাতি 'হাগার' করার পর ফ্ল্যাশ করতে পারেনা সেই জাতিকে আইসোলেশন আর কোয়ারেন্টাইন বুঝাতে আরো ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে। মাথায় রাখবেন সরকারী হাসপাতালে এক ওয়ার্ডে ৬ টা বেড এর জন্য একটা টয়লেট, তাই নিজের নোংরা গুলো নিজে পরিস্কার করে ফেললে তো কোনো দোষের কিছু নেই। অন্তত আমি দেখিনা। ক্লিনার এর জন্য ফেলে রাখার কি দরকার রে ভাই! ওরাও তো মানুষ, ওদেরও তো জানের ভয় আছে নাকি?

যাদের IEDCR নিয়ে অনেক অভিযোগ, আমি IEDCR থেকে অনেক সাহায্য পেয়েছি। ওদের সহযোগিতাতেই এত তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে পেরেছি। সামনের সপ্তাহে আমার আরেকটা টেস্ট করাবে আর ঐটা নেগেটিভ এলেই বন্ধ রুম থেকেও মুক্তি পাব। সেই দিনের আশায় আছি...

উপরের সবকিছুই আমি এই ১০ দিনে যা দেখেছি যা বুঝেছি যা অনুভব করেছি তার বহি:প্রকাশ মাত্র। সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত। সাবধানে থাকবেন, যেহেতু এই রোগের কোনো ঔষধ নেই, তাই একমাত্র উপায় হলো নিজের ইমিউন সিস্টেম বুস্ট আপ করা বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। করোনাকে ভয় না পেয়ে ইমিউন সিস্টেমকে কাজে লাগান। আর যদি এতটুকু লক্ষণ আপনার মধ্যে দেখা দেয়, লুকোছাপা না করে প্লিজ টেস্ট করান, ট্রিটমেন্ট নেন। আশা করি আল্লাহর দয়ায় ভালো হয়ে যাবেন। আজাইরা কারনে লক্ষণ লুকিয়ে আশেপাশের মানুষদের আর ডাক্তারদের সংক্রামিত কইরেন না।

ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন আর আশেপাশের সবাইকে ভালো রাখুন। নিজের ভালো থাকাটা যেমন জরুরী তেমনি আশেপাশের সবাইকে ভালো রাখাটাও আমাদের নৈতিক ও নাগরিক দায়িত্ব। আর সবসময় পরম করুনাময় আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন দেখবেন উনি ঠিকই আমাদের আলোর পথ, আশার পথ দেখাবেন...

আমাদের কথা: প্রিয় ফাইজ নাফিয়া রহমান, করোনাকে হারিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরেছেন আপনি, জিতেছেন অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে অসম্ভব এক লড়াইয়ে। আপনার লেখা এই বিজয়ের গল্প অনুপ্রেরণা যোগাবে আরও হাজার হাজার মানুষকে। আপনার প্রিয় খেলোয়াড় রজার ফেদেরার, টানা সাড়ে চার বছর কোন গ্র্যান্ডস্ল্যাম জেতেননি তিনি, সবাই ধরে নিয়েছিল ফেদেরার ফুরিয়ে গেছেন। ২০১৭'র অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে ফিনিক্স পাখির মতো ফিরেছিলেন ফেদেরার, সেরকমই ফিরে আসার একটা রূপকথা লিখে ফেলেছেন আপনি নিজেও। এগিয়ে চলো পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে অভিনন্দন, আপনার জন্যে ভালোবাসা। খুব শিগগিরই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে একদম স্বাভাবিক জীবন শুরু করবেন আপনি, এটাই আমাদের কামনা...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা