‘গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন...’ এটি পুরোপুরি এক মিথ্যা স্টেটমেন্ট। একজন রোগীর প্রথম উপসর্গ প্রকাশ থেকে শুরু করে, সিরিয়াল নিয়ে পরীক্ষার ফল পেতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। অথচ দেশের সকল প্রতিষ্ঠান, জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিদিন এই মিথ্যার উদযাপন করে যাচ্ছে। বিনা প্রশ্নে...
করোনা পরীক্ষার জন্য ভোর চারটের সময় সিরিয়াল নিতে গিয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলাম। যদিও সবকিছু শুরু হবে সকাল দশটা থেকে, তবু আমার আগে আরও আধঘণ্টা ধরে একজন অপেক্ষা করছিলেন। আর এই ভোর চারটার সময় যে যেতে হবে, এই বিষয়টুকু বুঝতে অন্য সবার মতোই, আমারও দিন চারেক সময় লেগেছিল।
প্রায় ১৬ দিন আগে আমার জ্বর আসে। ১০২ এর কাছাকাছি। জ্বরটা মাত্র একদিন ছিল, কিন্তু পরদিন আমি আবিষ্কার করি যে, জ্বরের সাথে সাথে আমার ঘ্রাণশক্তি সম্পূর্ণরূপে লোপ পেয়েছে। সেই সাথে মুখের স্বাদগ্রহণ ক্ষমতা। যা খাই, মনে হয় ৮০ গ্রাম অফসেট পেপারে সামান্য লবণ মিশিয়ে খাচ্ছি।
সেসময় জেনেছিলাম, এইগুলো করোনা ভাইরাসের অন্যতম লক্ষণ। তার পরদিন থেকে আমার গলা ব্যাথা শুরু হয়। আর তার পরের দিন থেকে সামান্য কাশি। না। এতোগুলো লক্ষণ ধরা পড়ার পরেও, আপনাদের পত্রিকায় যেমন পড়েছি, আমার পরিবার আমাকে অচ্ছুত ঘোষণা করেনি। বরং তাদেরকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখতে আমাকেই কঠোর হতে হয়েছে।
যেদিন নমুনা দিতে গেলাম, সেইদিন দেখলাম এক শ্বাসকষ্টের রোগীকে তার পরিবারের তিনজন ধরে ধরে নিয়ে এসেছেন। তাঁরা সারাক্ষণ রোগীর পাশে পাশে ছিলেন। ফলে আপনাদের প্রোমোট করা গল্পগুলো কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগে। মানুষকে মমতাহীন প্রমাণ করতে পারলেই অনেক অনেক লাইক শেয়ার কামানো যায় বলেই কি?
সরকারের অনুরোধ অনুযায়ী, আমি আমার লক্ষণগুলো নিয়ে আলোচনা করতে অসংখ্যবার জাতীয় স্বাস্থ্য বাতায়ন ১৬২৬৩ তে ফোন করেছি। দুর্ভাগ্য যে, এখনও পর্যন্ত লাইন পাইনি। করোনা পরীক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিকেল যে অনলাইন এ্যাপয়েন্টমেন্ট গ্রহণের ব্যবস্থা করেছে, তার অবস্থা পূর্ব কালের ভারতীয় ই-টোকেন পাওয়ার মতো। নতুন তারিখ ঘোষণার ঠিক পরের মুহূতেই সিস্টেমটি জানিয়ে দেয় যে, কোন স্লট খালি নেই।
ব্রাকের ‘সুরক্ষা বুথে’ নমুনা প্রদানের দিন, কয়েক ঘণ্টার সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে যত মানুষের সাথে কথা বলেছি, জেনেছি, তারাও ঐ সিস্টেমে ব্যর্থ হয়েছেন। বেসরকারি হাসপাতালেও সিরিয়ালের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে জেনেছি, লোকবল ও টেস্ট কিটের সংকট থাকায় ৩০০ জন দাঁড়িয়ে থাকা লোকের বিপরীতে তাঁরা প্রতিদিন ৫০ জনের নমুনা নিতে পারবেন। বাকিরা তার পরদিন, না পারলে তার পরদিন, না পারলে... চলতেই থাকবে।
আমার কোন অভিযোগ নেই। কারণ মানসিক প্রস্তুতি ছিল। একটা দরিদ্র রাষ্ট্রে, অব্যাহত ভাবে স্বাস্থ্যখাতে ব্যাপক দুর্নীতি ও করোনা কালীন সিদ্ধান্ত ও সমন্বয়হীনতার মধ্যে, ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় আমাকে এই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। (আপনাকেও যেতে হবে) কিন্তু এরপরও যখন দেখি যে, করোনা মোকাবেলার বাজেট নিয়েও ক্রয় খাতে ব্যাপক দুর্নীতির পরিকল্পনা করা হয়েছে, তখন রাষ্ট্রসহ সবকিছু ভেঙে ফেলে আবার নতুন করে গড়তে ইচ্ছা করে। তারই বোধহয় প্রয়োজন।
শেষ কথা, আমি প্রতিনিয়ত সুস্থ হয়ে উঠছি। এই সময়ের মধ্যে আমার চারপাশের মানুষের, পরিবার ও আমার বন্ধুদের সহযোগিতা ও ভালোবাসাকে আমি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করি। আমি এখন অপেক্ষা করছি আমার করোনা পরীক্ষার ফলাফলের। মোবাইলে মেসেজ দিয়ে পাঠানোর কথা। আজ ৬ দিন হতে চলল।
এর মধ্যে সরকারের তরফ থেকে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশন বিষয়ক বা মুজিববর্ষ পালনে কুইজ প্রতিযোগিতা বিষয়ক মেসেজ পেয়েছি। কিন্তু যে মেসেজটি পেলে, আমি আমার সন্তানকে আবার কোলে নিতে পারব, অথবা আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব কি’না, সেটা জানতে পারব- সে মেসেজটি এখনও পাইনি।
আমার পুরো অভিজ্ঞতা থেকে দেখলাম যে, প্রতিদিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রেস ব্রিফিঙে যে বলা হয়, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন...’ এটি পুরোপুরি এক মিথ্যা স্টেটমেন্ট। একজন রোগীর প্রথম উপসর্গ প্রকাশ থেকে শুরু করে, সিরিয়াল নিয়ে পরীক্ষার ফল পেতে ১০-১৫ দিন সময় লাগে। (আমার ক্ষেত্রে সেটা ১৬ দিনেও সম্ভব হয়নি)। অথচ দেশের সকল প্রতিষ্ঠান, জাতীয় দৈনিক, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো প্রতিদিন এই মিথ্যার উদযাপন করে যাচ্ছে। বিনা প্রশ্নে।
এই রাষ্ট্র কি মিথ্যা থেকে বেরিয়ে এসে, আরেকটু মানবিক হতে পারে না? করোনাকালে দায়িত্বপালন করতে এসে ২১জন ডাক্তার মারা গেলেন, ১৬ জন পুলিশ সদস্য মারা গেলেন। যদি সেই মানবিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই না করা গেল তো, এই মৃত্যুসমগ্র কিসের বিনিময়ে রচিত হচ্ছে?
লেখক: মাহাদি হাসান সুমন