করোনাভাইরাস উপলক্ষ্যে পাওয়া ছুটি উদযাপন করছেন? বন্ধ পেয়েই বেরিয়ে পড়েছেন বেড়াতে? কিংবা করোনার ভয়াবহতাকে বিন্দুমাত্র ভয় করেন না আপনি? তাহলে এই লেখাটা আপনার জন্যে, শুধুই আপনার জন্যে।

তখন প্রায় মধ্যরাত। আজিমপুর কবরস্থানের একটা গেট খুলে গেল, ভেতরে ঢুকলো আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের লাশবাহী একটা ভ্যান, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সেটার ভেতরে প্লাস্টিকের প্যাকেটে রাখা আছে মৃতদেহটা। সেই প্যাকেজিংও করা হয়েছে ভীষণ সতর্কতার সাথে, যাতে প্রাণঘাতি ভাইরাস কোনভাবেই ছড়িয়ে পড়তে না পারে বাইরে। আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের পক্ষ থেকে দুই-তিনজন এসেছেন, তাদের পুরো শরীর প্লাস্টিকের বিশেষ পোষাকে ঢাকা, লাশ দাফনের কাজ শেষ হলে মাটিচাপা দেয়া হবে সেগুলোও। রিস্ক নেয়া যাবে না বিন্দুমাত্র। কিন্ত সামান্য একটা লাশ দাফনে কেন এত সতর্কতা? কিসের এত ভয়? 

কারণ আজিমপুর গোরস্থানে যে লাশটাকে দাফনের জন্যে আনা হয়েছিল, সেটা ছিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর প্রথম ঘটনা। সত্তর বছর বয়েসী বৃদ্ধ মানুষটি সংক্রমিত হয়েছিলেন বিদেশ থেকে আসা কারো মাধ্যমে। বৃদ্ধ শরীর ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করে কুলিয়ে উঠতে পারেনি, হার মেনেছেন মৃত্যুর কাছে। কিন্ত মৃত্যুর পরেও কি রেহাই মিলেছে? কোন স্বাভাবিক মানুষ কি মৃত্যুর পরে এমন সৎকার চাইবেন?

এই বৃদ্ধের কথাই ধরুন না, তিনি কি কখনও ভেবেছিলেন, আত্মীয় পরিজনহীন একটা অবস্থায় তাকে মরতে হবে? তার জানাজাতে শামিল হতে পারবেন না কেউ, কবরে দু'মুঠো মাটি তুলে দেয়ার অনুমতি পাবেন না তার কোন ওয়ারিশ! শেষবারের মতো তার চেহারাটাও দেখতে পাবে না স্বজনেরা? অপরিচিত কিছু মানুষ আর সরকারের একজন প্রতিনিধি তাকে শেষ সমাধিতে শুইয়ে আসবেন- এমনটা নিশ্চয়ই কল্পনায় ছিল না মানুষটার। 

আজিমপুর কবরস্থানে লাশ আনা হয়েছে দাফনের জন্যে

অবিশ্বাস্য হলেও, এটাই এখন বাস্তবতা। ইউটিউবে সার্চ দিলে করোনাভাইরাসে মৃত্যু হওয়া রোগীদের দাফনের প্রচুর ভিডিও পাবেন। সেই দৃশ্যটাই এখন বাংলাদেশেও বাস্তব। করোনাভাইরাসে মৃত্যু হওয়া রোগীদের ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রতিটি দেশই একই নিয়ম অনুসরণ করছে, যার শুরুটা হয়েছিল চীনে। আপনি ক্যান্সারে মারা গেলে লাশ আপনার পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়া হবে, কিন্ত করোনায় মারা গেলে সেই সুযোগ নেই। কারণ লাশের শরীর থেকে যাতে জীবিত কারো শরীরে ভাইরাসটা ছড়াতে না পারে। এজন্যেই করোনায় মারা যাওয়া মানুষগুলোকে শেষ বিদায় জানানো হচ্ছে সরকারী ব্যবস্থাপনায়, একদমই নিভৃতে, নীরবে, পরিবারের কোন সদস্যকে উপস্থিত থাকতে দেয়া হচ্ছে না সেখানে। 

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে  বাংলাদেশে যিনি মারা গেছেন, তার দাফন হয়েছে আজিমপুর কবরস্থানে। নিয়ম অনুযায়ী তার দাফন-কাফনে তার স্বজনদের কেউ উপস্থিত ছিলেন না, থাকতে দেয়া হয়নি। আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম এই লাশের দাফনের ব্যবস্থা করেছে, পুরোটা সময়জুড়ে তারাও ছিলেন নিরাপদ পোষাক এবং মাস্কের নিচে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের একজন ম্যাজিস্ট্রেট দূর থেকে শুধু তদারকি করেছেন পুরো ব্যাপারটা, সরকারী কাজ বলেই তাকে উপস্থিত থাকতে হয়েছিল। 

অনেকেই গুজব ছড়াচ্ছেন, করোনায় মৃত ব্যক্তিদের নাকি জানাজা পড়ানো হয় না। এই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করেছেন আইইডিসিআর এর পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা, তিনি জানিয়েছেন- 'করোভাইরাসে মৃত ব্যক্তির লাশ প্যাকেট করার আগে আমরাই ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী গোসল করিয়ে দেবো। এরপর কাফনের কাপড় পরিয়ে প্যাকেট করা হবে। সেই প্যাকেট কোনো অবস্থাতেই কেউ খুলতে পারবে না। প্যাকেট খুলে আত্মীয়-স্বজন লাশের মুখ দেখার সুযোগ নাই।'

আপনার অনেক সাহস, করোনা ফরোনাকে গোনার টাইম আপনার নাই, নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে আপনার ভীষণ অহংকার- খুবই ভালো। তবুও দয়া করে সাবধান হোন, আপনার পরিবারের সদস্য, আপনার আপনজনদের শরীরের সামর্থ্য এতটা না-ও হতে পারে। তাদেরকে নিরাপদে রাখাটাও কিন্ত আপনার দায়িত্ব। আপনার বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কথা ভাবুন, যাদের বয়স ৬০ বছরের ওপরে। করোনার ধাক্কাটা তারা নিতে পারবেন কিনা চিন্তা করুন। তারপর মগজে ভালোভাবে ঢোকান, আপনার অসাবধানতায় তাদের কিছু হয়ে গেলে শেষবারের মতো লাশটা দেখার সুযোগও পাবেন না আপনি, কবরে এক মুঠো মাটি না দিতে পারার আফসোসটা সারা জীবন কাঁদাবে আপনাকে। 

এর পরেও করোনা নিয়ে সিরিয়াস হবে না বাংলাদেশের মানুষ? যদি না হোন, তাহলে এমন পরিণতি ডিজার্ভ করে এই জাতিটা...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা