করোনার ভয়াবহতা: কতখানি গুজব আর কতটা বাস্তবতা?
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
যদি কেউ বলে, "আমেরিকা/চায়না ইচ্ছা করেই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে, এটি ইহুদি/নাসারা/ইলুমিনাতি ষড়যন্ত্র" তাহলে এমন ছাগলামি কথাবার্তায় লাফালাফি না করে ফ্যাক্ট জানার ও বুঝার চেষ্টা করুন।
করোনা ভাইরাস আমেরিকায় ছড়াতে শুরু করেছে। ওয়াশিংটনে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে, অন্যান্য স্টেটেও ধীরে ধীরে ধরা পড়ছে। নিউইয়র্কের মতন ঘনবসতিপূর্ণ শহরেও শনাক্ত হয়েছে একজন রোগী। টেক্সাসেও এক নারীকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেই নারী ক্রুজে বেড়াতে গিয়ে ফিরে এসে বিপদে পড়েছেন।
আজকেই আরেকজন বৃদ্ধকে শনাক্ত করা হয়েছে, যিনি বিদেশ সফরে গিয়ে অসুস্থ হয়ে ফিরেছেন। ক্যালিফর্নিয়া সহ অন্যান্য অঙ্গ রাজ্যেও ছড়াতে শুরু করেছে। গোটা দেশব্যাপী ছড়িয়ে যাওয়া কেবলই সময়ের ব্যাপার। এটি আমার কথা নয়, আমাদের দেশের কর্তাব্যক্তিদের সতর্কবার্তা।
তাই রিটেইল শপগুলোর জীবাণুনাশক ও ফেস মাস্ক থাকগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে। লোকজন শুকনো খাবার জমাতে শুরু করেছে। বাইরে খাওয়া কমে গেছে। রেস্টুরেন্ট ব্যবসা ধসে যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই। স্টক মার্কেটে ধস নেমে গেছে। অফিসে অফিসে নোটিস দেয়া হচ্ছে যেকোন মুহূর্তে বাড়ি থেকে কাজ করার মানসিক ও অন্যান্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে। যেকোন মুহূর্তে সরকার ইমার্জেন্সি ঘোষণা করবেন, তখনই বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত নগরীগুলো ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হবে। স্কুল, কলেজ, বাজার সব ফাঁকা হয়ে যাবে।
ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ চলছে। দিনরাত এক করে গবেষণা চালানো হচ্ছে। কোটি কোটি ডলার খরচ হচ্ছে এর পেছনে। কিন্তু এটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রতিষেধক ঠিক মতন কাজ করে কিনা, এর কোন সাইড ইফেক্ট আছে কিনা, সেটা জানতে একটা বছর অপেক্ষা করতেই হবে।
অতিরিক্ত দুঃসংবাদ হলো, এই ভাইরাসের উপর তাপমাত্রার কোনই প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। ইরানের মতন উষ্ণ ও শুষ্ক অঞ্চলে দিব্যি ছড়িয়ে বেড়াচ্ছে সে। ছড়িয়েছে ইতালিতেও। অন্যান্য ভাইরাসের ক্ষেত্রে আমরা যেমন গ্রীষ্মের অপেক্ষায় থাকি, এক্ষেত্রে সেটা বলা যাচ্ছেনা। মিনিমান ৭০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এটি মরে। এত তাপমাত্রা বিশ্বের কোন দেশেই নেই। থাকলে মানুষই টিকতো কিনা সন্দেহ।
এখন কথা হচ্ছে, চীন থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রান্তের এক দেশ আমেরিকাতেই যখন এই ভাইরাস পৌঁছে গেছে, তখন "প্রায় প্রতিবেশী" বাংলাদেশে পৌঁছেনি, এটি কেমন যেন বিশ্বাস হচ্ছেনা। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে চীনের সাথে আমাদের গভীর সম্পর্ক। আমাদের ছোট বড় নানান শ্রেণীর ব্যবসায়ী চায়না গিয়ে তাঁদের মালপত্র এনে লোকাল মার্কেটে বিক্রি করেন। প্রচুর ছাত্রছাত্রী সেখানে পড়ালেখা করতে যায়, প্রচুর টুরিস্ট সেখানে বেড়াতে যায়। প্রচুর চীনা নাগরিক আমাদের দেশে কাজ করতে আসেন।
এতো গেল সরাসরি চীনাদের সাথে সংস্পর্শের কারন। এখন পরোক্ষভাবে যদি বিবেচনা করা হয়, তাহলে বিষয়টা আরও জটিল। মানে, এখন গ্লোবালাইজেশনের যুগে, হাজার হাজার মানুষ, প্রতি মিনিটে নানান দেশে যাতায়াত করছেন। মেলামেশা হচ্ছে। তারপরেই আবার বিশ্বের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে যাচ্ছেন। ফলে, এইটা মোটামুটি অবিশ্বাস্য একটি ব্যাপার যে বাংলাদেশে কেউ করোনা ভাইরাস নিয়ে প্রবেশ করেনি। খোদ চীনারাই যেখানে সাবধান হতে দুইমাস দেরি করে ফেলেছে, আমরা এখনও বলে বেড়াচ্ছি, আমাদের আতঙ্কিত হবার কিছু নেই।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত কোন করোনা রোগী শনাক্ত হয়নি। দারুন সুসংবাদ! তবে সন্দেহ থাকছে মনে, আসলেই কী শনাক্ত হয়নি? নাকি তথ্য গোপন করা হচ্ছে? যাতে জনমনে প্যানিক সৃষ্টি না হয়?
কোন বড় ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার একটি প্রবণতা আমাদের রক্তে মিশে আছে। কারোর গোপন রোগ হয়েছে? চেপে যাও! কারোর ধর্ষণ হয়েছে? চেপে যাও। দেশে জঙ্গিবাদ যখন তুঙ্গে, প্রতি মাসে এখানে ওখানে বোমা বিস্ফোরণ হতো, তখনও সরকারের তরফ থেকে জানানো হতো দেশে জঙ্গি নেই, সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এখানেও হয়তো সেটাই করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী উৎসব একটি কারন হতে পারে। করোনা ভাইরাস সম্পর্কে ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার দিলেতো অনুষ্ঠান সফল হবেনা। সরকারের এত বিপুল আয়োজন, এত উৎসাহ, সব নষ্ট হয়ে যাবে?
কথা হচ্ছে, মানুষের জীবনের চাইতেতো কোন অনুষ্ঠান বড় হতে পারেনা। চীন তাঁদের নিউ ইয়ার অনুষ্ঠান বাতিল করে দিয়েছে। জাপান অলিম্পিক পেছানোর কথা চিন্তা ভাবনা করছে।জনশূন্য ফাঁকা গ্যালারিতে ইউরোপে ফুটবল হচ্ছে। মক্কা ওমরাহ ভিসা বাতিল করেছে বিশ্বের অনেক দেশ থেকে। কাবা ঘরের শূন্য চত্বর আমাদের বুকে হাহাকার তুলছে। যদি পরিস্থিতি এমন চলতে থাকে, তাহলে হজ্বও বাতিল হতে পারে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আমরা যদি বালির নিচে মাথা গুঁজে বলি আল ইজ ওয়েল, তাহলেতো কিছু বলার নেই।
অনুষ্ঠান পেছানো কী খুব জটিল কিছু? সরকার যা ভাল বুঝার বুঝবে।
আপনারাও নিজেদের ভালোর সিদ্ধান্ত নিজেরা নিন। শুকনো খাবার মজুত করতে থাকুন। কিছুক্ষন পরপর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন। হাত না ধুয়ে চোখ কচলাবেন না, নাকে মুখে হাত দিবেন না। না পারতে ভিড় বাড়াবেন না। মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলুন।
সর্দি কাশি জ্বর হলে সিরিয়াসলি নিন। পরিবারের অন্যান্যদের নিরাপত্তার খাতিরেই নিজেকে আলাদা করে ফেলুন। খবরদার! যত আদরেরই হোক, কারোর সংস্পর্শে আসবেন না।
যদি বাচ্চাও অসুস্থ হয়, তাহলে বাচ্চাকেও আলাদা করে নিজে সতর্ক থেকে তাঁর শুশ্রুষা করুন। আহ্লাদ দেখাতে গিয়ে নিজে অসুস্থ হওয়া কোন কাজের কথা না। বাচ্চাদের ইমিউন সিস্টেম ভাল। দেখা যাবে, সে সুস্থ হয়ে গেছে, মাঝে দিয়ে আপনি শেষ। বাচ্চাকে এতিম করে কোন লাভ হলো? এইসব চিন্তাভাবনা করে কাজ করবেন।
বাচ্চা অসুস্থ হলে অবশ্যই স্কুলে পাঠাবেন না। নিজে অসুস্থ হলে অবশ্যই অফিসে যাবেন না।
আমাদের দেশে জুম্মার নামাজে প্রচন্ড ভিড় হয়। যদি আপনি অসুস্থ হন, সেটা জ্বর, সর্দি, ভাইরাল ফিভার যেকোন কিছুই হোক না কেন, তাহলে খবরদার, জুম্মা সহ যেকোন জামাতে উপস্থিত হবেন না। আল্লাহর নবী (সঃ) রসুন খেয়ে জামাতে দাঁড়াতে নিষেধ করেছিলেন কারন এতে অন্যের অসুবিধা হয়। সিগারেট খেয়ে জামাতে যাওয়া নিষেধ কারন তামাকের গন্ধ অনেকের সহ্য হয়না। সেখানে ভাইরাস নিয়ে জামাতে দাঁড়ানো নির্বোধের আচরণ। ভয় নেই, কাবা ঘরকেও পরিচ্ছন্নতার খাতিরেই সাময়িক বন্ধ করা হয়েছে। দোতলা থেকে নামাজ আদায় করা হচ্ছে। আপনি বাড়িতে নামাজ পড়ুন, আর দোয়া করুন যাতে এই পরিস্থিতি থেকে আমাদের দ্রুত মুক্তি মেলে। বাকি আল্লাহ মালিক।
কেউ প্যানিক ছড়ানোর চেষ্টা করলে পাত্তা দিবেন না। বুদ্ধিহীনের মতন আচরণ না করে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা নিবেন। কেউ যদি বলে "এইটা কাফিরদের উপর আল্লাহর গজব, আমাদের মুসলিমদের কিছু হবেনা" তাহলে জেনে নিন মধ্যপ্রাচ্যে এটি ছড়াচ্ছে। এই কথা সত্য হলে কাবা ঘর বন্ধ হতো না।
যদি কেউ বলে, "আমেরিকা/চায়না ইচ্ছা করেই এই ভাইরাস ছড়িয়েছে, এটি ইহুদি/নাসারা/ইলুমিনাতি ষড়যন্ত্র" তাহলে এমন ছাগলামি কথাবার্তায় লাফালাফি না করে ফ্যাক্ট জানার ও বুঝার চেষ্টা করুন।
কেউ যদি বলে "ভ্যাকসিন আবিষ্কার হয়ে গেছে এবং ফর্মুলা এই" তাহলেও পাত্তা দিবেন না। আগেই বলেছি, ভ্যাকসিন আবিষ্কার "হয়তো" হয়েছে, কিন্তু সেটা কতটা কার্যকর, সেটা বুঝতে হলেও আপনাকে অপেক্ষায় থাকতে হবে এক বছর। গুজব ছড়ানো ব্যক্তিদের এড়িয়ে চলুন। আমাদের নবীজি (সঃ) ওদের মিথ্যাবাদী বলেছেন, কুরআনেও আল্লাহ তিরস্কার করেছেন। তাই ওরা যদি নিজেদের আলেম উলামা মুফতি দাবি করে খুশি থাকে, তাহলে তাঁদের জন্য শুভ কামনা।