‘১২০০ অতিথিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল আমাদের বিয়েতে। এছাড়া সকল প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু, সেই খরচের অর্থ আমরা দান করে দিয়েছি।’

চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিয়ের একটা আলাদা ঐতিহ্য আছে। ধুমধামের চূড়ান্ত করা হয় বিয়ের আয়োজনে, তাক লেগে যাওয়ার মতোই ব্যাপার স্যাপার। এই বিয়েতেও সেরকম অনেক আয়োজন ছিল, বারোশো অতিথিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ভোজের জন্যে। কিন্ত সব অনুষ্ঠান বাতিল করেছেন নবদম্পতি, সেই খরচের অর্থটা তারা দান করে দিয়েছেন করোনাভাইরাসের প্রকোপে কার্যত জীবিকা হারিয়ে যারা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপদে আছেন, সেইসব অসহায় মানুষদের জন্যে। 

মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা এই নবদম্পতির বসবাস কক্সবাজার জেলার কুতুপালংয়ে। দুজনে মিলেই নিয়েছেন এই সিদ্ধান্ত, নিজেদের সীমিত সামর্থ্য দিয়েই চেয়েছেন আর্ত মানবতার পাশে দাঁড়াতে, মানুষের বিপদে সাহায্য করতে। করোনাভাইরাসে দেশ মোটামুটি লকডাউন, এর ঝাপটা এসে পড়েছে দিনমজুর শ্রেনীর মানুষের ওপরে, যারা কায়িক শ্রম দিয়েই জীবিকা উপার্জন করে, একটা দিন কাজ না করলে যাদের ঘরে চুলা জ্বলে না, অভুক্ত থাকা লাগে পরিবারের সদস্যদের। 

মানুষের এই বিপদের মুহূর্তে কক্সবাজারের এই নবদম্পতি চাননি বিয়ের অনুষ্ঠানের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে, সেই টাকাটা বরং অসহায় মানুষের কাজে লাগুক- সেটাই ছিল তাদের ইচ্ছা। সেজন্যেই পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠান বাতিল করে সেই টাকা তারা দান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বর হেলাল উদ্দিন বলেছেন, ‘১২০০ অতিথিকে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল আমাদের বিয়েতে। এছাড়া সকল প্রস্তুতিও সম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু, সেই খরচের অর্থ আমরা দান করে দিয়েছি।’

কক্সবাজারে সুশীল সমাজ ও অন্যান্য পেশাজীবীদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে করোনায় কর্মহীন অসহায় মানুষদের সহায়তা দেয়ার জন্যে তহবিল। এর অন্যতম উদ্যোক্তা ইমরুল কায়েস নিশ্চিত করেছেন, ওই নবদম্পতির কাছ থেকে অনুদান পেয়েছেন তারা, বলেছেন- ‘নবদম্পতির কাছ থেকে আমরা ৫০,০০০ টাকা অনুদান পেয়েছি। এটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক একটি ঘটনা।'

ভারতে রতন টাটা গতকাল ৫০০ কোটি রূপি করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা এবং করোনা টেস্টের সরঞ্জাম কেনার জন্যে দান করেছেন। বলিউড সুপারস্টার অক্ষয় কুমার প্রধানমন্ত্রীর দুর্যোগ তহবিলে দিয়েছেন পঁচিশ কোটি রূপি। বিশ্বের যেদিকেই তাকান, দেখবেন, ভালো মানুষগুলো যে যার সাধ্য অনুযায়ী এগিয়ে এসেছেন করোনার মোকাবেলায়। কক্সবাজারের এই দম্পতির হয়তো কোটি কোটি টাকা দান করার সামর্থ্য নেই, কিন্ত তাদের সামর্থ্য যতোটুকু, তার ভেতরে তারা সর্বোচ্চ ত্যাগটাই স্বীকার করেছেন।

বিপদে, বিপর্যয়ে নাকি ভালো মানুষ আর মন্দ মানুষ চেনা যায়। করোনার দিনগুলিতেও আমরা মানুষ চিনতে পারছি। কেউ আখের গুছিয়ে নিচ্ছে অন্যের বিপদকে কাজে লাগিয়ে, কেউ অমানবিক আচরণের চূড়ান্ত নজির স্থাপন করছে। পত্রপত্রিকা আর টেলিভিশনে খবর দেখছি, অসুস্থ রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হতে দেয়া হচ্ছে না এলাকাবাসীর বাধায়, করোনায় মারা যাওয়া রোগীর কবর দিতে দিচ্ছে না এলাকার লোকজন, নিজের এলাকায় কোয়ারেন্টিন সেন্টার যাতে না হয়, সেজন্যে রাস্তায় নামছে কেউ, আবার কেউবা করোনা টেস্টের জন্যে বানানো হাসপাতালের বিরুদ্ধেই রাস্তায় নেমে পড়ছে! চিকিৎসা না পেয়ে সারারাত ভুগে মারা যাচ্ছে মানুষ, কেউ এগিয়ে আসছে না করোনার ভয়ে- এই গল্পগুলো সহজে ভুলবো না আমরা।

এসবেরই বিপরীত ধারায় মন ভালো করে দেয়া কিছু গল্প লেখা হচ্ছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবীরা যেমন দিনরাত এক করে অমানুষিক পরিশ্রম করে চলেছেন, নিজেদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলে কাজ করে চলেছেন একটানা। টিএসসিতে এক ভদ্রলোককে দেখেছি কুকুরদেরকে বিস্কুট খাওয়াচ্ছেন, কারণ জনসমাগম নেই কোথাও, অবলা এই প্রাণীগুলো তো খাবার পাচ্ছে না! সেসবের তালিকায় এবার যুক্ত হলো কক্সবাজারের এই নবদম্পতির বিয়ের আয়োজন বাতিল করে সেই টাকা করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কর্মহীন মানুষদের জন্যে দান করার এই ঘটনাটাও। এমন মানুষগুলো আছে বলেই মহামারীর এই দিনগুলোতে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি আমরা, সুন্দর ভবিষ্যতের কল্পনাটা ভেসে ওঠে মানসপটে... 

তথ্য ও ছবি কৃতজ্ঞতা- দ্য ডেইলি স্টার


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা