চীনের হাসপাতালগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, সুস্থ হয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা ফিরছেন ঘরে। করোনা আউটব্রেকের পর চীন সরকারের রিমার্কেবল স্টেপগুলো তবে কী ছিল?

আজ থেকে একমাস আগেও একদিনে চীনে করোনায় নতুন করে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় পনেরো হাজার। সেখানে গতকাল চীনে নতুন রোগী পাওয়া গিয়েছে মাত্র আঠারোজন!   

বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন করোনায় বিপর্যস্ত, চীন তখন করোনা মোকাবেলায় ধীরে ধীরে জয়ী হচ্ছে।উহানের দুটি হাসপাতাল করোনা আক্রান্ত রোগীর অভাবে বন্ধ ঘোষণা করেছে। WHO এর রিপোর্ট মতে করোনা মোকাবেলায় চীন সরকারের উদ্যোগসমূহ সবচাইতে কার্যকর। 

করোনা আউটব্রেকের পর চীন সরকারের রিমার্কেবল স্টেপগুলো  তবে কী ছিল? 

১/ করোনা আউটব্রেকের সাথে সাথেই  চীন সরকার করোনাকে মিলিটারি যুদ্ধের সাথে তুলনা করে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। জানুয়ারির ২৩ তারিখ থেকে চীন প্রায় পাঁচ কোটি নাগরিককে বাধ্যতামূলক 'কোয়ারেন্টাইন' এ পাঠাতে শুরু করে। হুবেই প্রদেশকে (প্রথম ভাইরাসটি ছড়ায়) চীন থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যেন দেশজুড়ে ভাইরাস মহামারী আকারে ছড়াতে না পারে। বন্ধ করে দেয় স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। চালু হয়, হোম অফিস।  

২/ চীনের ব্যবসায়ী এবং চিকিৎসকগণ এক অভাবনীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। করোনার আঘাতে  বহু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলেও চাইনিজ ব্যবসায়ীরা হুবেই প্রদেশের ঘরবন্দি নাগরিকের মাঝে বিনামুল্যে কফি, চশমা ও অতি দরকারি সামগ্রী বিতরন করে।

৩/ কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠান তাদের পরিবহন ছেড়ে দেয় মেডিক্যাল অফিসারদের রোগীর বাসা থেকে হাসপাতাল আনা নেয়ার কাজে, সুপারশপগুলো বিনামুল্যে খাবার পাকেজিং করে বিতরণে অংশগ্রহন করে। সেনাবাহিনীর অফিসার্স আর সোলজার নেমে আসে নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনায়। 

৪/ প্রায় চুয়াল্লিশ হাজার ভলান্টিয়ার চীনের নানা প্রান্ত থেকে করোনা আক্রান্ত হুবেই প্রদেশে ছুটে এসে স্বেচ্ছা শ্রমে গাড়ি চালায়, ঘরে ঘরে খাবার বিতরন করে, হেলথ ওয়ার্কারের  দায়িত্ব পালন করে।  

৫/ সমগ্র চীনের থেকে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সদের হুয়ান পাঠানো হয় আক্রান্তদের চিকিৎসায়। আক্রান্ত রোগী শনাক্তকরনে চীন জুড়ে ১৮০০ টি পৃথক দল তৈরি করা হয় যাদের কাজই ছিল প্রতিনিয়ত চীনা নাগরিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা।   

করোনা প্রতিরোধে সফলতার পথেই হাঁটছে চীন

৬/ চীনের ন্যাশনাল হেলথ কমিশন ও স্টেট ইনফরমেশন অফিস জানুয়ারি থেকেই প্রতিনিয়ত লাইভ প্রেস কনফারেন্সিং করে নাগরিকদের মাঝে করোনার প্রকৃত তথ্য ও সরকারের পদক্ষেপ তুলে ধরছে। করোনা ইস্যুতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ছিল চীনের প্রধান শক্তি। 

৭/ করোনা শনাক্তকরণ ও চিকিৎসায় চীন ব্যবহার করেছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স, বিগ ডাটার মতো আধুনিক সব প্রযুক্তি। 5G ক্ষমতাসম্পন্ন রোবট ব্যবহার হয়েছে রোগীর মেডিসিন প্রদান,  পরিছন্নতা, রোগীর তাপমাত্রা পরিমাপে। আলি-পে আর উইচ্যাট দুইটি মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যাক্তিকে মনিটরিং এ রাখা হচ্ছে।  

৮/ চীনে ভাইরাসটি ধরা পরার পর এক মুহুর্ত দেরী করেনি বা রোগ লুকানর চেষ্টা করেনি। তারা দ্রুত রোগী শনাক্ত করেছে।  

৯/ উহানে এক সপ্তাহ করোনা চিকিৎসায় দুটি হাসপাতাল নির্মান করেছে, ষোলটি খেলার মাঠ, অডিটরিয়ামকে হাসপাতালে রুপান্তর করেছে  দ্রুততম সময়ে চিকিৎসা শুরু করেছে। ফ্যাক্টরিতে মাত্র ছয়দিনে পর্যাপ্ত ফেইস মাস্ক তৈরি করে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়। 'WHO' চীনের এই তড়িৎ অ্যাকশনকে আখা দিয়েছে 'Remarkable  Speed' 

১০/  বাণিজ্যিক যুদ্ধ থাকলেও করোনা মোকাবেলায় চীন কিন্ত বিশ্বের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। চীন থেকে ইরান, ইতালি, সাউথ কোরিয়ায়  টেস্টিং কিট, মাস্ক, থার্মোমিটার, স্যুট প্রদান করেছে, প্রায় ২০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সাহায্যের ঘোষণা দিয়েছে করোনা প্রতিরোধে। 

এই মুহুর্তে বিশ্বের একশ উনিশটি দেশ করোনায় আক্রান্ত। দেরীতে হলেও চীন মডেল ফলো করতে শুরু করেছে আমেরিকাসহ অন্যান্য উন্নত দেশ। আমেরিকার বেশ কিছু রাজ্যে স্কুল অফিস বন্ধ করা হয়েছে, বিদেশিদের দেশে আগমন নিয়ন্ত্রণ করেছে, এমনকি করোনার কারণে কাজে যেতে না পারলে পে-চেকে আলাদা টাকা যোগ করে দিচ্ছে।

ভারত বিদেশিদের যাবতীয় ভিসা বাতিল করেছে, ট্র্যাম্প ইউরোপের ছাব্বিশটি দেশকে আগামী ত্রিশ দিনের জন্য আমেরিকায় প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, ইতালিকে 'রেড জোন' ঘোষণা করে খাবার দোকান আর ফার্মেসি ছাড়া বাকিসব দোকানপাট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কোন ইতালিয়ান এক শহর থেকে অন্য শহর যেতে চাইলে তাকে পুলিশের কাছে ফরম পূরণ করে কারন ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় পঞ্চাশটি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে যারা মাত্র দশ মিনিটে স্যাম্পল পরীক্ষা করা হচ্ছে, প্রতিদিন দশ হাজারের অধিক মানুষস্বাস্থ্য পরীক্ষা করছে। যারা কোয়ারেন্টাইনের আছে তাদের দেয়া হচ্ছে সরকারী ভাতা।

আর আমাদের এখানে? করোনা ছড়ানোর পর থেকে আমার দেশ প্রায় দুই মাস সময় পেয়েছে প্রস্তুতি গ্রহনের। তারপরও আমরা প্রস্তুত তো করোনার প্রভাবে স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায়? উত্তরটা জানা ভীষণ জরুরী।  


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা