শিশু রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশের প্রধান বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান যে ঢাকা শিশু হাসপাতাল, দেখানেও করোনা আক্রান্তদের কোনো চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে শুধু করোনা 'সন্দেহভাজন' রোগীদের...

ফেব্রুয়ারি মাসে, চীনের বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও যখন করোনাভাইরাস সবে আঘাত হানতে শুরু করেছে, তখন বিবিসি একটি সংবাদ প্রকাশ করেছিল। শিরোনাম ছিল: শিশুরা কেন অসুস্থ হচ্ছে না? সেখানে কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছিল, পাঁচ বছরের বেশি বয়সী এবং কিশোরদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাইরাস মোকাবেলায় বিশেষভাবে কাজ করে। সম্ভবত সে কারণেই তাদের সংক্রমণ বেশ মৃদু, কিংবা তাদের সংক্রমণের কোনো উপসর্গ থাকে না।

এরপর প্রায় চার মাস কেটে গেছে। এখন বিশ্বব্যাপী শিশুদের করোনা সংক্রমণের চিত্র কেমন? এখনও কি বলা যাবে যে শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে না? বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করলে এ কথা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে শিশুদের করোনায় সংক্রমণের হার তুলনামূলক কম। মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ। অন্যদিকে মৃত্যুহারও ১ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ, করোনার করালগ্রাস থেকে বিশ্বের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এখনো অনেকটাই মুক্ত।

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

তবে দাঁড়ান, এটুকু পড়েই কেউ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন না। কারণ এতক্ষণ যা বললাম, তা কেবল সমগ্র বিশ্বের চিত্র। নিশ্চয়ই জানার আগ্রহ আছে, শুধু বাংলাদেশে শিশুদের করোনায় সংক্রমণের হার কেমন। এবং সে পরিসংখ্যান জানার পর নিঃসন্দেহে আর এতটা স্বস্তিতে থাকতে পারবেন না। কারণ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ আমাদের সামনে যে তথ্য হাজির করেছে, সে অনুযায়ী শনিবার (১৩ জুন) পর্যন্ত দেশের মোট আক্রান্তের মধ্যে প্রায় ৮ শতাংশই হলো শিশু। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত যেহেতু বাংলাদেশে ৮৪ হাজার ৩৭৯ জনকে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি হলো শিশু। এবং এদেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হারও সামগ্রিক বৈশ্বিক পরিস্থিতির চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ, ২ দশমিক ৩১ শতাংশ।

এ পরিসংখ্যানকে আরেকটু বিশ্লেষণ করা গেলে গোটা দৃশ্যপট আপনাদের সামনে হয়তো আরো পরিষ্কার হবে। শনিবার পর্যন্ত দেশে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ১ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশু ৩ শতাংশ, এবং ১১ থেকে ২০ বছর বয়সী ৭ শতাংশ। সুতরাং দেশের ২০ বছর বয়স পর্যন্ত নাগরিকদের আক্রান্তের হারই ১০ শতাংশ। এবং যেহেতু ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু ধরা হয়, তাই অনুমান করা হচ্ছে যে ওই বয়সসীমার মধ্যে আক্রান্তের হার ৮ শতাংশের আশেপাশে।

তো, এই তথ্য জেনে আপনাদের ভ্রূ কোঁচকানোই স্বাভাবিক। কারণ এতদিন হয়তো ভেবে এসেছেন, শিশুদের নিয়ে তো তেমন চিন্তা নেই। ওদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, তাই ওদের কিছু হবে না। আর হয়তো সেই কথা চিন্তা করেই অনেকে যখন খুশি বাড়ির বাইরে গেছেন, সামাজিক দূরত্ব মানেননি। কারণ আপনাদের থেকে যে আপনাদের সন্তানদের শরীরেও করোনা সংক্রমিত হতে পারে, সে কথা আপনাদের মাথায় ছিল না। 

এদিকে দশ বছরের অধিক বয়সী শিশু, যাদেরকে কিশোর ধরা হয়, তাদের করোনায় আক্রান্তের হওয়ার হার এত বেশিও হয়তো এই কারণে যে, দীর্ঘ সময়ে ঘরে বন্দি থেকে যখন তারা অস্থির হয়ে গেছে কিংবা হাঁসফাঁস করতে শুরু করেছে, আপনারা নির্দ্বিধায় তাদের বাড়ির বাইরে যেতে দিয়েছেন। কারণ সেই একই, আপনারা ভেবেছেন ওদের আর কী হবে!

অথচ খেয়াল করে দেখুন, ওরাও ঠিকই করোনায় সংক্রমিত হচ্ছে। আর কেন হচ্ছে, সেটাও জেনে নিন। আমাদের দেশের শিশুদেরকে উন্নত বিশ্বের শিশুদের মতো উচ্চ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মনে করার কোনো কারণ নেই। আমরা হলাম তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমাদের দেশের শিশুরা তুলনামূলকভাবে বেশি পুষ্টিহীনতায় ভোগে। এদিকে আমাদের দেশের শিশুদের বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরিমাণও অনেক বেশি। 

করোনায় কতটা ঝুঁকিতে আছে আমাদের শিশুরা?

হয়তো জানেন না, ২০১৭ সালে বিশ্বের মোট যক্ষ্মা রোগীর ১৩ শতাংশই ছিল বাংলাদেশী, এবং তাদের একটা বড় অংশ ছিল শিশু। এদিকে ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, এদেশে ১৩ শতাংশ শিশুর মৃত্যু হয় নিউমোনিয়ায়। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি হাজারে ৮ থেকে ১০ জন হৃদরোগে ভোগে। আর থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, এদেশে প্রতি ১৪ জন শিশুর মধ্যে একজন থ্যালাসেমিয়ার বাহক। 

এই যখন অবস্থা, সেক্ষেত্রে এদেশের শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যে মোটেই শক্তিশালী নয়, বরং করোনাভাইরাসের সামনে একটু বেশিই নাজুক, সে কথা বলা বাহুল্য। তার উপর যখন অভিভাবকরা নিজেরাও যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানে না এবং শিশুরা মানল কি না সেদিকেও খেয়াল রাখে না, তখন তো শিশুদের জীবন হুমকির মুখে পড়বেই।

এতদিনে দেশে এমন একজন মানুষও হয়তো খুঁজে পাওয়া বিরল যে এ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর চোখ বুজে ভরসা রাখতে পারে। যদি এমন কেউ থাকে, তার গলায় সোনার মেডেল পরিয়ে দেয়া আবশ্যক। তারপরও ধরে নিলাম দেশের কোথাও না কোথাও এমন একজন মানুষ ঘাপটি মেরে আছে। তাকে উদ্দেশ্য করে বলছি, এ দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা করোনা আক্রান্ত বয়স্ক রোগীদের জন্য যেমনই হোক না কেন, শিশুদের জন্য মোটেই ভরসাজাগানিয়া নয়। 

এদেশে করোনা আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ১৪ শয্যাবিশিষ্ট একটি করোনা ডেডিকেটেড ইউনিট চালু করা হয়েছে। কিন্তু সেখানে নেই আইসিউ, ভেন্টিলেটর ও ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা। দেশের অন্যান্য হাসপাতালের অবস্থা তো আরো দুর্বিষহ। শিশু রোগীদের চিকিৎসার জন্য দেশের প্রধান বিশেষায়িত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান যে ঢাকা শিশু হাসপাতাল, দেখানেও করোনা আক্রান্তদের কোনো চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে শুধু করোনা 'সন্দেহভাজন' রোগীদের। 

এর কারণ কী? কারণ হলো, তাদের ২২ শয্যার একটি আইসোলেশন ইউনিট চালু থাকলেও, করোনা ডেডিকেটেড পৃথক কোনো ব্যবস্থাই নেই। সেটির জন্য বরাদ্দ চেয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাহায্য চাওয়া হলেও, কোনো আশ্বাস মেলেনি। কিন্তু করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়া শিশুদের অন্য শিশুদের সাথে একত্রে রাখলে তো তাদের মাঝেও ভাইরাস সংক্রমিত হবে। সে কারণে শনাক্ত হওয়ার পর শিশুদের আর হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দেয়ার বদলে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। 

যদি ভেবে থাকেন করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়া শিশুদেরকে হয়তো সরকার নির্ধারিত করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করা সম্ভব, সে আশারও গুড়েবালি। কেননা সেসব হাসপাতালেও ভেন্টিলেটরসহ শিশুদের জন্য আইসিউর ব্যবস্থা নেই। তাছাড়া এসব হাসপাতালে পোস্ট অপারেটিভ সেন্টারও নেই যে সার্জারি করার পর শনাক্ত হওয়া শিশু রোগীদেরকে রাখা যাবে। 

সব মিলিয়ে দেশে করোনা পজিটিভ শনাক্ত হওয়া শিশুদের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থাকে কোনোভাবেই আশাব্যঞ্জক বলা যাবে না। ফলে সরকারের নিকট আবেদন থাকবে যেন করোনায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য যথাযথ চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা হয়। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু না করার সিদ্ধান্ত অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু তাদের বোঝা আবশ্যক যে ইতোমধ্যে যারা আক্রান্ত হয়ে গেছে তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। 

পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতাও একান্তভাবে কাম্য। আপনাদের শিশুরা করোনায় সংক্রমণের হুমকি থেকে মুক্ত, এই ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে তাদেরকে বাড়ির বাইরে যেতে দেবেন না, এবং অপ্রয়োজনে নিজেরাও বারবার বাড়ির বাইরে গিয়ে, স্বাস্থ্যবিধি না মেনে তাদেরকে বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন না।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা