আমরা মানুষ। আমাদের মাঝে কামনা-বাসনা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। আমাদের বরং শিখতে হবে- সেই ইচ্ছেটাকে কীভাবে দমন করা যায়। এখানেই সভ্যতা এবং অসভ্যতা’র মাপকাঠি!

পৃথিবী জুড়ে নানান দেশ ঘুরে বেড়ানোর সুবাদে এক ধরনের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে অল্প কিছু না হয় শেয়ার করা যাক।

ঘুরতে গেলে সব সময় তো আর ভালো হোটেলে থাকার সুযোগ হয় না; কারণ অর্থ এবং সামর্থ্যের একটা ব্যাপার আছে। তাই অনেক সময় কম খরচের হোস্টেল খুঁজে বের করতে হয়। এইসব দেশে এই ধরনের হোস্টেল গুলোকে মুলত ব্যাকপ্যাক হোস্টেল বলে। এই সব হোস্টেলে দেখা যায় এক রুমে কোথাও এক সঙ্গে আট কিংবা বারো'টা বেড থাকে। কোথাও আবার এর চাইতেও বেশি বেড! কোথাও কোথাও বাঙ্ক বেডও থাকে। অর্থাৎ দুই'তলা, তিন'তলা বেড।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে- এইসব রুমে কি ছেলে-মেয়ে এক সঙ্গে থাকে? হ্যাঁ, ছেলে-মেয়ে এক সঙ্গেই থাকে। কেউ কাউকে চেনে না, জানে না। সবাই হয়ত ঘুরতে এসেছে। ছেলেটা হয়ত উপরের বেডে থাকছে, আরেক মেয়ে হয়ত নিচের খাটে। কিংবা মেয়েটা উপরের বেডে, ছেলেটা নিচে। কিংবা উপর নিচ যদি না থাকে; তাহলে ছেলে-মেয়ে সবাই এক রুমে বেডের মাঝে ঘুমাচ্ছে। এই মেয়েরা কি সম্পূর্ণ অপরিচিত এই ছেলেপেলে গুলোর সঙ্গে একই রুমে ঘুমাতে অনিরাপদ বোধ করে? মোটেই না। এরা মহা আনন্দে, মনের সুখে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের সময় হয়ত কারো কাপড়-চোপর ঠিক নাও থাকতে পারে। ছেলেদের ব্যাপারেও সেটা হতে পারে। তো, তখন কি ছেলেগুলো গিয়ে ওই মেয়ে গুলোর ওপর হামলে পড়ে? 

না, পড়ে না। এর মানে কি এই- ওই ছেলেগুলো কিংবা মেয়েগুলোর মাঝে যৌন তাড়না কিংবা কামনা জেগে উঠতে পারে না? উত্তর হচ্ছে-অবশ্যই পারে। এটা তো অস্বাভাবিক কিছু না। মানুষজনের মাঝে যৌন তাড়না কিংবা কামনা থাকা তো অস্বাভাবিক কিছু না। তাহলে পৃথিবী জুড়ে যে এমন হাজারো হোস্টেল আছে, সেখানে কেন ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে না?

কারণ হচ্ছে- এরা এদের ইচ্ছেগুলোকে দমন করতে পারে। এবং অতি অবশ্যই এরা হিপক্রেট না। সকাল বেলাতেই হয়ত ঘুম থেকে উঠে অপরিচিত ছেলেটা মেয়েটাকে বলে বসবে- তুমি তো বেশ সুন্দরী, রাতের বেলায় তোমাকে দেখছিলাম। মেয়েটাও এতে কিছু মনে না করে হয়ত বলে বসবে- ধন্যবাদ তোমাকে।

এইসব দেশে সামারে তো ছেলে-মেলেরা জামা-কাপড় অর্ধেক খুলে রাস্তায় ঘুরাফেরা করে। এর মানে কি এই- এই সব দেশে ছেলে মেয়েদের যৌন কামনা নেই; কিংবা এদের মাঝে এমন প্রবৃত্তি জেগে উঠে না? তাই বলে কি তারা কারো গায়ে খানিক হাত দেয়ার চেষ্টা করবে? কিংবা যা ইচ্ছে তাই বলে দিবে? না, এরা হয়ত তাকাবে, ভালো লাগলে হয়ত আরেকবার তাকাবে; কিন্তু গিয়ে হাত লাগাবে না কিংবা উল্টো-পাল্টা কিছু বলতে যাবে না।

আমরা যেহেতু মানুষ, সবাই তো পশু শ্রেণীর। সুতরাং এই প্রবৃত্তি যেমন বাংলাদেশের একটা ছেলের থাকতে পারে, ঠিক তেমনি ইউরোপের একটা ছেলেরও থাকবে। তবে সভ্যতার পার্থক্যটা হচ্ছে- এরা এদের ইচ্ছেটাকে দমন করতে পারে। এরা জানে কারো গায়ের সঙ্গে লেগে যাওয়া কিংবা বিনা অনুমতিতে যে কোন ধরনের শারীরিক সংস্পর্শ অন্যায় ও অসভ্যতা। 

তাই বলে এমন না, এরা মেয়েদের দিকে তাকায় না, কিংবা এদের মাঝে কামনা-বাসনা জাগে না! আর আমাদের দেশের দিকে তাকালে মনে হবে- এই সমাজে এক দল হচ্ছে ধর্ষক শ্রেণীর; আরেক দল হচ্ছে একদম পুত-পবিত্র। যারা হয়ত কোন মেয়েদের দিকে তাকায় না, তাদের মনে হয় কোন কামনা-বাসনাও জাগে না। এরা সবাই হচ্ছে মহাপুরুষ টাইপের মানুষ। এদের মাঝে আবার আরেক দল আছে- যারা মেয়েদের জামা-কাপড় নিয়ে দিন রাত চিন্তায় থাকে।

এমনই একদল সরকারি কর্মকর্তা ক্যাডার বেশ কয়েক বছর আগে এসেছিল বিদেশে ট্রেনিং এ। আমার সঙ্গে বিদেশেই পরিচয়। প্রথম পরিচয়েই ভদ্রলোক জানতে চাইলেন- ভাই আপনাদের এখানে ন্যুড বীচ আছে না? আমাকে একটু নিয়ে চলেন ভাই! ন্যুড বীচে যেতে চাওয়া খারাপ কিছু না। সে যেতেই পারে। তবে আমি অবাক হয়েছিলাম- প্রথম পরিচয়েই সে আমাকে ন্যুড বীচে যাবার কথা বলেছে। এর চাইতেও অবাক হয়েছি, দেশে ফিরে যাবার পর এই একই ভদ্রলোক বছর কয়েক পরে একটা স্ট্যাটাসে লিখেছেন- মেয়েদের উচিত জামা-কাপড় ঠিক মতো পড়া। নইলে তো ধর্ষণের জন্য দায় তাদেরও থাকে।

এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা। হিপক্রেসি বোধকরি একেই বলে! কিছু কিছু বিষয় মনে হয় আমাদের সমাজে খোলামেলা ভাবে আলোচনা করার সময় হয়েছে। একটা ছেলে একটা মেয়ের দিকে তাকাতেই পারে। সেটা একটা মেয়ের ক্ষেত্রেও হতে পারে। সে একটা ছেলের দিকে তাকাতেই পারে। সেখানে কামনা-বাসনাও থাকতে পারে। আমরা তো কেউ মহাপুরুষ নই, আমরা অতি সাধারণ মানুষ। এই ব্যাপারগুলোকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে আমাদের শিখতে হবে- কোথায় থামতে হয়।

ভালো লাগতে পারে, কামনা-বাসনাও জাগতে পারে। কিন্তু কোন ভাবেই সেটাকে কারো বিনা অনুমতিতে শারীরিক সংস্পর্শে আনা যাবে না; এক'ই সঙ্গে মৌখিক ভাবে কারো সম্পর্কে কোন খারাপ মন্তব্য করা যাবে না। আপনার যদি কাউকে সুন্দর লাগে, আপনি তাকে গিয়ে বলতে পারেন- তোমাকে আজ সুন্দর লাগছে। কাউকে যদি ভালো লাগে, গিয়ে বলতে পারেন- তোমাকে আমার ভালো লাগে। এর বেশি কোন ভাবেই এগুনো যাবে না অন্য পক্ষে'র অনুমতি ছাড়া।

এই বিদেশেও বাংলাদেশিদের আয়োজনে নানান পার্টিতে গেলে দেখা যায়- ছেলেরা এক দিকে বসে আছে, মেয়েরা আরেক দিকে বসে আছে! কেন? ছেলেরা-মেয়েরা এক সঙ্গে বসে আড্ডা দিতে সমস্যা কোথায়? এর মাঝে যদি কারো- কাউকে ভালো লাগে, সুন্দর লাগে; সেটা বলে দিতেই বা সমস্যা কোথায়? 

ব্যাপারগুলোকে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে বাস করছি। দেশের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে বসে ছেলেটা কিংবা মেয়েটা হলিউড কিংবা বলিউড মুভি দেখছে। তার হয়ত হলিউড কিংবা বলিউড তারকাদের মতো ফ্যাশন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার হয়ত সেভাবে চুল কাটতে ইচ্ছে হচ্ছে। আর আপনাদের চেয়ারম্যান আর পুলিশ অফিসার কিনা ঘোষণা করছে- ফ্যাশন করে চুল কাটলে জরিমানা দিতে হবে। যে কোন সমাজে নানান অস্থিরতা তৈরি হয় এই ধরনের দ্বান্দ্বিক অবস্থার জন্য।

পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে আমাদের সমাজ। এখন আপনি যদি পুরনো সংস্কৃতিগুলোকে এভাবে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান, সেটা আপনি পারবেন না। বরং অস্থিরতা আরও বাড়বে। হত্যা, ধর্ষণ বাড়তেই থাকবে। তার চাইতে বরং আমাদের সবার জানা উচিত এবং আমাদের শেখানো উচিত- কোথায় থামতে হয়! ইচ্ছে হবে, খুব ইচ্ছে হবে; সেই ইচ্ছেটাকে আমরা খারাপ চোখে দেখবো না। কারণ আমরাও মানুষ। আমাদের মাঝে কামনা-বাসনা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের বরং শিখতে হবে- সেই ইচ্ছেটাকে কীভাবে দমন করা যায়। এখানেই সভ্যতা এবং অসভ্যতার মাপকাঠি!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা