ম্যাডিসন স্কয়ার সেদিন মুখরিত হয়েছিল 'বাংলাদেশ! বাংলাদেশ!' ধ্বনিতে
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

কনসার্টের টিকেট বিক্রির আগে জানিয়ে দেয়া হয়েছে বব ডিলানও উপস্থিত থাকবেন। সবাই অবাক। বব ডিলান কোথেকে এলো আবার! এই লোক তো কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্যেই গাইতে আসছে না। হ্যারিসন বললেন, 'আমি ডাক পাঠিয়েছি। আমার বিশ্বাস সে আসবে।'
লস এঞ্জেলস থেকে প্রিয় বন্ধু রবি শংকরের ফোন পেয়েছেন জর্জ হ্যারিসন। কথার শুরুতেই, রবি শংকরকে খানিকটা বিচলিত দেখালো এবং তিনি নিজেই জানান দিলেন তিনি একটি মানবিক সাহায্যের প্রয়াসের জন্য এমুহুর্তে যোগাযোগ করেছেন। জর্জ হ্যারিসন শুনলেন সবকিছু এবং বললেন, দেখি আমি কি করতে পারি। আমাকে সময় দিতে হবে।' খানিকটা আশ্বস্ত ও আশাবাদী হলেন পন্ডিত।
গেল বসন্তেই 'বিটলস' ভেঙে গেছে! 'ফ্যাব ফোর' হিসেবে খ্যাত জন লেনন, পল ম্যাকার্টনি, জর্জ হ্যারিসন কিংবা রিঙ্গো স্টারের তখন যে যার নিজস্ব পথ ধরেছেন। যদিও মিডিয়ায় এর রেশ কাটেনি, বিশেষত লেনন আর ম্যাকার্টনির একে অপরকে নিয়ে নেতিবাচক বয়ানবাজি তো চলছিলোই। ব্যান্ডের বাকি দুই সদস্য হ্যারিসন আর রিঙ্গো প্রচন্ড অভিমান ও কষ্ট নিয়ে সময় পার করছিলেন, এবং নিজেদের সলো ক্যারিয়ারের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। পাশাপাশি নিজেদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগটাও তাদের বিদ্যমান ছিল।
পন্ডিত বন্ধুর ফোন পাওয়ার পর, জর্জ নিজেই লস এঞ্জেলসে দেখা করতে গেলেন পন্ডিতের সাথে। পন্ডিত তাঁর পশ্চিমা বন্ধুকে বললেন কিভাবে একটি জাতি, জাতিসত্ত্বা, ভূখণ্ডকে মানবতাবিরোধী অপকর্মে, গণহত্যার ঘৃণ্য উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। প্রচন্ড বিচলিত কন্ঠে জানালেন আকুতি, যদি কিছু একটা করা যায়। অন্তত বিশ্ববাসীকে সেই ভয়ংকর, বিভীষিকার চিত্র তুলে ধরার প্রয়োজনে যদি কিছু করা যায়। আর পন্ডিতকে কাছ থেকে এতটা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ও অবসাদে দেখে, জর্জ সম্মতি দিয়ে বললেন, আমরা অবশ্য কিছু করতে যাচ্ছি।
কিন্তু বিশ্ববিখ্যাত সেতার বাদক পন্ডিত রবি শংকর কেন এতো তীব্র কষ্ট অনুভব করছিলেন পূর্ব বাংলার জন্য? পন্ডিত নিজে শুধু বাঙালিই ছিলেন না, বরং তাঁর আদি পৈত্রিক নিবাস ছিল পূর্ব বাংলার নড়াইলের কালিয়া উপজেলায়। নিজের মাতৃভূমিতে শকুনের ছোবল তাঁকেও কুঁকড়ে খাচ্ছিলো প্রতিমুহূর্তে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, অস্বাভাবিক সংখ্যায় সীমান্তে শরণার্থীদের আগমন, দুর্ভিক্ষ-বন্যা পরিস্থিতি সবকিছু দেখে আর এড়িয়ে যেতে পারেননি পন্ডিত, অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলছিলো তাঁর মনোজগতে।
জর্জ এক এক করে বেশ কিছু কাছের বন্ধুকে ডাক দিলেন। নিজের দীর্ঘদিনের সহকর্মীদেরও সেই ডাক পাঠানো হলো। কিন্তু অদ্ভুত হলেও সত্য তখনো ম্যাকার্টনি আর লেনন নিজেদের সংকীর্ণতা থেকে বের হতে পারেনি। তারা একসাথে মঞ্চে উঠলে সবাই বিষয়টিকে বিটলসের রিইউনিয়ন হয়েছে দাবী করবে এই বাজে অজুহাত দেখিয়ে ম্যাকার্টনি সরাসরি না জানিয়ে দিয়েছিলেন। আর জন লেননকে তো খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছিলো না, হয়তো না বলার সৎসাহসটুকু নেই বলে লেনন পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। তবে সুদূর স্পেনে অবস্থানকারী রিঙ্গো স্টার ইতিবাচক সম্মতি দিলেন। পাশাপাশি বন্ধুকে সাহস দিয়ে বললেন, 'তুমি এগোতে থাকো৷ আমি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, আমি এসে হাজির হবো৷'

একে একে এরিক ক্ল্যাপটন, লিওন রাসেল, পিটি হাম, বিলি প্রিস্টন সবাই সম্মতি জানিয়ে দিয়েছেন। কনসার্টকে পূর্ণতা দিতে চমৎকার একটি গ্রুপ তৈরি করে ফেললেন জর্জ হ্যারিসন যা পরিচিতি লাভ করেছিল 'Harrison's All Star' গ্রুপ নামে। কনসার্টের সকল টিকিটের বিক্রি হয়ে গেছে, বিক্রির আগে জানিয়ে দেয়া হয়েছে বব ডিলানও উপস্থিত থাকবেন। এবার অবাক হলেন, হ্যারিসনের বন্ধুরাও। বব ডিলান কোথেকে এলো আবার! এই লোক তো কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্যেই গাইতে আসছে না। হ্যারিসন বললেন, 'আমি ডাক পাঠিয়েছি। আমার বিশ্বাস সে আসবে।'
কনসার্ট হবে আগস্টের প্রথম দিন, নিউইয়র্কের বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কয়ারে। নাম দেয়া হলো, 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। কিন্তু এই শিরোনামে এতোই কি সহজ ছিল আমেরিকার বুকে দাঁড়িয়ে কনসার্টটি করা! কেননা পরাক্রমশালী খোদ আমেরিকা সরকারই যে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামকে রুখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে চলেছে। ঘাবড়ালেন না জর্জ, গণতান্ত্রিক কাঠামোয় ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে গেলেন, হইচই পড়ে গেল চারিদিক। পুরো আমেরিকায় তাক লেগে গেল! যে রক ধাঁচের গান কেবলই নিজেদের বিনোদনের তুঙ্গে নিয়ে যাওয়ার বস্তু হিসেবে বিবেচিত হয় তা দিয়ে একটি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে দাঁড়াচ্ছেন হ্যারিসন! অনেকে যেন এই আইডিয়াকে বিশ্বাসই করতে চাইছিলেন না, অনেকের কল্পনাকেই ধাক্কা দিয়েছিলো পুরো ব্যাপারটি। মিডিয়া তো প্রশ্ন করেই বসলো, পৃথিবীর এতো বিষয় থাকতে- বাংলাদেশই কেন? জবাবে বলেছিলেন, কারণ আমার বন্ধু তাঁর দেশের জন্য সাহায্য চেয়েছে! আর এমন বিষয়ে না বলার সুযোগ নেই।
অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো, চল্লিশ হাজার দর্শকের ম্যাডিসন স্কয়ারে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ভাতৃত্ব ও মানবতার স্লোগানে তখন মুখরিত পুরো ম্যাডিসন স্কয়ার! শুরুতেই দর্শকমনকে আচমকা নাড়া দিলেন হ্যারিসন। রক ধারার মঞ্চে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশনের জন্য হ্যারিসন আহ্বান জানালেন পন্ডিত রবি শংকর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান-কে। শুরু হলো সেতারের জাদুকরী মূর্ছনা। রবি শংকর শোনালেন নিজের সম্পাদিত বিখ্যাত 'বাংলা ধুন'! অদ্ভুত মুগ্ধতায় আমেরিকান দর্শক তা সাদরে গ্রহণ করলেন, তালি বাজালেন। এরপরেই শুরু হলো ষাট দশকের বিখ্যাত সব রক গানের কারিশমা।
কয়েক বছরের নিভৃতচারী জীবন ও নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে, সকল জল্পনা কাটিয়ে মঞ্চে জনসম্মুখে এলেন বব ডিলান-ও। হ্যারিসন, লিওন রাসেল আর ডিলানের সাথে ক্ল্যাপটনের গিটার, রিঙ্গোর ড্রাম আর প্রিস্টনের পিয়ানো যেন একটি জাতির স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জানান দিচ্ছিলো প্রতি মুহুর্তে। জর্জ হ্যারিসন গাইলেন, 'বাংলাদেশ'! কেবল চল্লিশ হাজার দর্শক নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছেই যেন তিনি গানের ভাষায় আকুতি করছিলেন, 'I want to hear you say, Relieve the people of Bangladesh'! আর এই গানে ম্যাডিসন স্কয়ারে দর্শকের প্রতিক্রিয়া ও উৎফুল্লতা ভিত নাড়িয়ে দিচ্ছিলো সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন সরকারের মসনদের। জাগ্রত হচ্ছিলো বিশ্ব-বিবেক, জাগ্রত হচ্ছিলো বিশ্ব-জনমত। হ্যারিসনের গর্জনে বিশ্ব মিডিয়ায় অগ্রাধিকার পেয়ে শিরোনাম হলো 'বাংলাদেশ ও বাঙালি'।

পুরো পশ্চিমা বিশ্ব অবাক হয়ে রইলো। যে জর্জ হ্যারিসন কম কথার মানুষ বলে পরিচিত সর্বমহলে, চিরকালই 'Quite Beatle' এর তকমা পেয়েছেন মিডিয়ায়। তিনিই এভাবে বিস্ময়করভাবে এগিয়ে এসে তীব্র প্রতিবাদের ভাষায় একজন যোদ্ধা রূপে অবতীর্ণ হলেন। প্রথমবারের মতো সমগ্র পৃথিবীর কাছে বার্তা দিলেন, সুর তুলেও যুদ্ধটা করা যায়। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়। গান সেতো নিখাদ বিপ্লবের ভাষা, চেতনার অগ্নি মিশালের জ্বালানি।
জর্জ হ্যারিসন সেদিন সফল হয়েছিলেন অনেক ভাবেই৷ যে আড়াই লক্ষ মার্কিন ডলার টিকেট ক্রয়ে উঠেছিলো, পুরোটাই ইউনিসেফ এর মাধ্যমে শরণার্থী শিবিরের জন্য দান করেছিলেন। এতটুকুতেই থেমে থাকেননি সেই হ্যারিসন ও তাঁর বন্ধুরা। ১৯৮৫ সালে ফের আবার স্বাধীন বাংলাদেশকে ইউনিসেফ এর মাধ্যমে অর্থ দিয়েছিলেন। কনসার্টের ডিভিডির বিক্রিতে, সেই দানকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার! তবে অর্থ দানের বাইরে গিয়ে দুটো বিষয়ের সফলতা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল। প্রথমত, সেই কনসার্ট বিশ্ব বিবেককে এতটাই তাড়িত করতে সামর্থ্য হয়েছিলো, যার ফলে বিভিন্ন দেশের সাধারণ জনগণ ও প্রতিবাদী কর্মীরা রাস্তায় নেমে এসে নিজ নিজ সরকারকে চাপ প্রয়োগ করা শুরু করেছিলো আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। দ্বিতীয়ত, এই কনসার্ট একটি ইতিবাচক ট্রেন্ড চালু করতে সক্ষম হয়েছিলো পুরো বিশ্বে। অনেকেই দৃঢ়চিত্তে বলে থাকেন, ১৯৮৫ সালের 'Live Aid' থেকে শুরু করে 'Band Aid', 'Farm Aid' এর মতো কনসার্ট হতো না যদি কখনো 'Concert For Bangladesh' না হতো। রক মিউজিক এর শুধুমাত্র বিনোদন ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক চেতনায় সীমাবদ্ধতার ক্ষেত্রকে ভঙ্গ করে নতুন দ্বার ও ধারণা উন্মোচন করতে পেরেছিলেন জর্জ হ্যারিসন। যা তাঁকে অমর করেছে, এবং এই ধারার প্রবর্তক বানিয়েছে। অনেকেই বলেন, জর্জের চেয়ে ভালো গিটারিস্ট বা কম্পোজার হয়তো এসেছেন এবং আসবেন, কিন্তু সংগীতকে মানুষের জীবন সংগ্রামের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত করতে পারার ধারাটা যিনি সর্বপ্রথম দেখিয়েছেন তিনি একজন জর্জ হ্যারিসনই। এই অবস্থান বরাবরই তাঁর।
সুতরাং বলাই বাহুল্য, জর্জ হ্যারিসন ও পন্ডিত রবি শংকরের এই আয়োজন পৃথিবীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে এক চিরস্থায়ী আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছিলো যা আজও বিশ্ব জীবনের রূঢ় বাস্তবতায় প্রাসঙ্গিক। এই দুই মহারথীকেই মরণোত্তর দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ 'স্বাধীনতা সম্মাননা'। আজও এই দেশের প্রতিটা শিশু নিজেদের পাঠ্য বইয়ে হ্যারিসনকে বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে জানতে শিখে। আজও হ্যারিসন বাঙালির মনস্তাত্ত্বিক জগতে একজন মহীরূহ, মুক্তি সংগ্রামের একজন মহানায়ক। আর আমাদের সংস্কৃতি ও দীর্ঘ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে সেই বিখ্যাত গান 'বাংলাদেশ' এবং সুরের তান 'বাংলা ধুন'।
দুর্ভাগ্য আমাদের, বাংলাদেশের পরম বন্ধু জর্জ হ্যারিসন কখনো স্বাধীন বাংলায় পা রাখেননি৷ আমরা তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসতে পারিনি এ ভূখন্ডে। একইভাবে সবার জন্যই কথাটা সত্য। বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, এরিক ক্ল্যাপটনরা এখনো বেঁচে আছেন। এই আক্ষেপ মেটানোর জন্য হলেও, আগামী বছরে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে আমরা কি পারি না বছরের যেকোনো একটি দিন এই কনসার্টকে আলাদাভাবে স্বীকৃতি দিতে এবং তাঁদের স্মরণ করতে?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন