এই আইডিগুলো ট্র্যাক করলে দেখা যায় এরাই মেয়েদের সাথে লুলামি করে বেড়ায়। ইনবক্সে তাদের গোপনাঙ্গের ছবি পাঠায়, পর্ন ভিডিও পাঠায়, প্রেম/বিয়ের প্রপোজাল কোনোকিছুই বাদ যায় না।

আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া এখন একদল উগ্রবাদী অকালকুষ্মাণ্ডদের দখলে। যেকোনো অনলাইন প্ল্যাটফর্মের কমেন্ট সেকশনেই তার প্রমাণ মেলে। মতের বিরুদ্ধে গেলেই তারা দলবলে এসে হাজির হয়। এরপর শুরু করে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ, ট্রলিং, বুলিং। হীনমন্য আচরণে মনে হয় এই নোংরামির ওপর তাদের পিএইচডি করাই আছে। মায়ের পেটে থাকতেই নিয়েছে এর ট্রেনিং। 

আমরা নিয়মিত বাকস্বাধীনতার কথা বলি, মত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তবে সেটা হতে হবে যৌক্তিক। সমালোচনা করতে হবে যুক্তি দিয়ে, বাজে আচরণ দিয়ে নয়। অথচ এই গাছবলদেরা গালাগালি করে মত প্রতিষ্ঠায় ব্যকুল। গত কয়েক বছর ধরে কমেন্টে গালাগালি, নোংরামি যত রকমের সীমা আছে সব অতিক্রম করে বসে আছে।

এই অনাকাংখিত ব্যাপারটি তদারকি করবার মতো সময় হয়তো সাইবার ক্রাইম ডিপার্টমেন্টের নেই। নয়তো স্পষ্ট আইন থাকা সত্ত্বেও তার প্রয়োগ করা হচ্ছে না কেন? এরা সাহসই বা কোথায় পাচ্ছে এমন করার? বর্তমানে ব্যাপারটি অতিরিক্ত মাত্রায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দলে ভারী হবার আগেই এদের প্রতিহত করার করার দরকার ছিলো। অথচ সম্মিলিতভাবে আমরা এর প্রতিবাদ করিনি। কাউকে গালি খেতে এখলে উল্টো বসে মজা লুটেছে বাকীরা।

ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এই নোংরা ব্যাপারটিকেও জায়েজ করে নিচ্ছে তাদেরই একটি দল। তারা কমেন্টগুলো এমনভাবেই লিখে, দেখলে মনে হবে না জানি কত ধর্মপ্রাণ মানুষ এরা। অথচ এদের প্রোফাইলে ঢু মারলেই দেখা যায় এদের কী অবস্থা। দুনিয়ার যত নোংরা ফেইক প্রোফাইলের সাথে এড থাকে এদের,  চটি পেইজগুলোয় লাইক দিয়ে ভরিয়ে রাখে, টাইমলাইনে মেয়েদের ছবি শেয়ার করতে থাকে বেহায়াদের মত।

কমেন্ট সেকশনে ধোয়া তুলসীপাতা সেজে থাকা এই আইডিগুলো ট্র্যাক করলে দেখা যায়, এরাই আবার মেয়েদের ইনবক্সে লুলামি করে বেড়ায়। ইনবক্সে তাদের গোপনাঙ্গের ছবি পাঠায়, পর্ণ ভিডিও পাঠায়, প্রেম/বিয়ের প্রপোজাল কোনোকিছুই বাদ যায় না। ব্যক্তিজীবনে এদের কোনও সাফল্যের খোঁজ পাওয়া যায় না। সেটা থাকলে এমন হীনম্মন্য আচরণ এরা করতো না। প্রচন্ডরকম সেক্সুয়ালি ফ্রাস্ট্রেটেড না হলে তো এমন করার কথা না। তাই না?

যদি মনে করে থাকেন লেখাপড়া করেনি এমন লোকগুলাই এই আচরণ করে তবে আপনি বোকার রাজ্যে বাস করছেন। এই কাজগুলো ধনী-গরীব-শিক্ষিত-মূর্খ সবাই করছে। কারণ তারা জানে এর কোনও বিচার হবে না। এই যে নোংরা কমেন্ট, বা দলবেঁধে আক্রমণ- এই ব্যাপারগুলোকে আমরা আসলে গুরুত্ব না দিতে দিতে এদের সাহস আরও বাড়িয়ে দিয়েছি। এরা এখন জানে, যতো যাই করুক, এদের কেউ আইনের আওতায় আনবে না। অথচ ব্যাপারটা কিন্ত সাইবার বুলিংয়ের আওতায় পড়ে। কয়েকটা মামলা হলে, বিচার হলে, কিছু দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলে, এরা সুড়সুড় করে লাইনে চলে আসতো।

যা খুশি তাই বলার নাম বাক-স্বাধীনতা না। ওটা ছাগ-স্বাধীনতা। আর ওই ছাগলপাল দিয়েই অনলাইন সয়লাব। এদের যন্ত্রণা থেকে জীবিত মানুষ তো দূর, মৃত মানুষেরাও নিরাপদ না। এতোটাই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে এরা। একজন মানুষ মারা গেলে সে জান্নাত নাকি জাহান্নামে যাবে এটাও তারাই ঠিক করে দিচ্ছে। অথচ মৃত মানুষের প্রসঙ্গে এমন নোংরা ব্যবহার করার কথা কোন শান্তির ধর্মে বলা আছে? আর এরা নিজেরা ধর্ম ঠিকঠাক মতো পালন করে তো? 

এরা যে অনলাইনে এমন হিংস্র আর উগ্রবাদী আচরণ করে, নিজের পরিবারের সাথেও এমনটাই করে? ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম যেখানেই যাবেন এই অকাল কুষ্মাণ্ডদের দেখা পাবেন। এরা হচ্ছে সেই প্রজাতি যারা প্রতিটা ইস্যুতে কমেন্ট সেকশনে ফতোয়া দিয়ে বেড়ায়। পুরো দেশটা বন্যায় ডুবে গেলেও সেই দোষ সাকিব আল হাসানের বউ কেন পর্দা করেনা তার ওপর গিয়ে পড়বে। সাকবের বউ থেকে ডোনাল্ড ট্রাম্প, কেউই বাদ যায় না এদের আগ্রাসন থেকে।  

সাম্প্রতিক সময়ে ঘটা দুইটি উদাহরণ দিয়ে শেষ করছি। এদেশের প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। সেই খবরের কমেন্ট সেকশনগুলো জঘন্য সব কমেন্টের বাহার। কেউ তার দেশের দিকে নোংরা ইঙ্গিত করেছে, কেউ গালি দিয়েছে, তো কেউ মৃত্যুকামনা করেছে। এবং এমনটা করা তাদের অধিকার- এ হিসেবেই করেছে।

রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবরে কিছু কমেন্ট 

ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়েকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা মেরে ফেলেছে- এরকম অভিযোগ করছে মেয়েটার পরিবার। তারা বলছে, মেয়েটাকে মেরে লাশ সিলিং থেকে ঝুলিয়ে দিয়ে সেটাকে আত্মহত্যা বলে চালানো হয়েছে। আর লাশ রেখে পালিয়ে গেছে শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এমন এক মর্মান্তিক খবরের কমেন্ট সেকশনটা আরও মর্মান্তিক।

কেউ মৃত মেয়েটাকে পড়াশুনার জন্য গালাগালি দিচ্ছে, কেউ বলছে সে জাহান্নামী হবে, কেউ বলছে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলাই উচিত কাজ হয়েছে, কেউ বলছে মেয়েদের পড়াশুনা ইসলাম বিরোধী, কেউ বলছে মেয়েটা পরকীয়া করেছে দেখে তাকে মেরেছে।

সেই মেয়ের মৃত্যু সংবাদে করা কিছু কমেন্ট 

একটা বার কল্পনা করুন তো, কোনোকিছু না জেনে এই আচরণ কেউ যদি আপনার মা-বোন কিংবা পরিবারের সাথে করতো- তখন কেমন লাগতো? জানি শুধু কথায় চিড়া ভিজবে না। যে ধর্মের আলোকে আপনারা এসব কমেন্ট করে বেড়ান, সেখান থেকেই কিছু কথা তুলে দিচ্ছি। হযরত আলী বলেছিলেন, নীচু লোকের প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে অশ্লীল বাক্য! 

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর হতে বর্নিত, তিনি বলেন, রাসুল্লাহ (সা) বলেছেন: “কবীরা গুনাহসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বড় হল নিজের পিতা-মাতাকে লানত করা। জিজ্ঞাস করা হলো: হে আল্লাহর রাসুল (সা)! আপন পিতা-মাতাকে কোনো লোক কিভাবে লানত করতে পারে? তিনি বললেন: সে অন্যের পিতাকে গালি দেয়, তখন সে তার পিতাকে গালি দেয় এবং সে অন্যের মাকে গালি দেয়, তখন সে তার মাকে গালি দেয়।” [সহিহ বুখারি: ৫৯৭৩, সহিহ মুসলিম: ৯০]

হযরত আবু যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছেন, কোন ব্যক্তি অপর কোন ব্যক্তিকে যেন ফাসেক অথবা কাফের এর অপবাদ না দেয়। কেননা সে যদি প্রকৃতই তা না হয়ে থাকে তবে এই অপবাদ তার নিজের ঘাড়ে চেপে আসবে। (বুখারী)

মহানবী (সাঃ) বলেন, মুমিন কখনো দোষারোপকারী, অভিশাপকারী, অশ্লীল ও গালিগালাজকারী হয় না। (জামে তিরমিযী ২০৪৩)

আরও পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা