রাতের সাড়ে তিনটায় ফোন পেয়ে থানার গাড়ি নিয়ে ছুটে গিয়েছে পুলিশ, প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা রোগীকে নিয়ে গেছে হাসপাতালে, তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করে তবেই তারা ফিরেছেন কর্মস্থলে...

পুলিশের মন্দ কাজ নিয়ে যতটা সমালোচনা হয়, তাদের ভালো কাজগুলো সেভাবে আলোচনায় আসে না। ইউনিফর্ম জবের এটা একটা অসুবিধা। একজন পুলিশ সদস্য ঘুষ নিলে পুরো পুলিশ ফোর্স খারাপ, একজন ডাক্তার ফীস বেশি রাখলে পুরো ডাক্তারের জাত কসাই- অথচ অন্য পেশার কাউকে কিন্ত আমরা এভাবে জেনারেলাইজ করি না। ব্যাপারটা তাই মাঝেমধ্যেই ‘যতো দোষ পুলিশ ঘোষ’ টাইপের হয়ে যায়।

অথচ আমরা ভুলে যাই যে, এই পুলিশ সদস্যরা কিন্ত কেউই ভিনগ্রহ থেকে আসেননি, অন্য দেশ থেকে আমদানী করে আনা হয়নি এদের। এরা আমাদেরই ভাই-বন্ধু-স্বজন, আমাদেরই পরিবারের সদস্য। প্রতিটা পেশায়, প্রতিটা ক্ষেত্রে ভালো-খারাপ উভয় ধরণের মানুষ আছে। এটা ঠিক যে পুলিশের পাওয়ার প্র্যাকটিসের সুযোগ বেশি বলে অনেকেই সেটার অপব্যবহার করেন। কিন্ত তাই বলে সবাইকে এক কাতারে ফেলে দেয়াটা ভীষণ অনুচিত। চট্টগ্রামের কোতওয়ালি থানা এলাকায় গতকাল ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা থেকে সেটার প্রমাণ আরও একবার পাওয়া গেল।

তখন রাত প্রায় সাড়ে ৩টা। হঠাৎ কোতোয়ালি থানায় ফোন এল আশরাফ আলী রোড থেকে। অন্য প্রান্ত থেকে বলা হলো, প্রসব বেদনা উঠেছে এক মহিলার। সাথে অন্যান্য সমস্যাও। চিকিৎসা দিতে হবে জরুরী ভিত্তিতে, দেরী হলে রোগীর প্রাণ সংশয় হতে পারে। কিন্তু আশেপাশে ডাক্তার নেই। হাসপাতালে নিতে হবে, কিন্তু রাস্তায় গাড়ি নেই। শেষে উপায় না পেয়ে রোগীর স্বজনরা ফোন করেছে টিম কোতোয়ালীকে।

কোতোয়ালী থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তারা চাইলেই এড়িয়ে যেতে পারতেন, রাতের সাড়ে তিনটায় 'উটকো ঝামেলা' কাঁধে নেয়ার কোন মানেই হয় না। কিন্ত সেখানে অন্য ধাতুতে গড়া কিছু মানুষ বসে ছিলেন তখন। মায়া, মমতা আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে যাদের হৃদয় পরিপূর্ণ। গায়ে পুলিশের পোষাক, তবু কঠোরতার ধার না ধরে তারা মানুষকে সাহায্যের জন্যে উন্মুখ হয়ে থাকেন। প্রথমে নিজেরাই চেষ্টা করলেন অ্যাম্বুলেন্স ম্যানেজ করার, কিন্ত বিফলে গেল সেটা।

কোন অ্যাম্বুলেন্স না পেয়ে শেষমেশ থানার টহল গাড়ি নিয়েই বেরিয়ে পড়লেন এএসআই আজিজুল ইসলাম ও সুকুমার দাশ। ঠিকানা অনুযায়ী ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখলেন, রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ, অজ্ঞান অবস্থা প্রায়। খানিকটা ভড়কে গেলেন তারা, অঘটন ঘটলে সবাই আবার পুলিশের দোষ ধরবে- এই ভেবে! কিন্ত দায়িত্ব থেকে পিছু হঠলেন না, মানুষের সাহায্যের শপথ নিয়েছেন চাকুরিতে ঢোকার সময়, সেই শপথ ভাঙেন কি করে? শঙ্কা, ঝুঁকি আর বিপদ মাথায় রেখেই রোগীকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটলেন দুজনে।

সুকুমার দাশের কোলে সদ্যপ্রসূত শিশুটি

পুলিশকে দেখে ডাক্তার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ হয়তো রোগীর প্রতি একটু বেশি আন্তরিকতা দেখাতে পারে- সেই চিন্তা থেকে হাসপাতালে দৌড়ঝাঁপ করলেন নিজেরাই। ডাক্তার ডেকে, নার্স ডেকে নিশ্চিত করলেন তাৎক্ষণিক চিকিৎসার। রোগীকে ঢোকানো হলো অপারেশন থিয়েটারে, কিছুক্ষণ পরে তাদের সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রূপ নিল হাসিতে, কারণ ফুটফুটে বাচ্চার কান্নার শব্দে তখন ভরে উঠেছে জায়গাটা। প্রায় তিন ঘণ্টার অমানুষিক কষ্ট সার্থক হল। মা-মেয়ে দুইজনই সুস্থ আছে। মুখে উজ্জ্বল একটা হাসি ফুটিয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ভোরবেলায় থানায় ফিরলেন দুই অফিসার।

লকডাউনে মানুষকে ঘরে রাখার জন্যে পুলিশ ডান্ডার বাড়ি মেরেছে মানুষজনের গায়ে- সেটা নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হচ্ছে, হওয়া উচিতও। উপযাজক হয়ে পুলিশ অনেক জায়গায় বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে, ব্যাংক কর্মকর্তা বা হাসপাতালে যাওয়া ডাক্তারের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করেছে- সেসব ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ, শাস্তি নিশ্চিত করা উচিৎ। কিন্ত কয়েকজনের জন্যে পুরো বাহিনীকে দোষারোপ করাটা ভীষণ দৃষ্টিকটু। ভুলে যাবেন না, প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা মা আর তার সদ্য জন্ম নেয়া মেয়েটাকে যারা নতুন জীবন দিয়েছে, সেই আজিজুল এবং সুকুমারও কিন্ত পুলিশ বাহিনীরই সদস্য। এক কাতারে সবাইকে ফেলে পুরো পুলিশ ফোর্সকে গালাগাল করতে বসলে গালিগুলো যে এই দেবদূতদের গায়েও পড়ে, সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

এএসআই আজিজুল, সুকুমার এবং চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের টিম কোতোয়ালীর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা…


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা