ভারতের অন্তত ২৩ সেনা নিহত হয়েছে, ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে চীনেরও। কিন্ত কেন প্রায় ছয় দশক পর এই রক্তাক্ত সংঘর্ষে লিপ্ত হলো দুই দেশের সেনারা?

লাদাখের বিরোধপূর্ণ গালোয়ান উপত্যকায় চীনা সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষে তেইশ জনেরও বেশি ভারতীয় সেনা নিহত হয়েছে- গতকাল রাতে এটাই ছিল উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় এবং চাঞ্চল্যকর খবর। ভারতের দাবী অনুযায়ী, চীনের ৪৩ জন সেনাও নিহত হয়েছে এই সংঘর্ষে, যদিও চীন কিংবা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, কেউই সংখ্যাটা পরিস্কার করে জানায়নি। তবে ক্ষয়ক্ষতির কথা স্বীকার করেছে চীন সরকার। ১৯৬২ সালে ইন্দো-চীন যুদ্ধের পরে এটাই সম্ভবত ভারত-চীন সীমান্তে সবচেয়ে বড় সংঘর্ষের ঘটনা। গত কিছুদিন ধরেই যেভাবে উত্তেজনা বাড়ছিল এখানে, তাতে বড়সড় কিছু ঘটার আশংকা ছিল। সেই 'বড়' কিছু ঘটেও গেল, এখন রক্তের স্রোত এখানেই থামবে কিনা, এটা একটা বড় প্রশ্ন। 

ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অভিযোগ করছে, গালওয়ান উপত্যকায় প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওএসি) মেনে চলার জন্য গত সপ্তাহে দু‌'পক্ষের মধ্যে যে 
মৌখিক চুক্তিটা হয়েছিল চীন তা ভঙ্গ করেছে। অন্যদিকে, ভারতের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে চীন বলেছে, ভারতীয় সেনারা সোমবার দু'দফায় 'সীমান্ত লংঘন করে, উস্কানি দেয় এবং চীনের সৈন্যদের আক্রমণ' করে, যার কারনে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, এই সংঘর্ষে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হয়নি। একদম খালি হাতে, লোহার রড ও পাথর দিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে। এটার পেছনে একটা কারন আছে।

ভারত আর চীনের মধ্যে একটা সমঝোতা আছে যে, যতই মতভেদ হোক, সীমান্তে উত্তেজনা কোনও দেশই বাড়তে দেবে না। অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন চীনে এসেছিলেন, সেই সময়েই রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটা তৈরি হয়েছিল। পরে মনমোহন সিংয়ের আমলেও সেই একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির দ্বিতীয় শাসনামলে চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হলেও, দুই দেশের সেনাবাহিনী আগেকার সেই চুক্তি অমান্য করেনি। কাজেই লাদাখ সীমান্তে বাড়তি অস্ত্রের মজুদ করেনি কেউই। 

লাদাখের এই সংঘর্ষের জন্য ভারতকেই দায়ী করছে চীন

ফ্রন্ট লাইনে যেসব সেনা সদস্য মোতায়েন থাকেন, তাদের কাছে কোনও রকম অস্ত্র থাকে না। যদি সেনা র‍্যাঙ্ক অনুযায়ী কোনও অফিসারের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রাখা নিয়ম হয়, তাহলে তার নল মাটির দিকে ঘুরিয়ে রাখা থাকবে। সেজন্যই দুই দেশের সেনাসদস্যদের হাতাহাতি বা কুস্তি করার ভিডিও দেখা যায়, কোথাও গুলি বিনিময়ের ছবি দেখা যায় না। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এরকম কোনও চুক্তি নেই, একারণে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে নিয়মিতই গোলাগুলি হয়, কিন্ত চীন-ভারত সীমান্তে হয় ধাক্কাধাক্কি। তবে এবার যখন সেই ধাক্কা আর রড-পাথর দিয়েই এতগুলো প্রাণ ঝরে গেল, তখন ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় কারো। 

প্রশ্ন উঠবে, কেন এর বছর শান্ত থাকার পর হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে উঠলো লাদাখ সীমান্ত? কেন ঝরে গেল এতগুলো প্রাণ? আঞ্চলিক রাজনীতির ময়দান কেন অশান্ত হয়ে উঠছে আবার, গোটা বিশ্ব যখন করোনার সঙ্গে লড়ছে, তখন কেন বেজে উঠছে যুদ্ধের দামামা? 

এই সংঘাতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে লাদাখে ভারতের তৈরি করা একটি রাস্তা, যেটি দুই দেশের মধ্যকার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলওএসি) বরাবর অবস্থিত। ভারতের এই পদক্ষেপে চীন ক্ষুদ্ধ্ব হয়েছে। তারা আপত্তি জানিয়েছিল, ভারত শোনেনি। প্রতিক্রিয়া হিসেবে চীন লাদাখের বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে সেনা মোতায়েন করেছে, এবং তারাও অবকাঠামো তৈরির কাজে হাত দিয়েছে। চীনের সেনারা ভারত অধিকৃত অঞ্চলে ঢুকে পড়ে ভারতীয় সেনাদের পেট্রোল টিমকে তাড়িয়ে দিয়েছে সেখান থেকে। 

লাদাখে ভারতীয় সেনাদের পেট্রোল টিম

মে মাসের গোড়াতেই পূর্ব লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা, নাকু লা এবং প্যাংগং হ্রদের উত্তর প্রান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে ভারতীয় এলাকায় কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত ঢুকে পড়ে চীনের সেনারা। তারা রীতিমতো তাঁবু খাটিয়ে ঘাঁটি গেড়ে বসে সেখানে। প্যাংগং হ্রদের (থ্রি ইডিয়টস সিনেমার শেষ দৃশ্যের শুটিং যেখানে হয়েছিল) কাছে ভারতীয় ও চীনা সেনারা লিপ্ত হয় ধস্তাধস্তিতে। তারপর থেকেই বেশ কয়েকটি এলাকায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল দু’দেশের সেনা। হাবেভাবে বোঝা যাচ্ছিল, গণ্ডগোল একটা বাঁধতে চলেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও ছিলেন অনড় অবস্থানে। 

আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীন-ভারতের এই সংঘাতটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার নেতা হবার যে স্বপ্ন ভারত দেখছিল, চীন তাতে পানি ঢেলে দিচ্ছে। চীন-ভারতের এই সংঘর্ষের সময়ই পাকিস্তানী সেনারা ভারত সীমান্তে গুলি করছে, এমনকি নেপালের মতো পুঁচকে দেশের পুলিশও গুলি করে সীমান্তে ভারতীয় চোরাকারবারীকে মেরে ফেলছে! নেপালের পেছনে দাঁড়িয়ে যে চীনই সাহস যোগাচ্ছে, সেটা বোঝার জন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক না হলেও চলে। তাই ভারতকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে চীন- এটা বললে ভুল হবে না মোটেও। 

১৯৬২ সালের যুদ্ধে চীনের কাছে শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল ভারতের, কুটনৈতিকভাবে দ্রুত চীনের সঙ্গে সমঝোতা না করলে সীমান্তে আরও বড় মাশুল দিতে হতে পারে ভারতকে, সেটা চীনের ছাড় না দেয়ার একগুঁয়ে অবস্থান থেকেই বোঝা যাচ্ছে। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা