অনলাইন মার্কেটপ্লেস আর শক্তিশালী ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি বিশাল জনসংখ্যার একটা দেশকে কীভাবে বদলে দিতে পারে, চীন সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে আছে সবার সামনে।

বছর তিনেক আগের কথা। নতুন বছরের প্রাক্কালে চার বছর বয়সী নাতি উনকে কিছু উপহার দিতে চাইছিলেন তার নানী ওয়াং। নাতিকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, উপহার হিসেবে তার চাহিদা কী? উন জানালো, তার একটা স্পাইডারম্যানের মুখোশ দরকার। স্পাইডারম্যান কী জিনিস, সেটাই ওয়াং জানতেন না, কোথায় গেলে এই মুখোশ পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কেও কোন ধারণা ছিল না তার। চার বছরের উন তাকে জানালো, মায়ের মোবাইল ফোন থেকে স্পাইডারম্যান, সুপারম্যান সবকিছুই কেনা সম্ভব। তিন বছর আগের এক সন্ধ্যেবেলায় প্রৌঢ়ত্বের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ওয়াং হঠাৎই আবিস্কার করেছিলেন, তাদের সময়কার শপিং আর এখনকার শপিংয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ তৈরি হয়েছে!

ই-কমার্স, খুব ছোট্ট একটা শব্দ, কিন্ত তাৎপর্য অনেক বড়, অনেক বেশি গভীর। বিশ্বের অর্থনীতিতে চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে সবচেয়ে বড় হুমকির নাম, আর চীনের এই অর্থনৈতিক উত্থানের পাল তোলা নৌকায় সবচেয়ে বড় হাওয়ার যোগান দিয়েছে চীনের ই-কমার্স বিজনেস। এক আলিবাবা গ্রুপই নিয়ন্ত্রণ করছে চীনের ই-কমার্স দুনিয়ার অর্ধেকেরও বেশি অংশ। আঠারোজন পাগলাটে তরুণ নিজেদের সর্বস্ব বাজী ধরে যে ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন অনেকগুলো বছর আগে, সেটাই আলিবাবাকে মহীরূহে পরিণত করেছে, পৃথিবীর বুকে চীনের অর্থনীতিকে দিয়েছে শক্ত একটা ভিত্তি। ক্রয়-বিক্রয়ের ধারণাটাই বদলে দিয়েছে ই-কমার্স বিজনেস, দেড়শো কোটি মানুষের দেশ চীনে এখন সবচেয়ে বড় মার্কেটপ্লেসের নাম অনলাইন, কোটি কোটি ক্রেতা-বিক্রেতার সমারোহে সারা বছরই সরগরম হয়ে থাকে এই অদৃশ্য শপিং মল!

আলিবাবার উত্থান, ই-কমার্সের যাত্রা

চীনে ই-কমার্স বিজনেসের কথা বলতে গেলে আলিবাবার নাম নিতেই হবে, কারণ শুরুটা জ্যাক মা এবং তার আলিবাবা গ্রুপের হাত ধরে। ১৯৯৬-৯৭ সালের কথা, চীনে তখন ইন্টারনেট প্রবেশ করেছে সবেমাত্র, তবে খুবই সামান্য পরিসরে। সেই ইন্টারনেটটাকে কীভাবে ওপেন মার্কেটপ্লেসে পরিণত করা যায়, সেই ধারণা থেকেই আলিবাবার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। আলিবাবাতে তারা একটি বি-টু-বি প্ল্যাটফর্ম চালু করেছিলেন, যেখানে চীনের রপ্তানিকারকরা তাদের পণ্যের তালিকা দিতে পারবে। সেই তালিকা দেখে যেন বিদেশী ক্রেতারা এসব পণ্য ক্রয় করতে পারে।

চীনের অর্থনীতিতে তখন পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। সে সময়ে চীনে ক্ষুদ্র ও মাঝারী ব্যবসাগুলোর জন্যে ঋণ যোগাড় করা ছিল কঠিন কাজ, এবং তাদেরকে বড় বড় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হতো। আলিবাবার আগমন এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর দুঃসহ অবস্থা রাতারাতি বদলে দিলো। অল্প দিনের মধ্যেই আলিবাবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে লাগল, বিনিয়োগ আসা শুরু হলো বাইরে থেকে। একটা পর্যায়ে তো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ইয়াহু আলিবাবার শেয়ারও কিনে নিলো, সেটা ছিল প্রতিষ্ঠানটির জন্যে বড়সড় একটা টার্নিং পয়েন্ট। এরপরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

আলিবাবার পথ ধরে এরপরে অনেকেই এসেছে, জেডি ডটকম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, অনেক পরে যাত্রা শুরু করেও চীনের তৃতীয় বৃহত্তম ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে পিনদুয়োদুয়ো। মোবাইল ইন্টারনেটের প্রসার যতো ঘটেছে, তত বেশি মানুষ আগ্রহী হয়েছে অনলাইনে কেনাকাটার প্রতি। নতুন নতুন ক্রেতার সঙ্গে তৈরী হয়েছে বিক্রেতাও। একটা সময়ে চীনের অনলাইন মার্কেট ছিল ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য নির্ভর, সেখানে এখন হাতে তৈরি পণ্য থেকে শুরু করে সুভ্যেনির গিফট, খাবার, এমনকি কায়িক শ্রম বা সেবাও পাওয়া যাচ্ছে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে।

চীনে ই-কমার্স বিজনেসের কথা বলতে গেলে আলিবাবার নাম নিতেই হবে

চীনের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি আসলে কত বড়?

পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, ই-কমার্স বিজনেসে চীন পুরো বিশ্বের চেয়ে কতটা এগিয়ে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চীনের অনলাইন ক্রেতার সংখ্যা ৬১ কোটি ছুঁয়েছিল, যা ২০১৭ এর তুলনায় ১৪.৪% বেশি। আবার ২০১৯ এর ডিসেম্বরে এসে এই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ৭৭ কোটিতে, প্রবৃদ্ধির হারটা ২৭% এর চেয়েও বেশি! চীনের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে শতকরা ৭৩ জনই অনলাইনে কেনাকাটা করে থাকেন। এদের মধ্যে প্রায় ৬৫ কোটি লোক শুধু স্মার্টফোনের মাধ্যমে কেনাকাটা করে, যা দেশটির মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর শতকরা ৭৫ ভাগ! অর্থাৎ, স্মার্টফোন আছে, এমন নাগরিকদের মধ্যে প্রতি চারজনের তিনজনই অনলাইন মার্কেটপ্লেসের ক্রেতা।

সাফল্যের নেপথ্যে

প্রশ্ন জাগতেই পারে, ই-কমার্স বিজনেস তো পুরো পৃথিবীতেই আছে, তাহলে চীনে কী করে সেটা মহীরূহে রূপ নিলো? পুরো পৃথিবীজুড়েই মানুষের ব্যস্ততা বেড়েছে, অফলাইন শপিং অনেক দেশ থেকেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে। চীনেও সেই বাস্তবতা আছে, সেটার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানামুখী পন্যের চাহিদা এবং যোগান। ই-কমার্স বিজনেসের থিমটা খুব সিম্পল, কিন্ত প্রয়োগটাই আসল। ভোক্তার চাহিদা আপনি কত দ্রুত পূরণ করতে পারছেন, পন্যের গুনগত মান কতটুকু বজায় থাকছে, ক্রেতা এবং বিক্রেতা দুজনের অধিকার সর্বোচ্চ রক্ষা হচ্ছে কীনা- এই কয়েকটি প্যারামিটারই ব্যবসার গণ্ডিটা নির্ধারণ করে দিচ্ছে।

ক্রেতা বা বিক্রেতার আস্থা অর্জন করতে সময় লেগেছে ঠিকই, কিন্ত স্বচ্ছ্বতা ও জবাবদিহিতার বেলায় আপোষ করেনি প্রতিষ্ঠানগুলো। শুরুর দিন থেকেই প্রতিটা অভিযোগ নিঁখুতভাবে বিশ্লেষণ করেছে তারা, সেগুলোর সমাধান করেছে; আস্থা অর্জনের বড় কারণ ছিল এটাই। সরকারী সহায়তার আশায় বসে না থেকে বাজার ধরতে উদ্যোগী হয়েছে সবাই, প্রতিযোগীর সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে একে অন্যকে ছাপিয়ে যাওয়ার একটা সুস্থ প্রতিযোগীতা। আর তাতেই ফুলে ফেঁপে উঠেছে চীনের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি। চীনের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রতি মাসে যে পরিমাণ অর্ডার চীনের বাইরে থেকে আসে, সেটাও অবাক করে দেয়ার মতোই।

আলিবাবা, জেডি ডটকম, পিনদুয়োদুয়ো নেতৃত্ব দিচ্ছে চীনের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিকে

মেগাসিটির বাইরে ব্যবসাকে ছড়িয়ে দেয়া

ক্রেতার মানসিকতা ধরতে পারাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ; আলিবাবা, জেডি ডটকম বা পিনদুয়োদুয়ো'র মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সেটা ধরতে পেরেছে বলেই টিকে আছে, তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত হচ্ছে ক্রমশ। শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে এখন তারা নিজেদের বিস্তৃত করছে চীনের প্রত্যন্ত অঞ্চল জুড়েও। গ্রামাঞ্চলের মানুষ কখনও যে পণ্যটা নিজেদের আশেপাশে দেখেনি, সেটা অনলাইনে অর্ডার দিয়ে একদিনের মধ্যেই হাতে পেয়ে যাচ্ছে। চীনের অর্থনৈতিক ফোরাম তো ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ২০৩০ সালের মধ্যে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর আয়ের দুই-তৃতীয়াংশের যোগান আসবে গ্রামাঞ্চল এবং শহরের বাইরের ক্রেতাদের কাছ থেকে।

ছোট শহরের ক্রেতারা এখন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসার প্রবৃদ্ধিতে বড়সড় অবদান রাখছে। গত বছরের আলিবাবার অনলাইন মার্কেটপ্লেসে যারা কেনাকাটা করেছে তাদের সিংহভাগ ছোট শহরের অধিবাসী। কাপড়, ঘর সাজানোর আসবাবপত্র, প্রসাধনী পণ্য সামগ্রী, প্রচুর বিক্রি হয়েছে। মেগাসিটির বাইরে বসবাসের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এখানে বড় শহরের মতো জীবনযাত্রা ব্যয়বহুল নয়। তাই এসব লোকদের টাকা খরচ করার কোন খাত নেই। ই-কমার্সের কারণে এরা বিভিন্ন বিলাস পণ্যদ্রব্য ক্রয় করতে পারে। আর এই ক্রেতাদের আকর্ষণের জন্যে প্রতিষ্ঠানগুলোর ডিসকাউন্ট এবং নানা ধরণের অফার তো সারা বছরই চালু থাকে।

প্রচারণা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ

ক্রেতাদের কাছাকাছি পৌঁছানোর জন্যে ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং সিস্টেমকে কাজে লাগিয়েছে চীনের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো ওয়েইবো, উইচ্যাট, ডুবান, ডুয়িন- এর মতো চীনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় তারকাদের ব্যবহার করে নিজেদের ব্র‍্যান্ড এবং পন্যের প্রচারণা চালিয়েছে, তাতে দাবানলের মতো অনলাইন মার্কেটপ্লেসের জনপ্রিয়তা ছড়িয়েছে চীনের আনাচে কানাচে। অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সার টার্মটির সঙ্গে যারা পরিচিত নন, তাদের জন্যে সংক্ষেপে জানিয়ে রাখি- ইনফ্লুয়েন্সার হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি অনেক জনপ্রিয়। যার কথা অনেকে শোনে এবং সে যা করে বা বলে তা অনেকে খুব গভীরভাবে অনুসরণ করে। ইনফ্লুয়েন্সাররা সাধারণত সোশ্যাল মিডিয়া যেমন- ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, ফেসবুকে সক্রিয় থাকে এবং তাদের বড় অংকের ফলোয়ার থাকে।

অনলাইন মার্কেটপ্লেসের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ভূমিকা আছে অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সারদের

চীনের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিটা বিলিয়ন ছাড়িয়ে ট্রিলিয়নের পথে পা বাড়িয়েছে অনেক আগেই। ২০১৯ সালে চীনের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল্যমান দাঁড়িয়েছে ১.৯ ট্রিলিয়ন ডলারে, যেখানে ইংল্যান্ড-আমেরিকা এবং জার্মানীর সবগুলো ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মিলিত অংকটাও এরচেয়ে কম। ঘরে বসে সুঁই-সুতো দিয়ে সেলাই করা মহিলাটিকেও বিক্রেতা বানিয়ে ফেলেছে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো, আমাজন এবং ওয়ালমার্টের মতো প্রতিষ্ঠান চীন থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রাসী ব্যবসায়ীক নীতিমালা এবং মনোভাবের কারণে।

একদমই নীরবে চীনে ই-কমার্সের একটা বিপ্লব ঘটে গেছে, সেই বিপ্লবটা বদলে দিয়েছে চীনের অর্থনীতির গতিপথকে। সেই বিপ্লবের ফল চীন পেয়েছে হাতেনাতে, দেশটি পরিণত হয়েছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তিতে। অনলাইন মার্কেটপ্লেস আর শক্তিশালী ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি বিশাল জনসংখ্যার একটা দেশকে কীভাবে বদলে দিতে পারে, চীন সেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হয়ে আছে সবার সামনে...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা