এভাবে চললে দেখবেন একদিন আমাদের অনেক টাকা হবে কিন্তু প্রকৃতি বলে আর কিছু থাকবে না। আমাদের নদী থাকবে না, সাগর থাকবে না, পাহাড় থাকবে না, প্রাণ থাকবে না...

পর্যটন মানেই বড় বড় হোটেল, এমনকি পাহাড়ের ভেতরেও ফাইভ স্টার হোটেল, সাথে একটা সুইমিং পুল, সেলফি, হৈ হুল্লোড়; কারা এসব আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে আমার জানা নেই।

পর্যটন মানে যে চারদিকে সবুজ অরণ্য, পাহাড়ের ঢেউ, মাঝে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, নিরব প্রকৃতি সেগুলো বোধহয় আমরা ভুলে গিয়েছি। অথচ সারাপৃথিবীতেই প্রকৃতিকে ঠিক রেখে পর্যটনের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, বাড়ছে প্রয়োজনও। হোম স্টে ধারণা সারাপৃথিবীতে প্রচলিত হয়ে উঠছে যেখানে মানুষকে বোঝা যায়, প্রকৃতিকে বোঝা যায়।

নিশ্চয়ই আপনাদের অনেকের হোমস্টের অভিজ্ঞতা হয়েছে। যাদের নেই তাদের বলি দারুণ অভিজ্ঞতা। বছর দুয়েক আগে দার্জিলিংয়ের কালিম্পংয়ে আমার হোমস্টের অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখানকার রিশপ গ্রাম, লাভা, লোলেগাঁও, কার্সিয়াং এসব গ্রামে হোমস্টেতে আসা মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। পাহাড়ের মাঝখানের কোন এক গ্রামের মানুষের সঙ্গে থাকবেন, তারাই রা্ন্না করে খাওয়াবে, গল্প করবেন দারুণ অভিজ্ঞতা।

এই যে আপনারা এখন থানচি-রেমাক্রি এসব এলাকায় যান, একযুগ আগে এসব এলাকায় আমরা সদলবলে ঘুরেছি, পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে থেকেছি, খেয়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, পাহাড়কে নষ্ট না করে, সেখানকার প্রাণ-প্রকৃতিকে ধ্বংস না করে সবকিছু ঠিক রেখেও পর্যটন হতে পারে।

সারাদেশ থেকে লোকজন পার্বত্য চট্টগ্রামে যাবে এটাকে আমি খুব স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নিচ্ছি। কিন্তু তাই বলে সেখানকার প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করতে হবে? সবকিছু ঠিক রেখেও কিন্তু ভ্রমণ করা যায়।

আমি জানি না বান্দরবানে চিম্বুক পাহাড়ে বসবাসরত ম্রো জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকাকে ধ্বংস করে সেখানে শিকদার গ্রুপের পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের দরকারটা কী?এ নিয়ে বিক্ষোভ হচ্ছে। পাহাড়ের জনগোষ্ঠী বলছে, পাঁচ তারকা এই হোটেল নির্মাণ হলে প্রায় ১০ হাজার জুমচাষি উদ্বাস্তু হওয়ার ঝুঁকিতে পড়বেন। ৭০-১১৬টি পাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আচ্ছা এই পর্যটন কী খুব জরুরী?

আমার মাঝে মধ্যে ভীষণ মন খারাপ লাগে। পৃথিবীর বহু দেশ নদী পায় না, পাহাড় পায় না, সাগর পায় না। ওপরওয়ালা অমাদের এতো সব নদী দিয়েছে। আমরা ধ্বংস করছি। দখল করছি। ঢাকা শহরের চারপাশে নদী। ভেতরে নদী। এই নদীগুলো ঠিক থাকলে রোজ বিকেলে নদীপথে ভ্রমণ হতে পারতো। ব্যাংককের মতো নদীকেন্দ্রিক পর্যটন হতে পারতো। আর এখন নদীর ধারেকাছে যাওয়া যায় না।

আমাদের দারুণ সুন্দর কিছু পাহাড় আছে। তিন পার্বত্য জেলা আছে। আমাদের নজর পড়েছে সেখানে। এই পাহাড়ের ভেতরে ভেতরে ফাইভ স্টার হোটেল করতে হবে। কেন রে বাবা? পাহাড়কে নষ্ট না করে, জীবন-জীবিকাকে নষ্ট না করে পর্যটন গড়া যায় না?

ছবি- চিম্বুক পাহাড়

আমাদের দেখেন এতো সুন্দর একটা কক্সবাজার আছে। সেখানে ব‌্যাঙের ছাতার মতো বিল্ডিং করা ছাড়া আমরা কী করছি? পারলে সাগরের ভেতরেও আমরা ভবন তুলি। কেন? সাগরপাড় ধরে ছোট ছোট কটেজ কী হতে পারতো না? আমাদের প্রত্যেকটা পর্যটন স্পট দেখেন আপনারা। শান্তি, নিরবতা আপনি পাবেন না।

আরে ভাই হৈ হুল্লোড় তো বাসায় বসেও উচ্চস্বরে মিউজিক ছেড়ে করা যায়, তাই না। ভ্রমণ মানে যে সুন্দর প্রকৃতি, মনের ভেতরে মননে গেঁথে যাওয়া সেগুলো কী আমাদের মাথায় অসে না? এভাবে চললে দেখবেন একদিন আমাদের অনেক টাকা হবে কিন্তু প্রকৃতি বলে আর কিছু থাকবে না। আমাদের নদী থাকবে না, সাগর থাকবে না, পাহাড় থাকবে না, প্রাণ থাকবে না।

পর্যটন নিয়ে যারা কাজ করেন যারা আমাদের নীতি নির্ধারক তাদের বলবো, একটু ভাবুন। একইসঙ্গে এই দেশের সাধারণ মানুষ, আপনারা যারা ঘুরে বেড়ান তাদের প্রতিও একই আহবান। বিশ্বাস করেন প্লাস্টিক বোতল তো পরের কথা, একটা টিস্যুও বাইরে ফেলতে আমার বুক কাপে, মনে হয় ঘাসেদের কষ্ট হবে। অথচ দেখেন চারপাশে কী অবস্থা!

আপনি একদিন নিকেতনে ঘুরে যান। সব শিক্ষিত লোক এখানে বসবাস করে। প্রতিটা ভবনের সামনের দিকে চকচকে। আর পেছনে রাজ্যের সব ময়লা। পলিথিন, প্লাস্টিক থেকে শুরু করে এমন আবর্জনা নেই যেটা তারা বাসা থেকে ফেলেন না।

সবার কাছে অনুরোধ, চলুন আমরা একটু শান্তি খুঁজি। প্রকৃতি খুঁজি। টাকা হইছে, গাড়ি নিয়ে কোথাও চলে গেলাম, হৈ হুল্লোড় পাগলামি করে ফিরলাম, নদী খাল সব দখল করলাম, পাহাড়ের ভেতর ফাইভ স্টার হোটেল বানালাম, সমুদ্র সৈকতজুড়ে বিল্ডিং আর বিল্ডিং যে এখন আর সাগরই দেখা যায় না এগুলো চলুন বন্ধ করি।

একবার ভাবুন ছুটির দিনে কোথাও বেড়াতে গেছেন আপনার পরিবার নিয়ে, সন্তান নিয়ে। ভোরবেলায় পাখির ডাক। চা খেতে খেতে মিষ্টি রোদেরা এসে পড়ছে আপনার গায়ে। দূরে পাহাড় বা সাগর। নিরিবিলি। হঠাৎ লাল ফড়িং এসে বসলো কোন গাছে। আপনার শিশু সন্তান আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। পাণ-প্রকৃতি ঠিক রেখে এভাবেও ভ্রমণ হতে পারে। ভালো থাকবেন সবাই। শুভ সকাল সবাইকে। শুভ সকাল বাংলাদেশ।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা