চে গুয়েভারা: বিপ্লবীর মৃত্যু হতে পারে, কিন্ত বিপ্লব কখনও মরে না!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
তাঁর হওয়ার কথা ছিলো ডাক্তার। সেখান থেকে হলেন বিপ্লবী। বিপ্লবের বার্তা ছড়িয়ে দিলেন লাতিন আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। বুলেটের সামনে, বন্দুকের মুখে কাটালেন তীব্র ঝাঁঝালো এক জীবন!
চে গুয়েভারার সাথে আমার প্রথম পরিচয় টিশার্ট দিয়ে। তখন চে'র ছবিখচিত টিশার্টের ব্যাপক কাটতি এলাকায়। এক মুখ দাঁড়িগোফ, মাথায় লাল তারার কালো টুপি আর উদাস চেহারা নিয়ে সব টিশার্টে একটাই মুখ, চে। এরপর যখন আরেকটু বড় হলাম, জানলাম এ মানুষটির বিপ্লবের গল্প। যে বিপ্লবের গল্প এতটাই প্রখর, আর্জেন্টিনায় জন্ম নেয়া এই বিপ্লবীর সে গল্পগুলো এখনো প্রেরণা দেয় অজস্র বিবেকবান মানুষকে। এরপর হাতে এলো- চে গুয়েভারার ডায়েরী। তিনি নিয়মিতই লিখতেন ডায়েরি। খুব যে বর্ণনামূলকভাবে সব লিখতেন, এমনটা মোটেও বলা যাবে না। তবে গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনাগুলো ঠিকই পাওয়া যেতো সেখানে। তাঁর বই অবলম্বনে বানানো সিনেমা 'দ্য মোটরসাইকেল ডায়েরিজ'ও দেখলাম। সিনেমার রঙিন পর্দা দেখালো বিপ্লবের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক ডাক্তারের হাসিমুখ। আবার এই সিনেমা দেখালো ডাক্তারের আড়ালে লুকিয়ে থাকা এই বিপ্লবীর ইস্পাত-দৃঢ় মুখকেও। আমরা দোটানায় পড়লাম। কোনটা ঠিক? কোনটাই বা ভুল?
চে আসলে কে? চে আসলে কী? এই প্রশ্নগুলো অতলস্পর্শী গভীরতার। হয়তো সময়ের ফেরে এখন মানুষটি হয়ে গিয়েছেন ব্যবসার এক উপকরণ। হয়তো এখন বিপ্লবই হয়ে গিয়েছে পণ্য। তবে যে সময়ে তিনি ছিলেন, সে সময়টায় বিপ্লবের মানে ছিলো পুরোপুরি ভিন্ন। যে বিপ্লবের খেসারত দিয়েছেন তিনি জীবন দিয়ে। ইতিহাস বলে, ১৯৬৭ সালের এই দিনে নিজের গেরিলা বাহিনী সহ ধরা পড়েন তিনি। এবং তার পরদিনই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় তার। কিন্তু ইতিহাস যা বলেনা, তা হচ্ছে, চে মরেনি কোনোদিনই। না হলে ঠিক এত বছর পরে এসেও তাকে নিয়ে কথা বলার হয়তো কোনো কারণই ছিলো না কারো। তার স্টাইল অনুসরণ করে বিপ্লবকে ধারণ করার কোনো প্রয়োজনীয়তাই হয়তো অনুভব করতো না কেউ। চে তাই না থেকেও আছেন সবখানে।
জন্ম অবস্থাপন্ন পরিবারে হলেও ছোটবেলা থেকেই মন পড়ে থাকতো বাইরে বাইরে। এদিকে খুব অল্পবয়স থেকেই হাঁপানি ছিলো তাঁর নিত্যসঙ্গী। এই রোগের কারণে প্রথম দিকে স্কুলেও যেতে পারেন নি। বাড়িতে বসেই পড়াশোনা করতেন। বাড়িতে ছিলো তিন হাজারেরও বেশি বইয়ের এক কালেকশন। সেগুলো পড়তেন। কবিতা নিয়েও ছিলো আগ্রহ। লিখতেনও কবিতা। ছিলো বিজ্ঞান নিয়েও আগ্রহ। খেলাধুলাও করতেন সমান তালে। সাঁতার, ফুটবল, গলফ, শুটিং সবকিছুতেই পরিচির মুখ ছিলো চে। সাইক্লিংও করতেন। খেলেছেন বুয়েনস এয়ারস বিশ্ববিদ্যালয় রাগবি দলের হয়ে হয়েও। রাগবি খেলায় দ্রুতগতির জন্য তার নামই হয়ে যায় 'ফিউজার'।
ছোটবেলা থেকেই হাঁপানি রোগে ভুগেছিলেন বলেই কী না জানা নেই, চিকিৎসাবিজ্ঞানে খুব আগ্রহী হয়ে গেলেন। হয়ে গেলেন চিকিৎসকও। এই পেশা থেকে টাকাপয়সাও কামাতে পারতেন ভালোই। কিন্তু তা না করে নেমে গেলেন মানুষের সেবায়। ঝরঝরে মোটরসাইকেলে করে যখন বন্ধু গ্রানার্ডোকে নিয়ে বেড়িয়েছেন লাতিন আমেরিকার পথে প্রান্তরে, তখনও যখনই পারতেন, মানুষের চিকিৎসা করতেন, তাও একেবারে বিনা পয়সায়! বাইকে চেপে লাতিন আমেরিকার এই ভ্রমণই ছিলো তার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। 'ডাক্তার' পরিচয় ছাপিয়ে 'বিপ্লবী'তে রূপান্তরিত হবার সময়টাও তখন। দু চাকার বাহনে চেপে লাতিন আমেরিকার যেপ্রান্তেই তিনি গিয়েছেন দেখেছেন দারিদ্র্য আর অসহায়ত্ব, অর্থনৈতিক বৈষম্য। এ বৈষম্যের কারন হিসেবে তিনি খুঁজে পেয়েছেন একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ। চে বুঝতে পেরেছিলেন , এ বৈষম্য কাটানোর একমাত্র উপায় বিশ্ববিপ্লব। সেই শুরু। দাড়িগোঁফহীন ঝকঝকে মুখখানাতে তখন থেকেই আস্তে আস্তে দাড়িগোঁফের দখলদারিত্ব শুরু।
এরপরের বাকিটা জীবন বিপ্লবের জীবন। গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কারে ছিলেন নিয়মিত মুখ। পরবর্তীকালে ফিদেল ক্যাস্ত্রো ও রাউলের সাথে পরিচয়৷ যার ফলশ্রুতিতে বিপ্লবে আসে আরেক হাওয়াবদল। কিউবার বিপ্লবে অংশগ্রহন করেন চে। ফিদেল ক্যাস্ত্রো হয়ে যান কাছের থেকেও কাছের বন্ধু। এ প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো, আর্জেন্টিনার তরুণ চে গুয়েভারা কেন কিউবার বিপ্লবের প্রধান মুখ হলেন, তার পেছনে অনেক কিছুর অবদান থাকলেও একটা গল্পেরও সেখানে আছে বিশাল অবদান, যে গল্প জানেন না অনেকেই। চে, মাত্র এগারো বছর বয়সেই আগ্রহী হয়েছিলেন কিউবা নিয়ে। কিউবার দাবা খেলোয়াড় বিখ্যাত কাপাব্লাংকা এসেছিলেন আর্জেন্টিনার বুয়েনস এইরেসে। চে আবার ছিলেন দাবার দারুণ ভক্ত। কাপাব্লাংকাকে যখন চে কাছ দেখেন, তখনই তিনি কিউবা নিয়ে ব্যাপই আগ্রহী হয়ে ওঠেন। সেই থেকেই কিউবা-প্রীতি শুরু তাঁর।
কিউবার বিপ্লবের পর যখন নতুন সরকার আসে কিউবায়, সে নতুন সরকারেরও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন এ মানুষটি। আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন করেন। তিনি দায়িত্বপালন করেন কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরেরও।
চে মন্ত্রী হলেন, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোও সামলালেন, কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। সবকিছুর পাশাপাশি বিপ্লবের অস্তিত্বকেও তিনি রাখলেন জারি। যেখানেই দেখলেন শ্রেণিবৈষম্য, সেখানেই তিনি করতে লাগলেন প্রতিবাদ, বিপ্লব। এর মাঝে একবার চলে গেলেন কঙ্গোতে৷ সেখানে গৃহযুদ্ধে লুবুম্বা ব্যাটালিয়ন সামলানোর কাজও করলেন তিনি। আফ্রিকার মানুষেরর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনাই ছিলো কঙ্গোতে তার বিপ্লবের প্রধান কারণ। তখন সময় প্রতিকূলে। চে যাই করছিলেন না কেন, করছিলেন লুকিয়েচুরিয়ে। কারণ অনেক দেশের শাসকগোষ্ঠীই তাকে পাওয়ার জন্যে, তাকে খুন করার জন্যে মরিয়া। কিন্তু চে'র টিকিটিও পাওয়া যাচ্ছেনা কোথাও। প্রবল দক্ষতায় তিনি সবাইকে এড়িয়ে ঠিকই নিজের কাজ করে নিচ্ছিলেন।
এরইমধ্যে জানা গেলো, চে আছেন বলিভিয়াতে। কাস্ত্রোর আদেশে তিনি মন্টেন ড্রাই ফরেষ্ট নামক দুর্গম এলাকায় প্রশিক্ষন চালাচ্ছেন, যেখানে বলিভিয়ার স্থানীয় সমাজতান্ত্রিক নেতারাও তাকে সাহায্য করছেন। বলিভিয়ার সেনাবাহিনী এই গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চে'কে গ্রেফতার করে ৮ তারিখে এবং ৯ তারিখে তাঁর মৃত্যু হয়৷ যদিও নেতাজীর মৃত্যুরহস্যের মতন তাঁর মৃত্যু নিয়েও আছে প্রবল রহস্য। কেউ বলেন, তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বেশ কিছুদিন রাখা হয় টর্চার সেলে। এরপর মেরে ফেলা হয় তাকে। আবার কেউ কেউ বলেন, যেদিন চে গুয়েভারাকে পাওয়া যায় তার পরদিন 'লা হিগুয়েরা' নামক জায়গায় তাকে নিরস্ত্র অবস্থায় মারা হয়৷ কোন ঘটনাটি আসলে সঠিক, তা নিয়ে তীব্র মতানৈক্য অনেকদিন ধরেই আছে। তবে যেটাই হোক, এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বিপ্লবের এক জ্বলজ্যান্ত প্রতীকের অন্তিম প্রয়াণ রচিত হয়। সেটিই মোদ্দাকথা। সেনাবাহিনীর গুলিতে মৃত্যুর আগে চে অবিচল চিত্তে বলে যান -
গুলি কোরো না। আমি চে গুয়েভারা। মৃত চে গুয়েভারার চেয়ে জীবিত চে গুয়েভারা তোমাদের জন্য বেশি মূল্যবান।
চে'কে নিয়ে চাইলে অজস্র শব্দ কোনো চিন্তাভাবনা ছাড়াই খরচ করে ফেলা যাবে। এতটাই বৈচিত্র্যময় জীবন তাঁর। যে বিক্ষুব্ধ সময়ের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি, সে সময় জানে কতটা শাণিত ছিলেন তিনি। আমরা, যারা তাকে চিনি বই, সিনেমা, টিশার্ট, ক্যাপের সূত্রে...আমরা কতটা তাকে ধারণ করতে পারি বা পেরেছি, সে নিয়ে চাইলে অজস্র বিতর্ক হয়ে যেতে পারে। তবে যেকোনো সংকটে, যেকোনো অন্যায়ে এখনও আমরা স্বপ্ন দেখি এই চিরতরুণ মানুষটির মতন বিক্ষোভের, বিপ্লবের... চে'র সাফল্য, ব্যাপ্তি বা বিশালতা তো এখানেই।
যে বিশালতা মহাকালের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে বাড়তে থাকে। কমেনা কখনো। কখনই না।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন