বিরাট কোহলির কাঁধে হাত রেখে তিনি কথা দিয়েছিলেন- ‘আমি কিন্ত ওয়াংখেড়েতে থাকব!’ ২০২৩ বিশ্বকাপের আয়োজক হবে ভারত, ঘরের মাটিতে নিজের দল ফাইনাল খেলবে, আর সেই ফাইনাল দেখতে ৯১ বছর বয়সে চিরতরুণ মন নিয়ে চারুলতা প্যাটেল বিলেত থেকে ছুটে আসবেন মুম্বাইতে- এটাই ছিল তাঁর স্বপ্ন। নিজের দেয়া কথা রাখতে পারলেন না চারুলতা, ৮৮ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন গত বিশ্বকাপে গ্যালারিতে হাজির হয়ে আলোচনার জন্ম দেয়া এই ক্রিকেটপ্রেমী।

৮৩' বিশ্বকাপের ফাইনালটা মাঠে বসে দেখেছিলেম চারুলতা প্যাটেল। পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ভারত সেবার শিরোপা জিতেছিল, লর্ডসে বিশ্বকাপের ট্রফিটা উঁচিয়ে ধরেছিলেন কপিল দেব। তখন চারুলতার বয়স ছিল ৫১ বছর, মধ্যবয়স্ক এক নারী তিনি, হাঁটাচলায় সমস্যা ছিল না কোন। ছত্রিশ বছর পরে বিরাট কোহলির ভারত যখন ইংল্যান্ডে গিয়েছে আরেকটা বিশ্বকাপ শিরোপা জেতার মিশনে, তখনও সেখানে হাজির চারুলতা। সাতাশি বছর বয়সের বৃদ্ধ শরীরটাকে হুইলচেয়ারে টেনে নিয়ে ঠিকই তিনি হাজির হয়েছেন মাঠে!

গত বিশ্বকাপে বার্মিংহামের এজবাস্টন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন রোহিত শর্মা, মুস্তাফিজ নিয়েছেন পাঁচ উইকেট, জসপ্রিত বুমরাহ চারটি। অথচ সেদিনের সবটুকু আলো নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছিলেন চারুলতা প্যাটেল। স্টার ক্রিকেটের ক্যামেরার চোখ বারবার খুঁজে নিচ্ছিলো তাকে, গ্যালারিতে বসে কখনও ভুভুজেলা বাজাচ্ছেন তিনি, রোহিতের চারের মারে হাততালি দিচ্ছিলেন, বাংলাদেশের উইকেট পড়লেই খুশিতে ঝলমল করছিল তার চেহারা।

বাড়তি পাওনা হিসেবে ম্যাচশেষে পেয়েছেন ক্রিকেটারদের দেখা, বিরাট কোহলি তো তার সামনে বসে অনেক্ষণ কথাও বলেছেন, রোহিত আর কোহলি, দুজনকেই জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছেন চারুলতা, করেছেন আশীর্বাদ। হোটেলে ফিরে টুইট করে কোহলি জানিয়েছেন তার মুগ্ধতার কথা, বলেছেন, এমন পাঁড় ভক্তের আশীর্বাদ আর ভালোবাসা নিয়ে বিশ্বকাপ শিরোপাটা ঘরে ফিরিয়ে আনতে চান তারা। এবার তো হয়নি, কে জানে, ২০২৩ বিশ্বকাপটা ভারত হয়তো জিতে যাবে। স্বর্গে স্বামীর হাত ধরে সেই জয়ের সাক্ষী হবেন চারুলতা, তার চোখের কোণে হয়তো জমবে সুখের আনন্দাশ্রু। 

বিরাট কোহলিকে আশির্বাদ করছেন চারুলতা প্যাটেল

ক্রিকেটের সঙ্গে ইংল্যান্ড প্রবাসী ভারতীয় চারুলতার সম্পর্কটা পুরনো। তার দুই ছেলে সারে'র বয়সভিত্তিক দলের হয়ে খেলেছেন অ্যামেচার ক্রিকেটার হিসেবে, তখন থেকেই খেলাটা বোঝেন তিনি, ভালোবাসার জন্মও সেখান থেকে। ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়টা ভারতের বুকে ক্রিকেটের অন্যরকম একটা উন্মাদনা তৈরি করেছিল, ক্রিকেট একটা ব্র‍্যান্ড, একটা ধর্মের মতো হয়ে গিয়েছিল সেখানে। ফাইনালের সেই দিনটা চারুলতা কোনদিনও ভুলতে পারবেন না, কপিলের হাতে ট্রফিটা দেখে হাজারো ভারতীয়র মতো তিনিও চোখের জল ফেলেছিলেন খুশিতে।

সময় থেমে থাকে না। ঘড়ির কাঁটায় বয়স বেড়ে হয়েছে সাতাশি, হাঁটাচলা সীমিত হয়ে পড়েছিল, বাথরুমে যেতে হলেও একজনের সাহায্য লাগতো। প্যাশন আর ভালোবাসাটা কিন্ত কমেনি চারুলতার, আর তাইতো ভারতের খেলা দেখতে এই অসুস্থ শরীর নিয়েও হাজির হয়েছেন মাঠে। শরীরের বয়স বেড়েছে, মনের বয়সটাকে বাড়তে দেননি চারুলতা, সেখানে এখনও তিনি বাইশ-তেইশের তরুণী।

৮৩'র বিশ্বকাপে খেলা দেখার সময় পাশে স্বামী ছিলেন, তিনি এখন পরলোকগত। চারুলতা এসেছেন সন্তান আর নাতিদের হাত ধরে। এক হাতে তেরঙ্গা পতাকা, অন্য হাতে ভুভুজেলা। জোরে কথা বললে গলা ব্যাথা করে, সেই ব্যাথা ভুলে গিয়ে তিনি প্রাণপণে চিৎকার করেছেন ভারতের সমর্থনে। প্রতিটা বাউন্ডারি, প্রতিটা উইকেটের পরেই তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ধরা পড়েছে ক্যামেরায়। কমেন্ট্রি বক্সে বসা ধারাভাষ্যকারেরাও বারবার বলছিলেন তার কথা।

বিশ্বকাপের ম্যাচে সবটুকু আলো নিজের দিকে টেনে নিয়েছিলেন চারুলতা

পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান শেষে কোহলি আর রোহিত ছুটে গিয়েছেন গ্যালারীতে, দেখা করেছিলেন চারুলতার সঙ্গে। কোহলি তো একদম হুইলচেয়ারের সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে কথা বলেছেন, যেন পাশের বাড়ির ছেলে তিনি। দুজনকেই জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছেন চারুলতা, ভারতীয় অধিনায়ক এবং সহ-অধিনায়কের ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। মন ভরে প্রার্থনা করেছেন ওদের জন্যে, ইংল্যান্ড থেকে ওরা যাতে খালি হাতে না ফেরে। ভারত বিশ্বকাপ জিততে পারেনি, কিন্ত সারাশি বছরের চারুলতা প্যাটেল জয় করে নিয়েছিলেন পুরো বিশ্বের ক্রিকেটপ্রেমীদের মন।

ডন ব্র‍্যাডম্যান থেকে ভিভ রিচার্ডস, শচিন টেন্ডুলকার থেকে বিরাট কোহলি, কিংবা ওয়াসিম আকরাম থেকে শেন ওয়ার্ন- ক্রিকেটটা ওদের অর্জনে, ওদের অবদানের কারণে সুন্দর। সেই সৌন্দর্য্যে বাড়তি পালক যোগ করেন চারুলতা প্যাটেলের মতো মানুষেরা। নিজের দলকে, ক্রিকেট খেলাটাকে ভালোবেসে যারা বয়স আর শারীরিক সামর্থ্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মনের জোরটার প্রমাণ দিয়ে চলেন বারবার...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা